রবিবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০১২

রাশিয়ায় উদার গণতন্ত্রের অভিযাত্রা ও আমরা


২০১২-০১-০২

১৯৯১ সালের ডিসেম্বর মাসে রাশিয়ায় কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতাচ্যুত হয়। এই ক্ষমতাচ্যুতিতে কোনো রক্তপাত ঘটেনি। শান্তিপূর্ণভাবেই রাশিয়ায় ঘটতে পেরেছে বিরাট এক রাজনৈতিক পরিবর্তন, যার কথা আগে ভাবা যায়নি। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল ১৫টি প্রজাতন্ত্রের সমন্বয়ে গঠিত। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে ঘটেনি কোনো রক্তপাতের ঘটনা। এটাও বিশেষ লক্ষণীয় ঘটনা। রাশিয়ায় কিছু দিন আগে রুশ পার্লামেন্টের (দুমা) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। কিন' এই নির্বাচন নিয়ে এখন সৃষ্টি হয়েছে সংশয়। বলা হচ্ছে, রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ভ্লাদিমির পুতিন নির্বাচনে কারচুপি করে বিজয়ী হয়েছেন। রাশিয়ায় উঠেছে এই নির্বাচন বাতিল করে নতুন নির্বাচন করার দাবি। মস্কোসহ রাশিয়ার বিভিন্ন শহরে মানুষ করছে পথসভা, করছে মিছিল। বলছে, পুতিন ক্ষমতা ছাড়ো। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট মেদভেদেভ নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে কি না সেটা অনুসন্ধান করার জন্য নির্দেশ প্রদান করেছেন। যদি প্রমাণ হয়, নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে, তবে তার ফল কী দাঁড়াবে আমরা তা বলতে পারি না। পুতিন বলছেন, সে দেশের মানুষ পথে নামছে, বিক্ষোভ করছে; এর মূলে আছে মার্কিন অর্থের প্রভাব। রাশিয়া একটা অনেক প্রাচীন দেশ। রুশরা যথেষ্ট দেশপ্রেমিক। পুতিনের অভিযোগ রুশ জনমতকে খাটো করে দেখছে। একসময় রুশ কমিউনিস্ট পার্টি বলত, তাদের বিরুদ্ধে যারা, তারা সবাই ‘শ্রেণিশত্রু’ আর সাম্রাজ্যবাদীদের অর্থপুষ্ট। পুতিনের কথায় শোনা যাচ্ছে কতকটা সেই পুরনো সুরের সঙ্গীত। কিন' রুশ জনমত এখন যে পরিসি'তিতে এসে পৌঁছেছে, তাতে এই যুক্তি তাদের ওপর খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারবে বলে মনে হয় না। রাশিয়া আর ফিরে যাবে না অতীতের একদলীয় শাসনব্যবস'ায়। রাশিয়ায় বলবৎ থাকবে বহুদলীয় গণতন্ত্র। রাশিয়া একটি বিরাট সামরিক শক্তি। রাশিয়ায় রয়েছেন প্রথম শ্রেণীর বহু বৈজ্ঞানিক ও কৃৎকৌশলী। তারা সবাই উদার গণতন্ত্রের পক্ষে। পুতিন এদের টপকে এক দলের শাসনব্যবস'াকে ফিরিয়ে আনতে পারবেন বলে মনে হয় না। পুতিনের রাজনীতির পেছনে কাজ করছে উগ্র রুশ জাতীয়তাবাদ। কিন' এই জাতীয়তাবাদ একদলীয় শাসনের পক্ষে নয়। এই জাতীয়তাবাদ নয় জার্মানির নাৎসি জাতীয়তাবাদের মতো। নাৎসি জার্মান জাতীয়তাবাদ চেয়েছে এক দলের শাসনব্যবস'ার মাধ্যমে শক্তিশালী জার্মানি গঠন করতে। কিন' বর্তমান রাশিয়ায় এ রকম অন্ধ জাতীয়তাবাদী দল নেই। আর রাশিয়ানরা ভাবছেন না যুদ্ধ করে সারা পৃথিবী জয় করে রুশ প্রাধান্য বিস-ারের। অনেক মার্কিন বিশেষজ্ঞ বলছেন, আরব মুসলিম বিশ্বে যে রকম অভ্যুত্থান ঘটছে, রাশিয়াতেও অনুরূপ উত্থান ঘটার সম্ভাবনা আছে। কিন' তাদের এই ধারণাকে মেনে নেয়া যায় না। রাশিয়া অনেক গোছানো দেশ। আর রুশ জাতীয়তাবাদ আরব জাতীয়তাবাদের মতো নয়। বর্তমান আরবদের সাথে তুলনা করা চলে না রুশদের। সেটা করার চেষ্টা চলেছে। রাশিয়ায় গণতন্ত্রের অভিযাত্রা মনে হয়, শান্তিপূর্ণ পথ ধরেই চলবে। মানুষ কোনো দেশেই চাচ্ছে না একদলীয় শাসনব্যবস'া। কারণ, ক্ষমতা মানুষকে দুর্নীতিপরায়ণ করে তুলতে চায় চূড়ান-ভাবে। গণতান্ত্রিক ব্যবস'ায় থাকে একাধিক দল। রাজনৈতিক ক্ষমতা তাই চরমভাবে মানুষকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে তুলতে পারে না। রাজনৈতিক সমস্যা ক্ষমতার সমস্যা। এই সমস্যার সমাধান কেবল বহুদলীয় গণতন্ত্রের মাধ্যমে বাস-বে আসতে পারে। বহুদলীয় উদার গণতন্ত্রের এটাই হলো মূল যুক্তি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এখন আর কেউ দুইবারের বেশি প্রেসিডেন্ট হতে পারেন না। এই আইন আগে তাদের দেশে ছিল না। ১৯৫১ সালে মার্কিন সংবিধান সংশোধন করা হয়। সংবিধানে বলা হয়, কোনো ব্যক্তি আট বছরের বেশি মার্কিন প্রেসিডেন্ট থাকতে পারবেন না। এখন তাই যুক্তরাষ্ট্রে দুইবারের বেশি কেউ প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনে দাঁড়াতে পারেন না। রাশিয়াতে প্রেসিডেন্ট হওয়ার ক্ষেত্রে এ রকম কোনো আইন, যত দূর জানি এখনো প্রবর্তিত হয়নি। মার্কিন গণতন্ত্র প্রেসিডেন্ট-কেন্দ্রিক। কিন' রাশিয়ান গণতন্ত্র আধা প্রেসিডেন্ট, আধা প্রধানমন্ত্রীনির্ভর। এ ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে কার কতটা ক্ষমতা, সেটা এখনো সুস্পষ্ট নয়। পুতিন এর আগে ছিলেন প্রেসিডেন্ট। পরে তিনি ক্ষমতা ছেড়ে দেন মেদভেদেভের হাতে। নিজে হলেন প্রধানমন্ত্রী। এখন আবার নাকি চাচ্ছেন রুশ প্রেসিডেন্ট হতে। রাশিয়ার সংবিধানকে তাই বলা যাচ্ছে না একটা ‘সংবিধান’। কিন' তবুও মানুষ সে দেশে এগিয়ে চলেছে উদার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠারই পথে। তারা আর ফিরে যেতে ইচ্ছুক নয় একদলীয় শাসনব্যবস'ায়। রাশিয়ার একদলীয় শাসনব্যবস'া বাংলাদেশে প্রভাব ফেলেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাবে আওয়ামী লীগ চেয়েছিল একদলীয় রাষ্ট্রব্যবস'ার প্রবর্তন করতে। গঠিত হয়েছিল বাকশাল। কিন' এ দেশের মানুষ বাকশাল মেনে নিতে সম্মত হয়নি। বাকশাল গঠন করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ পড়েছিল বিরাট বিপর্যয়েরই মধ্যে। বাকশাল গঠনকে বিশেষভাবে সমর্থন করেছিলেন এ দেশের তখনকার মস্কোপন'ী কমিউনিস্টরা। পত্রিকার খবর দেখে খুশি হলাম যে, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) বর্তমানে বলছে, হাইকোর্টের আলোকে আরো দুই টার্মের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস'া বজায় রাখা উচিত। আমার মনে হয়, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কট কাটাতে হলে আপাতত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস'াকে বজায় রাখা উচিত হবে। বাংলাদেশে কেবল শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন করে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করা সম্ভব হবে না। রাশিয়ার মতো দেশে ভোট কারচুপির অভিযোগ উঠেছে। বর্তমানে বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক সমস্যার উদ্ভব হয়েছে, তার সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিয়ন্ত্রণে আগাম অবাধ নির্বাচনের। আওয়ামী লীগ যে পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করছে তাতে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়েছে। আওয়ামী লীগ যে সাংস্কৃতিক নীতি অনুসরণ করছে, তা বাংলাদেশের সংস্কৃতির বিকাশে সৃষ্টি করছে প্রতিকূলতা। আওয়ামী লীগ বলছে, ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে হবে। তাদের আওয়ামী লীগ তুলনা করছে অসুরের সাথে। এ দেশের হিন্দুদের আওয়ামী লীগ বলছে, মা দুর্গা যেমন অসুর বধ করেন, তেমনি এ দেশের হিন্দুদের উচিত হবে ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বধ করতে উদ্বুদ্ধ হওয়া। কারণ তারা অসুরসদৃশ। আওয়ামী লীগের এ ধরনের বক্তব্য হিন্দু-মুসলমান বিরোধকে বিশেষভাবে বাড়িয়ে তুলতেই পারে। আওয়ামী লীগের বক্তব্য শুনে মনে হচ্ছে, কারা যুদ্ধাপরাধী, সেটা ঠিক করাই আছে এবং বিচারটা হচ্ছে একটা লোক দেখানো ব্যাপার। যুদ্ধাপরাধীদের হত্যা করতে হবে। কিন' এ রকম হত্যার রাজনীতি দেশকে শেষ পর্যন- গৃহযুদ্ধের পথেই ঠেলে নিয়ে যাবে যার ফলাফল হবে খুবই অনিশ্চিত। এ রকম গৃহযুদ্ধ বাংলাদেশে ডেকে আনতে পারে ভারতীয় হস্তক্ষেপ। এটা আমাদের অর্থাৎ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পক্ষের শক্তির কাম্য হতে পারে না।
আওয়ামী লীগ এক দিকে বলছে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা, অন্য দিকে দেখাচ্ছে মা দুর্গার প্রতি বিশেষ ভক্তি। তাদের এই নীতি কোনোভাবেই বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অনুকূল হতে পারে না। শেখ মুজিব বাকশাল গঠন করেছিলেন। কেন তিনি তা গঠন করেছিলেন সেটা আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। কারণ এর আগে তিনি সংগ্রাম করেছেন উদার গণতন্ত্রের জন্য। সমালোচনা করেছেন সামরিক শাসনের। শেখ মুজিব কখনোই বাঙালির সংস্কৃতির নামে মা দুর্গার পূজা করতে বলেননি। কিন' তার তনয়া বিশেষভাবে দেখাচ্ছেন মা দুর্গার প্রতি ভক্তি। এক সময় বাংলাদেশের রাজনীতির ওপর পড়েছিল মার্কসবাদ-লেনিনবাদের বিরাট প্রভাব। কিন' এখন মার্কসবাদ- লেনিনবাদ সারা বিশ্বেই হয়ে উঠেছে প্রশ্নের বিষয়। এ দেশের বামপন'ী বলে পরিচিতদের বিষয়টিকে বিশেষভাবে উপলব্ধি করতে হবে। মার্কস তার অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে দু’টি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব প্রদান করেছিলেন। একটি হলো উৎপাদনী শক্তি আর একটি হলো উৎপাদনী সম্পর্ক। তিনি কখনোই বলেননি উৎপাদনী শক্তিকে বিকশিত না করে উৎপাদন সম্পর্কে পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে বলে। মার্কস উৎপাদিকা শক্তি বলতে বুঝিয়েছেন, উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ, উৎপাদনের অনুকূল পরিবেশ, উৎপাদন কলাকৌশলের স-র প্রভৃতি যা কিছু উৎপাদনের কাজে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে এবং উৎপাদনের সহায়তা করে, তাদের সব কিছুকে একত্র করে। পক্ষান-রে উৎপাদনী সম্পর্ক বলতে তিনি বুঝিয়েছেন, উৎপাদনে অংশগ্রহণকারী মানুষের মধ্যে সৃষ্ট সম্পর্ক বা শ্রমবিভাজনকে। সাম্যবাদী সমাজ গড়তে হলে সমাজে অর্থনৈতিক উৎপাদন এমন হতে হবে যাতে সমাজের সবাইকে ন্যূনতম অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য প্রদান সম্ভব হতে পারে। উৎপাদন না বাড়িয়ে বণ্টনে সমতা আনা সম্ভব হতে পারে না। মার্কসের এই বক্তব্য মিথ্যা হয়ে যায়নি। সারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এখন আওয়াজ উঠেছে- ওয়াল স্ট্রিট দখল করো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এতটা উৎপাদনী শক্তির বিকাশ ঘটেছে যে, সেখানে অর্থনৈতিক বণ্টনব্যবস'া সমতাবাদী হতে পারে। কিন' সব দেশের অবস'া এই পর্যায়ে নয়, যদিও সব দেশের রাষ্ট্রের লক্ষ্য হওয়া উচিত দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে বেঁচে থাকতে সহায়তা করা। কোনো আধুনিক রাষ্ট্রেরই কেবল লক্ষ্য হতে পারে না দেশের অভ্যন-রীণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং দেশকে বিদেশের আক্রমণ থেকে রক্ষা করা। সব রাষ্ট্রকেই হতে হবে কম-বেশি কল্যাণব্রতী। দারিদ্র্যকে বিবেচনা করতে হবে একটি সামাজিক সমস্যা হিসেবে; কেবলই ব্যক্তির সমস্যা হিসেবে নয়।
বাংলাদেশে উৎপাদনী শক্তি বিকাশের ওপর প্রদান করতে হবে অধিক গুরুত্ব। সেটাই হবে মূল বামপন'া। অন্য দিকে রাজনীতির ক্ষেত্রে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় দিতে হবে যথাযথ গুরুত্ব। কারণ গণতন্ত্র ছাড়া অর্থনৈতিক বিকাশ রুদ্ধ হতে চাইবে। এক দলের রাজত্বে, এক দল মানুষ হয়ে ওঠে বিশেষ সুবিধাভোগী। তারা যে কেবল রাজনৈতিক কারণে বিশেষ সুবিধা ভোগ করতে পারে, তা নয়। তাদের হাতে চলে যেতে থাকে অর্থনৈতিক ক্ষমতা। সমাজে সৃষ্টি হয় বড় রকমের আয় বৈষম্য। সৃষ্টি হতে পারে না সমতাবাদী সমাজজীবন।

সংশোধনী : গত সংখ্যায় এক স'ানে ভুলবশত ছাপা হয়েছিল- ‘এই উপমহাদেশে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা হয় ১৯১৪ সালে’। সেখানে হবে- ‘এই উপমহাদেশে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা হয় ১৯২৪ সালে। অবশ্য কেউ কেউ বলেন ১৯২২ সালে।’
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন