রবিবার, ৩ জুন, ২০১২

আমাদের অর্থনৈতিক ধ্যানধারণা

আমাদের অর্থনৈতিক ধ্যানধারণা



॥ এবনে গোলাম সামাদ ॥

অর্থনীতি আর রাজনীতি এক নয়। রাজনীতি করতে হলে এখন সব দলেরই থাকতে হয় কিছু না কিছু অর্থনৈতিক বক্তব্য। অর্থনীতি আর রাজনীতি চলতে চায় একে অপরের হাত ধরে। বর্তমানে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের একটি অর্থনৈতিক কার্যসূচি থাকে। অর্থনৈতিক কার্যসূচি বর্তমান কালের রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য হয়ে উঠতে চায় অধিকতর গুরুত্বসম্পন্ন। কারণ অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো সমাধানের উপায় সম্পর্কে সর্বসাধারণের মধ্যে যে রাজনৈতিক মতানৈক্যের উদ্ভব হয়, তার ওপর নির্ভর করেই গড়ে উঠতে চায় দলীয় রাজনীতি। রাষ্ট্রপতি জিয়া সমাজতন্ত্রী ছিলেন না। তিনি ছিলেন রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত মিশ্র অর্থনীতির সমর্থক। তিনি শেখ মুজিবের অর্থনৈতিক চিন্তা-চেতনাকে পরিত্যাগ করে এ দেশের অর্থনীতিকে চান বিশেষভাবে গতিশীল করে তুলতে। প্রেসিডেন্ট জিয়ার সময় বিশেষভাবে আরম্ভ হয় বিদেশে শ্রমশক্তি রফতানি। তার সময় গড়ে ওঠে তৈরী পোশাক শিল্প। গড়ে উঠতে থাকে চিংড়িমাছের ঘের। জিয়া চান স্বেচ্ছাশ্রমকে সুগঠিত করে খাল কেটে কৃষিতে সেচব্যবস্থার উন্নয়ন। আর চান ুদ্র শিল্প বিকাশের মাধ্যমে কর্মসংস্থান বাড়াতে। এর জন্য তিনি ব্যক্তিকে করেন রাষ্ট্রিক সহায়তা প্রদান। শেখ মুজিব চেয়েছিলেন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়তে। আর এ ল্েয পৌঁছানোর জন্য বহুদলীয় গণতন্ত্রের পরিবর্তে তিনি গড়তে চান এক দলের রাজত্ব, বাকশাল। তিনি একে আখ্যায়িত করেন দুঃখী মানুষের গণতন্ত্র বলে। রাজনীতিতে জিয়া চাননি এক দলের রাজত্ব। অর্থাৎ বিএনপি আর আওয়ামী লীগের মধ্যে থেকেছে বড় রকমের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চিন্তা-চেতনার পার্থক্য। জিয়া মনে করেননি কেবল বিএনপি দেশের আর্থিক উন্নয়ন ঘটাতে পারে। তিনি দিতে চেয়েছেন অন্য দলকেও দেশ ও জাতি গড়ে তোলার সুযোগ। কিন্তু আওয়ামী লীগ এটা দিতে চায়নি। তারা মনে করে এবং এখনো মনে করে থাকে যে, দল হিসেবে কেবল তারাই পারে এ দেশের মঙ্গলসাধন করতে। এ দেশের ভালো-মন্দের বিচারে কেবল তাদেরই আছে একচেটিয়া অধিকার। এসব কথা মনে পড়ছিল ৩০ মে, ২০১২ জিয়ার মৃত্যুবার্ষিকী উপল।ে কিন্তু মনে হচ্ছে একটা কথা ভাবছে না আমাদের দেশের কোনো রাজনৈতিক দল। তা হলো, আমাদের অর্থনীতি হয়ে পড়ছে খুবই বিদেশনির্ভর। আমরা বিদেশে জনসমষ্টি রফতানি করছি। কিন্তু এই রফতানি নির্ভর করছে বিদেশের পরিস্থিতির ওপর। এক সময় লিবিয়ায় জনশক্তি রফতানি করে প্রচুর আয় করেছি। কিন্তু এখন আর তা সম্ভব হচ্ছে না। গোটা মধ্যপ্রাচ্যের অবস্থা হয়ে উঠেছে অনিশ্চিত। আমরা বিদেশে তৈরী পোশাক রফতানি করে যথেষ্ট আয় করছি। কিন্তু এই আয় বন্ধ হতে পারে উন্নত দেশগুলোতে বাণিজ্য মন্দা (Business cycle) আরো ঘনীভূত হওয়ার ফলে। বিদেশের অর্থনীতি আমাদের নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। আমাদের রফতানিনির্ভর অর্থনীতি তাই হয়ে উঠেছে খুবই অনিশ্চিত। জিয়া চেয়েছিলেন আখের রস থেকে চিনি তৈরী করে বিশ্বের বাজারে বিক্রি করতে। কিন্তু তিনি এ কাজে সাফল্য পাননি। বিশ্বের বাজারে আমরা পারিনি ইন্দোনেশিয়া ও কিউবার চিনির সাথে দামের প্রতিযোগিতা করতে। তারা আমাদের চেয়ে অনেক সস্তায় চিনি বিক্রি করতে পারে। যেটা আমাদের পে সম্ভব নয়। জিয়া চিনির উৎপাদন বাড়ানোর জন্য দেশে আখের গুড় তৈরি বন্ধ করেছিলেন। এটা ছিল তার এক বিশেষ ভুল। 
আমরা আমাদের অর্থনীতিকে করে তুলতে চাচ্ছি বড় বেশি রফতানিনির্ভর। যেটা ঠিক হচ্ছে না। বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ রাউল প্রেবিশ (১৯০১-১৯৮৬) বলেনÑ একটা অনুন্নত কৃষিপ্রধান দেশ যদি একটা উন্নত শিল্পপ্রধান দেশের সাথে বাণিজ্য করে, তবে তাতে সব সময় কৃষিপ্রধান দেশটির তি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে অনুন্নত দেশগুলোর উচিত হলো তার অভ্যন্তরীণ বাজার উন্নয়নে ব্রতী হওয়া। অভ্যন্তরীণ বাজার উন্নয়ন না করলে একটা দেশ কখনোই তার অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা কাটাতে পারে না। সে হঠাৎ পড়তে পারে গভীর অর্থনৈতিক সঙ্কটেরই মধ্যে। রাউল প্রেবিশ ছিলেন আর্জেন্টিনার অধিবাসী। আর্জেন্টিনা একসময় ব্রিটেনে মাংস ও গম রফতানি করে প্রচুর আয় করে। কিন্তু ব্রিটেন একপর্যায়ে আর্জেন্টিনা থেকে মাংস ও গম আমদানি বন্ধ করে। শেষে সস্তায় মাংস ও গম কিনতে থাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। ফলে আর্জেন্টিনার অর্থনীতি পড়ে বিরাট বিপর্যয়েরই মধ্যে। প্রেবিশ তাই প্রত্যেক জাতিকে বলেছেনÑ নিজের দেশের বাজারকে উন্নত করতে। তাতে কোনো দেশকে পড়তে হয় না হঠাৎ করে অর্থনৈতিক সঙ্কটে। কিন্তু বাংলাদেশে আমরা অর্থনৈতিক উন্নয়ন চাচ্ছি রফতানিমুখীন অর্থনীতিকে নির্ভর করে। আমরা চাচ্ছি বিদেশীরা আমাদের দেশে পুঁজি লগ্নি করুক। কিন্তু বিদেশী পুঁজি গ্রহণ করাতেও থাকে অনেক বিপত্তি। বিদেশীরা এসে একটা দেশের জায়গা দখল করে। সস্তা কাঁচামাল ও শ্রমশক্তি ব্যবহার করে। একটা দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি গিয়ে পড়তে চায় বিদেশের নিয়ন্ত্রণে। বিদেশী পুঁজি নিয়োগের ফলে কোনো দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের যে উন্নতিটুকু ঘটে তার ফল বিদেশীরাই ভোগ করে বেশি; যে দেশে বিদেশীরা পুঁজি খাটায় সে দেশের মানুষেরা নয়। আমরা একদিন সাবেক পাকিস্তান আমলে বলেছিÑ পশ্চিম পাকিস্তানের পুঁজিপতিরা আমাদের শোষণ করছে। কিন্তু এখন আমরা চাচ্ছি বিদেশী পুঁজি বিনিয়োগ।
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার চাচ্ছে ভারতীয় পুঁজির মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটাতে। কিন্তু এটা হতে পারে আমাদের জন্য মারাত্মক তির কারণ। ব্রিটিশ শাসনামলে মাড়োয়ারি পুঁজি কব্জা করে ফেলেছিল তখনকার বাংলার অর্থনীতিকে। আবার ফিরে আসতে পারে সেই একই অবস্থা। বিদেশী পুঁজি বিনিয়োগে আমাদের তাই হতে হবে যথেষ্ট সাবধান। ব্রিটিশ শাসনামলে তখনকার বাংলার পাট নিয়ে ব্যবসা করে ধনী হয়েছে ব্রিটিশ ইহুদি র্যালি কোম্পানি। পরে এ ব্যবসায় ধনী হয় মাড়োয়ারিরা রাজস্থান থেকে বাংলায় এসে। এই ইতিহাস মনে রাখারই মতো। পাট অবশ্য আগের মতো অর্থকারী ফসল নয়। কিন্তু তবু বাংলাদেশে পুঁজি বিনিয়োগ করে লাভবান হতে পারে বিদেশীরা। আর আমরা ব্যবসায়-বাণিজ্যে হারাতে পারি আমাদের নিয়ন্ত্রণ। আমরা পাকিস্তান আমলে আদমজী, ইস্পাহানী, দাদা, সাহাগলদের পছন্দ করিনি। আওয়ামী লীগ তুলেছে ছয় দফা। কিন্তু আজ আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে অনুপ্রবিষ্ট হতে দিতে চাচ্ছে ভারতীয় পুঁজিকে। আওয়ামী লীগের সাথে বিএনপির বিরোধ কেবল কেয়ারটেকার সরকার নিয়ে নয়। এই বিরোধের মূল হলো আরো গভীরে প্রথিত। আমাদের সেটা উপলব্ধি করতে হবে। 
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

রবিবার, ২৭ মে, ২০১২

ফরাসি দেশে সমাজতন্ত্রী প্রেসিডেন্ট

ফরাসি দেশে সমাজতন্ত্রী প্রেসিডেন্ট



॥ এবনে গোলাম সামাদ ॥

ফরাসি দেশে নির্বাচন হয়ে গেল। নির্বাচনে হেরে গেলেন মধ্য ডানপন্থী হিসেবে পরিচিত নিকোলাস সারকোজি। প্রেসিডেন্ট থাকাবস্থায় নিকোলাস সারকোজি পরাজিত হন। ইতঃপূর্বে কোনো ফরাসি প্রেসিডেন্টকে এভাবে পরাজিত হতে হয়নি। ফরাসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন ফরাসি সমাজতন্ত্রী দলের প্রার্থী ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদে। ফরাসি দেশে দীর্ঘ দিন ধরে কোনো সমাজতন্ত্রী প্রেসিডেন্ট হননি। এর আগে সমাজতন্ত্রী প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন ফ্রাঁসোয়া মিত্রঁ। তিনি প্রেসিডেন্ট ছিলেন ১৯৮১ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত। মিত্রঁ সমাজতন্ত্রী হয়েও ফরাসি দেশে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির প্রবর্তন চাননি। বর্তমান সমাজতন্ত্রী প্রেসিডেন্টও যে চাইবেন তা মনে করার কোনো কারণ নেই। তিনি হয়তো জনকল্যাণে বরাদ্দ করবেন আরো কিছু বেশি অর্থ। যার ফলে ফরাসি দেশে বাড়বে জনকল্যাণের মাত্রা। ফরাসি সমাজতন্ত্রীরা ইউরোপের অন্যান্য দেশের সমাজতন্ত্রীদের মতো অনুসরণ করতে চাচ্ছেন কল্যাণব্রতী রাষ্ট্রের ধারণা। সাবেক সমাজতন্ত্রী ধ্যানধারণাকে তারা এখন আর আঁকড়ে ধরে রাখার পে নন। তারা কার্যত হয়ে উঠেছেন রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত মিশ্র অর্থনীতির প।ে তাদের আর বলা যায় না ঠিক সমাজতান্ত্রিক দর্শনের অনুসারী হিসেবে। ফরাসি সমাজ দার্শনিক ও রাজনীতিবিদ লিওঁ বুর্জোয়া (১৮৫১-১৯২৫) প্রচার করেন তার সমাজতান্ত্রিক দর্শন (Solidarism)। তিনি বলেন, সমাজে যারা অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জন করেন, তারা যে সেটা করতে পারেন কেবলই নিজের যোগ্যতার জন্য, তা নয়। সামাজিক পরিস্থিতি তাদের এই সাফল্য অর্জনে সুযোগ দেয়। এবং এনে দেয় তাদের সাফল্য। সুতরাং সম্পদে কেবল তাদের অধিকার থাকতে পারে না। সম্পদে তাদেরও অধিকার আছে, যারা অন্যকে সম্পদ অর্জনে সাহায্য করছে। আদর্শ সমাজে তাই সম্পদের বণ্টন হতে হবে এমনভাবে যে, যারা সম্পদ অর্জনে সহায়তা করছেন, তাদেরও অর্জিত সম্পদের ওপর থাকতে হবে কিছু অধিকার। অর্থনীতিকে হতে হবে সামাজিক, যাতে হতে পারে সমাজের সবারই কল্যাণ। বুর্জোয়া বলেন, এর জন্য বড়লোকদের আয়ের ওপর বসাতে হবে কর। আর এই করের টাকা দিয়ে সাহায্য করতে হবে গরিব জনসমষ্টিকে। তাদের থাকতে হবে জীবনযাত্রার ন্যূনতম মান, খেয়ে পরে বাঁচার অধিকার। শিাব্যবস্থা হতে হবে অবৈতনিক এবং সবার জন্য উন্মুক্ত। সবার জন্য থাকতে হবে দুর্ঘটনা-বীমা। শ্রমিকদের থাকতে হবে ন্যূনতম মজুরির বিধান। থাকতে হবে শ্রমসময়ের বিধান। সরকারকে নির্মাণ করতে হবে বাড়িঘর, যা মানুষ কিনতে পারবে সহজেই। থাকতে হবে বিনামূল্যে চিকিৎসার বিধান। এসব করতে পারলে সমাজসঙ্গতি বাড়বে। আর সমাজসঙ্গতি বাড়লে ঘটবে সামগ্রিকভাবে সমাজের উন্নতি। মোটামুটিভাবে ফরাসি সমাজতন্ত্রীর ধারণা, সমাজসঙ্গতি বাড়ানোর দর্শনের ধারণা এখন হয়ে উঠছে প্রায় একই রকম। সমাজতন্ত্রীরা এখন মনে করেন না যে, সমাজের অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য উৎপাদনের উপায় (means of production) রাষ্ট্রায়ত্ত করতেই হবে। তারা এখন বলেন না, কলকারখানা জমিজমা আর এক কথায় প্রাকৃতিক সম্পদ হতে হবে রাষ্ট্রিক। ব্যক্তিগত মালিকানা বলে থাকবে না আর কিছু। রাষ্ট্র পরিচালনা করবে একটা দেশের সমগ্র অর্থনীতিকে। সমাজতন্ত্র আর রাষ্ট্রতন্ত্র এখন আর একত্র করে দেখছেন না সমাজতন্ত্রীরা। তারা চাচ্ছেন উৎপাদিত সম্পদের সামাজিক সুবণ্টন। আর এক কথায় সামাজিক অর্থনীতি গড়ে তোলাকে। তারা মনে করছেন, তাদের আদর্শ হিসেবে ফ্রান্সে এক সময় কমিউনিস্টরা খুব শক্তিশালী হয়ে উঠেছেন। কিন্তু এখন তারা হয়ে পড়েছেন মতাশূন্য। কারণ ফ্রান্সের মানুষ গণতন্ত্র চায়। চায় না কোনো দলের একক শাসন। সমাজতন্ত্রী এবং কমিউনিস্টদের মধ্যে একটি বড় পার্থক্য হলো, সমাজতন্ত্রীরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন কিন্তু কমিউনিস্টরা তা করেন না। ফলে ফ্রান্সে তাদের প্রভাব এখন বিশেষভাবেই কমে গিয়েছে। ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদে তার নির্বাচনী প্রচারের সময় বলেন, তিনি বড়লোকদের ওপর কর বাড়াবেন। আর এই করের টাকায় গরিব জনসমষ্টির জীবনযত্রার মান বাড়াতে বিনিয়োগ করবেন। কিন্তু এ েেত্র উঠছে প্রশ্ন। তিনি বড়লোকদের ওপর কতটা কর আরোপ করবেন, আর সেই করের অর্থ কিভাবে ব্যয়িত হবে দরিদ্র জনসাধারণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে। এ েেত্র করের অর্থ অপচয় হওয়ার সম্ভাবনা থাকছে। এ প্রসঙ্গে ফরাসি কর-ব্যবস্থা নিয়ে কিছু কথা বলা যেতে পারে। ফরাসি কর-ব্যবস্থা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, সুইডেন, ডেনমার্ক ও নরওয়ের মতো নয়। এসব দেশে আয়করের মাত্রা হলো বেশি। এসব দেশে কর প্রধানত আরোপ করা হয় মানুষের আয়ের ওপর। এসব দেশে আয়কর ধরা হয় প্রগতিশীলভাবে। প্রগতিশীল বলতে বোঝায় আয় বাড়ানোর সাথে সাথে অধিক হারে কর দেয়ার বিধিকে। কিন্তু ফরাসি দেশে আয়ের ওপর করের মাত্রা ধার্য হয় কম। কর প্রধানত হলো পরো। করের বোঝা শেষ পর্যন্ত তাই গিয়ে পড়ে আয়ের ওপর নয়, খরচের ওপর। ফরাসি কর-ব্যবস্থায় প্রত্য করের চেয়ে পরো করের মাত্রা বেশি। পরো করের একটা বিশেষ দৃষ্টান্ত হলো বিক্রয় কর (Sale tax), যা আসলে হলো ক্রয় কর (Purchase tax)। ফরাসি দেশে তাই কর বাড়ানোর মাত্রা দাঁড়ায় বড়লোকের চেয়ে তুলনামূলক গরিব জনসাধারণের ওপর বেশি। এ ছাড়া বাড়ে ঘাটতি ব্যয়ের পরিমাণ। যা বাড়ায় মুদ্রাস্ফীতি (Currency inflation)। ফরাসি মুদ্রার ক্রয়মতা স্থিতিশীল রাখা হয়ে ওঠে খুবই কষ্টকর। ফরাসির বর্তমান সমাজতন্ত্রী প্রেসিডেন্ট তাই বড়লোকের ওপর কর বসিয়ে তুলনামূলক দরিদ্র জনসমষ্টির জীবনযাত্রার মান কিভাবে উন্নত করতে পারবেন তা নিয়ে থাকছে সংশয়। ফ্রান্স এখন ইউরো মুদ্রার অংশীদার। সে তার নিজের মুদ্রাব্যবস্থার ওপর আর আগের মতো নিয়ন্ত্রণ রাখে না। এ েেত্রও থাকছে মুদ্রা নিয়ন্ত্রণে সমস্যা। ফ্রান্সে এখন বেকার সমস্যা আগের তুলনায় বেড়েছে। ফ্রান্সের নেই আগের মতো বিশাল সাম্রাজ্য। ফরাসিরা আগে তাদের সাম্রাজ্যে গিয়ে যেমন কাজ করতে পারতেন, এখন আর তা সম্ভব নয়। নিজ দেশেই হচ্ছে তাদের কর্মসংস্থান। সমাজতন্ত্রী প্রেসিডেন্ট বলছেন, তিনি কর্মসংস্থান বাড়াবেন আর এর জন্য বাড়াবেন সরকারি পূর্তকাজের পরিমাণ। কিন্তু সরকারি পূর্তকাজ বাড়ানো আর একটা দেশের পণ্য উৎপাদন বাড়া সমার্থক নয়। পণ্য উৎপাদন যদি না বাড়ে, কিন্তু যদি অর্থের জোগান বেড়ে যায়, তবে পণ্য কেনার মতা কমতে থাকে। কারণ অর্থের সরবরাহ বাড়ানোর অর্থ দাঁড়ায় পণ্যের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায়। চাহিদা অনুসারে পণ্যের সরবরাহ না বাড়লে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় অনিবার্য হয়ে ওঠে। আর সাধারণ মানুষ পারে না দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে পণ্য কিনতে। তাকে পড়তে হয় অর্থনৈতিক দুরবস্থারই মধ্যে। অর্থের সরবরাহ বাড়িয়ে তাই সম্ভব হয় না দারিদ্র্য বিমোচন করা। ফ্রান্স আমাদের মতো দরিদ্র দেশ নয়। কিন্তু তবু ফ্রান্সের আছে অর্থনৈতিক সমস্যা। আর ফরাসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য আনতে পারবেন মানুষের মনে এই আশা জাগিয়ে। কিন্তু বাস্তবে তিনি কতটা সফল হবেন তা আমাদের পে আন্দাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। হয়তো দেখা যাবে বর্তমান প্রেসিডেন্ট সমস্যার সমাধান করতে না পেরে জড়িয়ে পড়ছেন অধিক সঙ্কটে।
আমি একসময় ফরাসি দেশে ছাত্র ছিলাম। ফরাসি দেশ আমার কাছে মনে হয়েছে অনেক স্বচ্ছ। যদিও সেখানে দরিদ্র ছিল। আর এখনো আছে। পৃথিবীর কোনো দেশই দরিদ্রমুক্ত নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শতকরা ১৩ ভাগ লোক এখন বাস করেন দারিদ্র্যসীমার নিচে। ফরাসি দেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে কতভাগ মানুষ বাস করেন তার পরিসংখ্যান আমার জানা নেই। তবে ফরাসি দেশে একধরনের মানুষ আছে, যারা পথে-ঘাটে ভিা করেবৃত্তি। এদের বলা হয় কশা। ফরাসি সমাজে কশার উদ্ভব হয় কেন, তা বলা যায় না। এরা কোনো কাজ করে না। নেশা করে, শুয়ে থাকে রাস্তায়। এদের দেখে প্রথমে মনে হতে পারে ফরাসি দেশ বুঝি খুবই গরিব। কিন্তু আসলে তা নয়। ফরাসি দেশে অর্থনীতিতে আছে কৃষি ও শিল্পের মধ্যে বিশেষ ভারসাম্য। অনেক উন্নত দেশের েেত্র যেটা নেই। ফরাসি গ্রাম্য জীবন আমার কাছে বিশেষ ভালো লেগেছে। আমার মনে জেগে আছে তার স্মৃতি। ফ্রান্সে এখন সৃষ্টি হয়েছে একটি বিশেষ সমস্যা, যা আমি যখন ফ্রান্সে ছিলাম তখন ছিল না। ফ্রান্সে আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া ও মরক্কো থেকে অনেক মুসলমান উপনিবেষ্টিত হয়েছেন। যাদের সন্তান সন্ততির মিলিত সংখ্যা এখন হয়ে উঠেছে প্রায় ৫০ লাখের কাছাকাছি। এদের নিয়ে বিশেষ সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে ফ্রান্সে। এরা এক দিকে বিদেশী অন্য দিকে এদের ধর্মবিশ্বাস ফরাসিদের থেকে অনেক ভিন্ন। এদের সাথে তাই ফরাসিদের সৃষ্টি হতে পারছে সমাজ বিজ্ঞানের পরিভাষায় যাকে বলে সংস্কৃতির সঙ্ঘাত। জাতিসত্তার দিক থেকেও এসব উপনিবিষ্টরা হয়ে উঠতে পারছেন না ফরাসি। এদের পূর্বপুরুষ ফ্রান্সে গিয়েছিলেন উন্নত জীবনযাত্রার খোঁজে। কিন্তু তাদের সেই ঈপ্সিত জীবনযাত্রার মান কোনোভাবেই অর্জিত হতে পারেনি। আমার মনে হয় ফরাসি দেশে এদের উপনিবিষ্ট হওয়াটা যুক্তিযুক্ত হয়নি। আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া ও মরক্কোতে রয়েছে যথেষ্ট প্রাকৃতিক সম্পদ। এসব দেশের মানুষের উচিত নিজের দেশে থেকে সুখী হওয়ার চেষ্টা করা। নিজের দেশের অর্থনীতি বিকাশে আত্মনিয়োগ করা। ফ্রান্সে গিয়ে ভাগ্য উন্নয়নের চেষ্টা করা নয়। মরক্কো ছিল ফরাসি প্রটেক্টরে। তিউনিসিয়াও ছিল ফরাসি প্রটেক্টরে। আলজেরিয়া সরাসরি ছিল ফরাসি শাসনের অধীন। আলজেরিয়াতে গিয়ে বহু ফরাসি উপনিবেষ্টিত হয়েছিলেন। তাদের হাতে চলে যায় আলজেরিয়া সমুদ্র উপকূলবর্তী উর্বর ভূমির এক-তৃতীয়াংশ। আলজেরীয় আরবরা চেয়েছেন ফরাসি শাসনের অবসান। ফরাসি দেশের সাথে আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া ও মরক্কোর মানুষের মিলমিশ হয়নি। ফ্রান্স থেকে তাই ফরাসিরা এখন চাচ্ছেন ফ্রান্সে উপনিবিষ্ট হওয়া মরক্কো, আলজেরীয় ও তিউনিসিয়ানদের বহিষ্কার। ফ্রান্সে মুসলমান মেয়েদের হিজাব পরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এটা না করলেও হয়তো চলত। আমি যখন ফ্রান্সে ছিলাম তখন হিজাব কোনো সমস্যা ছিল না। মরক্কো, আলজেরীয় ও তিউনিসিয়া থেকে যাওয়া মেয়েদের দেখেছি ফরাসি মেয়েদের মতোই পোশাক পরতে। তাদের কাউকে হিজাব পরতে দেখিনি। কিন্তু এখন ফ্রান্সে যে কারণেই হোক হিজাব পরতে চাচ্ছিলেন কিছু মুসলিম মহিলা। ফ্রান্সে এটা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে রাষ্ট্রিক আইন করে। যে রকম আইন ইতঃপূর্বে ফরাসি দেশে করার কোনো প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়নি। আমি ছাত্র থাকাকালীন ফরাসি পুলিশ এক দিন আমাকে ঘিরে ধরেছিল আলজেরীয় মুক্তি সংস্থার সাথে যুক্ত মানুষ হিসেবে। কিন্তু তারা আমার পাসপোর্ট দেখে ছেড়ে দেয়। নিয়ে যায় না কারাগারে। সেটা ১৯৬২ সালের প্রথম দিকের কথা। ফ্রান্সের নতুন প্রেসিডেন্ট উপনিবিষ্ট বিদেশীদের সম্পর্কে কী নীতি গ্রহণ করবেন তা আমরা জানি না। কিন্তু তাকে সম্মুখীন হতে হবে এই জটিল সমস্যারও। ফ্রান্স পাঁচটি বৃহৎ শক্তির মধ্যে একটি। জাতিসঙ্ঘে রয়েছে তার ভেটো প্রদানের মতা। তার হাতে রয়েছে পরমাণবিক অস্ত্র। ফ্রান্স আগের মতো শক্তির অধিকারী না হলেও এখনো বিশ্বরাজনীতিতে পালন করছে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। ফ্রান্স ন্যাটো জোটের মধ্যে আছে। ন্যাটো জোটের সাথে আফগানিস্তানে এসেছে ফরাসি সৈন্য। ইরান নিয়ে কোনো সঙ্ঘাত সৃষ্টি হলে ফ্রান্স তাতে জড়িয়ে পড়তে পারে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ফ্রান্স কী ভূমিকা পালন করবে তা-ও হয়ে থাকছে প্রশ্নসাপে। এ েেত্র ফরাসি প্রেসিডেন্টকে নিতে হবে অনেক কঠিন সিদ্ধান্ত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্দেশে ফ্রান্স কি জড়াবে কোনো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে? 
ফ্রান্সে এখন কোনো সংসদীয় গণতন্ত্র নেই। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের মতো শক্তিধর নন। ফ্রান্সে প্রধানমন্ত্রী আছেন। প্রধানমন্ত্রীর থাকে মন্ত্রিপরিষদ। ফ্রান্সে প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টের মধ্যে মতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। ফ্রান্সে রাষ্ট্রব্যবস্থায় এটা হয়ে আছে একটা সমস্যা। একা প্রেসিডেন্ট ফ্রান্সে ইচ্ছামতো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। ফ্রান্সে কার্যত এখন রয়েছে দ্বৈত শাসনব্যবস্থা। এর উদ্ভব হতে পেরেছে ১৯৫৮ সালের পর থেকে। ১৯৫৮ সালের পর সার্ল দ্য গোল-এর মতায় আসার পর থেকে। তিনি প্রবর্তন করে গেছেন এই দ্বৈত শাসনব্যবস্থা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে তৃতীয় ফরাসি রিপাবলিকে ৭০ বছরের মধ্যে সরকার পতন ঘটেছে ১০৬ বার। অর্থাৎ প্রত্যেক মন্ত্রিসভার গড়পড়তায় স্থিতি হয়েছে আট মাস। তার বেশি নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রতিষ্ঠা হয় চতুর্থ ফরাসি রিপাবলিক। ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৫৮ সালের মধ্যে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছে ২০টি। দ্য গোল এসে এই ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটান এবং প্রবর্তন করেন বর্তমান ফরাসি সংবিধানের। বর্তমান ফরাসি সংবিধানে অবশ্য ঘটানো হয়েছে দ্য গোল প্রবর্তিত সংবিধানের কিছু ধারার পরিবর্তন। যেমনÑ দ্য গোল রচিত সংবিধানে ফরাসি প্রেসিডেন্ট হতে পারতেন সাত বছরের জন্য নির্বাচিত। কিন্তু এখন ফরাসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন পাঁচ বছরের জন্য। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইচ্ছা করলে পারেন না ফরাসি প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করতে। ফরাসি দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যে ভোট হয়ে গেল, তাতে ভোটের ব্যবধানকে খুব বড় বলা যায় না। পরাজিত প্রেসিডেন্ট পেয়েছেন শতকরা ৪৮ ভাগ ভোট। অন্য দিকে ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদে পেয়েছেন শতকরা ৫২ ভাগ ভোট। ভোটের এই ব্যবধানকে বাস্তব েেত্র খুব বড় ব্যবধান বলা যায় না। ফ্রান্সে তাই থাকছে বিরাট দণিপন্থী মতামতেরও প্রাধান্য। ফ্রান্স বামপন্থার দিকে ঢুকে পড়েছে ঠিক এ রকম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা মোটেও যুক্তিযুক্ত নয়। 
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

রবিবার, ২০ মে, ২০১২

প্রগতিবাজদের খপ্পরে আওয়ামী লীগ

প্রগতিবাজদের খপ্পরে আওয়ামী লীগ



॥ এবনে গোলাম সামাদ ॥

‘প্রগতিশীল’ আর ‘প্রতিক্রিয়াশীল’-এর ধারণা সৃষ্টি হয় ইউরোপে, ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে। ফরাসি দেশে যারা বিপ্লবের ধারণাকে সমুন্নত রেখে রাজনীতি করতে চান, তাদের বলা হতে থাকে প্রগতিশীল। আর যারা তাদের বিরোধিতা করেন, ফিরে যেতে চান ফরাসি বিপ্লবের আগের অবস্থায়, তাদের বলা হতে থাকে প্রতিক্রিয়াশীল। ফরাসি বিপ্লবের সময় ঘোষণা করা হয় মানবাািধকারের দাবি। এই অধিকারের পে যারা থাকেন তারা হলেন প্রগতিশীল। যারা এর বিরোধিতা করেন তাদের বলা হতে থাকে প্রতিক্রিয়াশীল। ‘প্রগতিবাজ’ কথাটা কিছুটা নিন্দাসূচক। প্রগতিবাজ বলতে বোঝায় সেসব বাম রাজনীতিককে, যারা নিজেদের দাবি করেন মার্কসবাদ ও লেনিনবাদের অনুসারী হিসেবে। ১৯১৭ সালে নভেম্বর মাসে ঘটে রুশ বিপ্লব। এর পর থেকে সৃষ্টি হয় প্রগতিবাজের ধারণা। প্রগতিবাজরা বহুদলীয় গণতন্ত্রে আস্থাবান নন। তারা বিশ্বাস করেন, কেবল তাদের নেতৃত্বেই সমাজে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। এই একদলীয় শাসনের ধারণাকে বলা যায় প্রগতিবাদী ও প্রগতিবাজদের মধ্যে মূল আদর্শগত পার্থক্য। আওয়ামী লীগ ছিল উদার গণতন্ত্রে বিশ্বাসী একটি রাজনৈতিক দল। কিন্তু ১৯৭৫ সালে আশ্চর্যজনকভাবে দলটি প্রভাবিত হয় প্রগতিবাজদের দ্বারা। আওয়ামী লীগ বলে যে, তারা সমাজতন্ত্র চায়। আর তা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন এক দলের শাসনব্যবস্থা। শেখ মুজিব গড়েন বাকশাল। বাকশালের ধ্যান-ধারণা এখনো ছাড়তে পারেনি আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের সাথে এ দেশের আর সব বড় দলের মতবাদিক পার্থক্য হলো, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ঘিরে। অন্যান্য দল যেখানে চাচ্ছে বহুদলীয় গণতন্ত্র, আওয়ামী লীগ সেখানে প্রকারান্তরে প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছে এক দলের রাজত্ব। ১৯৭৫ সালে আওয়ামী লীগ বাকশাল প্রতিষ্ঠা করেছিল মূলত সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির অনুকরণে। সে বলেছিল, বাকশাল গঠনের ল্য হলো, দুঃখী মানুষের গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা। কিন্তু আজ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়েছে। রাশিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বহুদলীয় গণতন্ত্র। রাশিয়া এখন সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির পথ ছেড়ে অনুসরণ করতে চাচ্ছে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত মিশ্র অর্থনীতি। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল ১৫টি রিপাবলিক নিয়ে। এখন তারা পৃথক হয়ে পড়েছে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন পারেনি জাতিসত্তার সমস্যার সমাধান করতে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মার্কসবাদ লেনিনবাদ এখন আর কোনো আবেদনবহ রাজনৈতিক দর্শন নয়। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে বাংলাদেশে এই দর্শনের উত্তরসূরিরা নিয়ন্ত্রিত করতে পারছে আওয়ামী লীগের নীতি; যেটাকে অনেকের কাছেই মনে হচ্ছে বিস্ময়কর। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন একজন উদার গণতন্ত্রী। তিনি গণতন্ত্র বলতে বুঝতেন ব্রিটিশ গণতন্ত্রকে। আর তিনি চেয়েছেন, সেই পথই অনুসরণ করবে আওয়ামী লীগ। কিন্তু তাঁর চিন্তা চেতনার সাথে আজকের আওয়ামী লীগের কোনো সুদূর যোগাযোগও নেই। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মুসলিম লীগ করতেন। তিনি সমর্থন করেছিলেন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবি। কিন্তু যখন তিনি দেখেন যে, এর ফলে সাবেক বাংলা বিভক্ত হয়ে পড়বে, তখন তিনি তোলেন পৃথক স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের দাবি। তিনি ও শরৎচন্দ্র বসু ১৯৪৭ সালে যে স্বাধীন বাংলার দাবি তোলেন, বাংলাভাষী হিন্দু তাতে সাড়া দেননি। এমনকি জ্যোতি বসুর মতো বাম রাজনীতিক সমর্থন করেছিলেন বাংলার বিভক্তিকে। পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তরবঙ্গের কিছুটা নিয়ে সৃষ্টি হয় আজকের ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য। পান্তরে উত্তর, মধ্য ও পূর্ববঙ্গ নিয়ে গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান। গণভোটের মাধ্যমে আসামের শ্রীহট্ট জেলা যুক্ত হয় পূর্ব পাকিস্তানের সাথে। শ্রীহট্ট বা সাবেক সিলেট জেলা এক সময় ছিল বাংলা প্রদেশের অংশ। ১৮৭৪ সালে তাকে যুক্ত করা হয়েছিল আসামের সাথে। গণভোটে তারা ফিরে আসে আবার বাংলা ভাষাভাষী পূর্ব পাকিস্তানে। এভাবে রচিত হয় পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র। শ্রীহট্টের গণভোটের কথা মনে পড়ছে। কারণ এই গণভোটের সময় কমিউনিস্টরা বলেছিলেন যে, শ্রীহট্টবাসীর উচিত হবে ভারতে যোগ দেয়া। যুক্তি হিসেবে তারা বলেছিলেন, ভারত হলো একটা বিরাট ও উন্নত রাষ্ট্র; পাকিস্তান যা কখনোই হতে পারবে না। এদের কথা শুনে সাবেক শ্রীহট্টবাসী যদি পাকিস্তানে যোগ না দিয়ে ভারতে যোগ দিতেন, তবে বাংলাদেশের বর্তমান ত্রেফল হতো ৪৭৮৫ বর্গমাইলের কম। ইংরেজ আমলের শ্রীহট্ট জেলার আয়তন ছিল ৫৪৪০ বর্গমাইল। সাবেক শ্রীহট্ট জেলার করিমগঞ্জ থানা গণভোটে পাকিস্তানে যোগ দেয় না। সিলেটে গণভোট হয়েছিল থানাকে একক ধরে। এ দেশের কমিউনিস্ট বা প্রগতিবাজরা নিয়েছেন ভারতের প। আজো তারা কাজ করছেন ভারতেরই প।ে বর্তমান আওয়ামী লীগের ভারত তোষণ নীতির মূলে আছেন তারা। বর্তমানে এই প্রগতিবাজরা হয়ে উঠেছেন এক নিখিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা। আর এই বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হিসেবে তারা রবীন্দ্রনাথকে করে তুলতে চাচ্ছেন বাংলাদেশের মানুষের Culture Hero বা সংস্কৃতি বীর। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে গড়ে তোলার চেষ্টা হচ্ছে যুক্তিবিহীন অন্ধ ধারণা। রবীন্দ্রনাথের ওপর আরোপ করা হচ্ছে অতিমানবিক গুণাবলি। যার ফলে রবীন্দ্রনাথ যেন হয়ে উঠতে চাচ্ছেন এ দেশের মানুষের জন্য অবতার হিসেবে। 
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন দু’টি রাজনৈতিক দল বড় হয়ে উঠেছে। একটি দল হলো আওয়ামী লীগ, অপরটি হলো বিএনপি। এই দুই দলের মধ্যে চলেছে মতার লড়াই। কিন্তু মতার লড়াই-ই এই দু’টি দলের একমাত্র কথা নয়। দু’টি দলের আদর্শিক পার্থক্যকে নিতে হবে বিবেচনায়। বর্তমান আওয়ামী লীগ বলছে বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা। কিন্তু সব বাংলা ভাষাভাষী মানুষ বাংলাদেশে বাস করছে না। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বাংলাভাষী হলেও ভারত ভেঙে তারা এসে যুক্ত হতে চাচ্ছে না বাংলাদেশের সাথে। আওয়ামী লীগের বাঙালি জাতীয়তাবাদকে তাই বলা চলে না বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। বিএনপি আর আওয়ামী লীগের মধ্যে আছে মতা নিয়ে লড়াই। কিন্তু এ েেত্র মতা নিয়ে লড়াই সব কথা নয়। বিএনপি বিশ্বাস করে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে, আওয়ামী লীগের মতো কোনো নিখিল বাঙালি জাতীয়তাবাদে নয়। বিএনপি কোনো বাম রাজনীতি করে না। বিএনপির রাজনৈতিক আদর্শ নয় সমাজতন্ত্র। বিএনপি বিশ্বাস করে মিশ্র অর্থনীতিতে। এ দল বিশ্বাস করে উদার গণতন্ত্রে। জিয়া মতায় আসার পর দেশে যে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায়, তার ফলে নতুন করে শুরু হতে পেরেছিল আওয়ামী লীগের রাজনীতি। জিয়ার গঠিত বিএনপি চায়নি আওয়ামী লীগের বিলুপ্তি। কিন্তু বর্তমান আওয়ামী লীগের প্রবণতা হলো এক দলের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা। আর সেই সাথে বিএনপির বিলুপ্তি। বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে তাই বলা চলে না একই রকম রাজনৈতিক দল। বিএনপি পরিচালিত হচ্ছে না প্রগতিবাজদের দ্বারা।
আওয়ামী লীগ রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে খুব হইচইয়ে মেতে উঠেছে। আওয়ামী লীগের বক্তব্য, রবীন্দ্রনাথ হলেন ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সেতুবন্ধ। আর তাই দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নে রবীন্দ্র চিন্তা-চেতনা হলো অন্যতম চাবিকাঠি। এ দেশের প্রগতিবাজরা প্রমাণ করতে চেষ্টা করছেন যে, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন প্রগতিশীল চিন্তার ধারক ও বাহক। রবীন্দ্র ভাবধারা তাই হতে পারে আমাদের চিন্তার প্রসারতা প্রদানে বিশেষ সহায়ক।’ কিন্তুু রবীন্দ্র চিন্তা-চেতনা কি সত্যিই প্রগতিশীল ছিল? কী অর্থে তাকে বলতে হবে প্রগতিশীল? কারণ রবীন্দ্র কাব্যে ধ্বনিত হয়েছে হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদী চিন্তা-চেতনা। রবীন্দ্রনাথ তার কবিতায় মানুষকে ফিরতে বলেছেন, বেদ-উপনিষদের যুগে। এর মধ্যে প্রগতিশীল ভাবধারার পরিচয় কোথায়? রবীন্দ্রনাথ বাইরের বিশ্বে ভারতীয় কবি হিসেবে পরিচিত, বাংলাদেশের কবি হিসেবে নন, যদিও তিনি লিখেছেন বাংলা ভাষায়। রবীন্দ্র কাব্যের কোথাও নেই বাংলা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের কথা; যেমন বাংলা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের পরিচয় আমরা পেতে পারি মাইকেল মধুসূদন দত্তের সনেটে। কোনো কবিকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উৎস হিসেবে চিহ্নিত করতে হলে মাইকেল মধুসূদনকে করা যেতে পারে; রবীন্দ্রনাথকে নিশ্চয় নয়। শেখ হাসিনা তার একটি সাম্প্রতিক বক্তৃতায় বললেন, রবীন্দ্রনাথ নাকি বাঙালির অনুভব-উপলব্ধির শিকড়ে প্রোথিত। কিন্তু আমার মনে পড়ে ১৯৭১ সালের কথা। এ সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার চেয়ে এ দেশের মানুষকে জীবনানন্দ দাশের কবিতা বেশি পড়তে দেখেছি। এ সময় জীবনানন্দ দাশ হয়ে উঠেছিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিশেষ প্রেরণার স্থল। এখন শুধু রবীন্দ্রনাথকে সামনে এনে আর সব বাংলা সাহিত্যিককে যেন উপো করা হচ্ছে। এটাকে মোটেও বাঞ্ছিত বলা যায় না। রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাবের আগেই বাংলা সাহিত্য হাঁটতে আরম্ভ করেছিল। রবীন্দ্রনাথের আগেই জন্মেছেন মাইকেল মধুসূদনের মতো কবি। আবির্ভাব ঘটেছে বঙ্কিম ও সঞ্জীবচন্দ্রের মতো প্রাঞ্জল বলিষ্ঠ গদ্য লেখকের। রবীন্দ্রনাথ বাংলা গদ্যের জনক নন।
রবীন্দ্রনাথকে বলা হচ্ছে ‘অসাম্প্রদায়িক’। রবীন্দ্রনাথ কতটা অসাম্প্রদায়িক ছিলেন, তা জানি না। রবীন্দ্রনাথের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার বোলপুরে ২০ বিঘা জমি কিনে সেখানে একটা একতলা বাড়ি বানান। তিনি বাড়িটির নাম দেন- শান্তি নিকেতন। রবীন্দ্রনাথ এখানে ১৯০১ সালে ব্রাহ্মচর্চার আশ্রম এবং একটি আবাসিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন। এই বিদ্যালয়ে কোনো মুসলমান ছাত্রের পড়ার অধিকার ছিল না। পরে রবীন্দ্রনাথ এখানে প্রতিষ্ঠা করেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। এতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়। তিনি এর জন্য চাঁদা চান ভারতের বিভিন্ন দেশীয় রাজার কাছ থেকে। হায়দরাবাদের নিজাম প্রদান করেন এক লাখ টাকা। এক লাখ টাকা তখন ছিল অনেক টাকা। এরপর রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতীতে কিছু মুসলমান ছাত্রের পড়ার ব্যবস্থা করেন। যে ক’জন মুসলিম ছাত্র বিশ্বভারতীতে পড়ার সুযোগ পান, তাদের মধ্যে একজন হলেন সৈয়দ মুজতবা আলী। হায়দরাবাদের নিজাম যদি চাঁদা না দিতেন তবে বিশ্বভারতীতে মুসলমান ছাত্র পড়ার ব্যবস্থা আদৌ হতো বলে মনে হয় না। কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবার ছিলেন খুবই অত্যাচারী জমিদার। রবীন্দ্রনাথকেও বলা যায় না এর ব্যতিক্রম। রবীন্দ্রনাথ কখনো চাননি জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ করা হোক। তিনি মনে করতেন, জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ করা হলে তার পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর পড়বেন আর্থিক দুরবস্থার মধ্যে। রবীন্দ্রনাথ বিরোধিতা করেছেন জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের। এ দিক থেকেও তাকে বলা চলে না প্রগতিশীল। জমিদার হিসেবে তার খুব সুখ্যাতি ছিল না। তিনি গরিব কৃষক প্রজার খাজনার টাকায় ভ্রমণ করেছেন পৃথিবীর নানা দেশ। অথচ তার নিজের প্রজাদের জন্য করেননি বিশেষ কিছুই। রবীন্দ্রনাথের জমিদারি ছিল নওগাঁ জেলার আত্রাই থানায়। এই থানার পতিসর নামক স্থানে ছিল রবীন্দ্রনাথের জমিদারির তহশিল ও কুঠিবাড়ি। তহশিলে যারা কাজ করতেন তারা প্রজাদের থেকে আদায় করেছেন বেআইনি বাড়তি খাজনা বা আবওয়াব এবং নজরানা। আমি পতিসরে অনেকবার গিয়েছি। ওই অঞ্চলের প্রধান ব্যক্তিদের কাছে শুনেছি নানা কথা। রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ির ঠিক পেছনে আছে একটি বড় দীঘি। এই দীঘিতে কোনো মুসলমান গোসল করতে পারত না। কারণ, মনে করা হতো মুসলমান ওই দীঘিতে গোসল করলে দীঘির পানি অপবিত্র হবে। পতিসরের তহশিলে মুসলমান কৃষক প্রজাদের খাজনা দিতে হতো দাঁড়িয়ে থেকে; তাদের বসার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। শুনেছি, অনেক পরে রবীন্দ্রনাথ এদের বসার একটা ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু সেটা অনেক পরে। আজ তবু রবীন্দ্রনাথকে বলা হচ্ছে আমাদের জাতীয় চেতনার উৎসস্থল হিসেবে। এর আদৌ কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। বাংলার মুসলমান সমাজ রবীন্দ্র চিন্তা-চেতনার দ্বারা কোনোভাবেই প্রভাবিত হয়নি। বাংলাভাষী মুসলমানের মধ্যে সর্বপ্রথম সুন্দর বাংলা গদ্য লিখেছিলেন মীর মশারফ হোসেন (১৮৪৭-১৯১১)। মীর মশারফ হোসেন বাংলা গদ্য লিখতে শিখেন কুষ্টিয়া থেকে প্রকাশিত ‘গ্রামবার্তা’ নামক প্রত্রিকার সম্পাদক কাঙাল হরিনাথের কাছ থেকে। কাঙাল হরিনাথ রবীন্দ্রনাথের পিতার সমালোচনা করেন কৃষক প্রজার ওপর অত্যাচারের কারণে। রবীন্দ্রনাথের পিতা কাঙাল হরিনাথকে খুন করার জন্য গুণ্ডা নিয়োগ করেন। কিন্তু হরিনাথের পে বিপুল জনসমর্থন থাকায় রবীন্দ্রনাথের পিতার এই উদ্দেশ্য সফল হতে পারেনি। এটা ঠাকুর পরিবারের জন্য হয়ে আছে বিশেষ কলঙ্কজনক ইতিহাস।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম আরম্ভ হয় ১৯২১ সালের জুলাই মাস থেকে। এর কয়েক মাস আগে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার পি জি হার্টগ সাহেবকে নিয়ে আসা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি করে। এই বিশ্ববিদ্যালয় গঠিত হয় কতকটা বিলাতের লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুকরণে। এর চালচলন ছিল বিলাতি। কিন্তু বাংলাভাষী হিন্দুরা সব সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বলতে চেয়েছেন মুসলমান প্রভাবিত বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে। যেটা মোটেও সত্য নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহর ছিল বিশেষ অবদান। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য দান করেছিলেন অনেক জমি। কিন্তু তিনি মারা যান ১৯১৫ সালে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে পূর্ববাংলার মুসলমান সমাজে একটি শিতি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আবির্ভাব হতে থাকে। তাদের প্রভাবে বাংলাভাষী মুসলমান সমাজে আসা সম্ভব হয় একটা বিশেষ মানসিক জাগরণ। বিশ্বভারতীর সাথে সে জাগরণের কিছুমাত্র সম্পর্ক নেই। বিশ্বভারতীর কর্মকাণ্ড আরম্ভ হয় ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্বভারতীর মধ্যে তুলনা করতে গিয়ে ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার মহাশয় লিখেছেনÑ‘১৯২২ সাল হইতে ১৯৪৭ সালের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক ও ছাত্রসমাজ যে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়াছেন তাহার সহিত তুলনা করিলে ঐ সময়ের মধ্যে বিশ্বভারতীর কৃতিত্ব এ বিষয়ে নগণ্য বলিলে বিশেষ অত্যুক্তি হইবে না।... কেবল চিত্রকলা ও নৃত্যগীত অনুষ্ঠানকে ইহার ব্যতিক্রম বলা যায়। এই দুই বিষয়ে বিশ্বভারতীর অবদান অনস্বীকার্য।’ (বাংলাদেশের ইতিহাস; চতুর্থ খণ্ড)। কিন্তু আজ আওয়ামী লীগের তথাকথিত প্রগতিবাজরা বোঝাতে চাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথের জন্য সৃষ্টি হতে পেরেছে বাংলাভাষী মুসলমান মানসে বিরাট জাগরণ। যেটাকে ঐতিহাসিক সত্য বলে স্বীকার করা যায় না। বাংলাভাষী মুসলমানের জাগরণে বিশ্বভারতী কোনো অবদান রাখেনি; অবদান রেখেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ইতিহাসে অনেক কিছু ঘটে যার ব্যাখ্যা করা সহজ নয়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়র্দী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আওয়ামী মুসলিম লীগ। আম শব্দটা আরবি ভাষার। শব্দগত অর্থে জনগণ। পরে ১৯৫৫ সালে সোহরাওয়ার্দী সাহেব আওয়ামী মুসলিম লীগের জায়গায় দলটির নাম করেন আওয়ামী লীগ। তিনি ‘মুসলিম’ কথাটি উঠিয়ে দেন। আওয়ামী লীগকে তিনি প্রতিষ্ঠিত করতে চান সাবেক পাকিস্তানের একটি দল হিসেবে, যার ল্য হবে পাকিস্তানকে গণতান্ত্রিক কল্যণব্রতী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা। এ দিক থেকে তিনি বেশ কিছুটা প্রভাবিত হন ব্রিটিশ লেবার পার্টির চিন্তা-চেতনার দ্বারা। কিন্তু তার চিন্তা-চেতনা কখনোই কঠোর বামপন্থী ছিল না অথবা হয়নি। জুলফিকার আলী ভুট্টোর পিতা স্যার শাহনেওয়াজ ভুট্টো ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ব্যক্তিগত বন্ধু। হোসেন শহীদ সোহরাওয়র্দী এক দিন সিন্ধুতে শাহনেওয়াজ সাহেবের বাড়িতে গিয়ে বলেন তার পুত্র জুলফিকার আলী ভুট্টোকে আওয়ামী লীগে যোগ দিতে। কিন্তু ভুট্টোর পিতা বলেন, তিনি তার পুত্রকে রাজনীতির দিকে প্রভাবিত করতে পারেন না। তার পুত্রকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, সে রাজনীতিতে সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সাথে হাত মিলাবে কি না। ভুট্টোকে সোহরাওয়ার্দী সাহেব খুব পছন্দ করতেন। ১৯৫৭ সালে সোহরাওয়ার্দী সাহেব প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় জুলফিকার আলী ভুট্টোকে জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে পাকিস্তানের প্রতিনিধিদলের অন্যতম সদস্য হিসেবে প্রেরণ করেন। জুলফিকার আলী ভুট্টোর তখন বয়স ছিল মাত্র ২৯ বছর। ১৯৬৭ সালে ভুট্টো গড়েন তার নিজস্ব রাজনৈতিক দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি। কেউ তখন ভাবতে পারেননি পিপলস্ পার্টি আর আওয়ামী লীগের মধ্যে সৃষ্টি হবে বিরাট রাজনৈতিক বিরোধ; যার ফলে ভেঙে পড়বে সাবেক পাকিস্তান। সাবেক পাকিস্তান ভেঙে দেয়ার কোনো ইচ্ছা সোহরাওয়ার্দী সাহেবের ছিল না। শেখ মুজিবেরও যে ছিল, এ রকম ভাবার কোনো কারণ নেই। সোহরাওয়ার্দীর শিষ্য কী করে পরে মণিসিংহদের প্রভাবে পড়ে বাকশাল গঠনের কথা ভাবতে পেরেছিলেন সেটার ব্যাখ্যা করা মনে হয় খুবই কঠিন। কিন্তু আওয়ামী লীগ এখনো আটকা পড়ে আছে একদলীয় বাকশালী চিন্তা-চেতনার দ্বারা। আর তারা এখন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নীতি ও আদর্শের কথা ভুলেও চাচ্ছেন না আলোচনা করতে। নিচ্ছেন না তার নাম। 
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

রবিবার, ১৩ মে, ২০১২

বাংলাদেশে মে দিবস

বাংলাদেশে মে দিবস


আত্মপক্ষ

॥ এবনে গোলাম সামাদ ॥

শ্র মিকেরা অনেক দেশেই তাদের কাজের পরিবেশ, প্রতিদিন কাজের সময়ের পরিমাণ এবং মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন করেছেন এবং এখনো করছেন। এসব আন্দোলনের ফলে ঘটতে পেরেছে তাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন। সৃষ্টি হতে পেরেছে মালিক প ও শ্রমিক পরে মধ্যে সম্পর্কের মসৃণতা, যা আগে ছিল না। শ্রমিকরা এখন উপলব্ধি করতে পারছেন, ইচ্ছামতো ধর্মঘট করে মজুরি বৃদ্ধি করে চলা সম্ভব নয়। কারণ মজুরি বৃদ্ধি করতে হলে বাড়ে উৎপাদিত পণ্যের দর। উৎপাদিত পণ্যের দর বাড়লে ক্রেতার পে তা কেনা হয়ে দাঁড়ায় কঠিন। ক্রেতার অভাবে বাজারে পণ্য পড়ে থাকে অবিক্রীত। তখন এর জন্য শেষ পর্যন্ত কলকারখানায় উৎপাদন থেমে যায়। কলকারখানা বন্ধ হলে শ্রমিকেরা হয়ে পড়তে থাকেন বেকার। বন্ধ হয়ে যায় তাদের জীবিকার উপায়। আমার বাড়ির সামনে দিয়ে মে দিবসের একটি মিছিল যাচ্ছিল। মিছিলকারীরা বলছিলেনÑ ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’। কিন্তু তাদের এই আওয়াজটা এখন হয়ে পড়েছে খুবই সেকেলে। আমরা চোখের ওপর দেখলাম বিরাট সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়তে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার অনেক কারণ আছে। তার মধ্যে একটি হলো জাতিসত্তার সঙ্ঘাত। রুশ শ্রমিক আর কাজাখ শ্রমিকের মধ্যে ঐক্য ঘটা সম্ভব হলো না। ঐক্য ঘটা সম্ভব হলো, না সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ১৫টি রিপাবলিকের শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে। দুনিয়ার মজদুর এক হও, এই আওয়াজ এখন তাই মনে হচ্ছে অন্তঃসারশূন্য। মানুষ পৃথিবীতে বাস করছে কেবল শ্রমজীবী হিসেবে নয়। বাস করছে বিভিন্ন জাতিরাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে; যা বিশ্বরাজনীতিকে করছে নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু আমাদের দেশে বাম রাজনীতিকেরা এই সহজ বাস্তবতাকে যেন উপলব্ধি করতে অপারগ। তাই তারা তুলতে পারছেন, দুনিয়ার মজদুর এক হওÑ এই দাবি। কিন্তু বর্তমান পৃথিবীতে প্রতিটি রাষ্ট্রকে তার অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান খুঁজে পেতে হবে আপন রাষ্ট্রিক সীমানার মধ্যেই। প্রতিটি জাতির অর্থনৈতিক সমস্যা হলো তার নিজের সমস্যা। আন্তর্জাতিকভাবে এখনো এর সমাধান আসছে না। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে ১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে শিকাগো শহরের হে মার্কেট স্কয়ার নামক জায়গার কোনো কারখানায় শ্রমিকেরা ধর্মঘট করছিলেন। প্রতিদিন ৮ ঘণ্টার বেশি শ্রমিকদের কাজ করানো যাবে না, এই দাবিতে। সেই সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ছিল না শ্রমিক ইউনিয়ন গঠনের অধিকার। ছিল না শ্রমিকদের ধর্মঘট করার অধিকার। তাদের ধর্মঘট ভাঙার জন্য শিকাগো শহরের ওই কারখানার মালিক প ভাড়া করে আনে গুণ্ডা, ডাকেন পুলিশ। ধর্মঘটরত শ্রমিকদের সাথে মালিক পরে ভাড়াটিয়া গুণ্ডাদের বাঁধে মারদাঙ্গা। এ সময় কেউ ছোড়েন একটা হাতবোমা। এর বিস্ফোরণে মারা যান সাতজন পুলিশ আর আহত হন অনেকে। এ ঘটনা নিয়ে আদালতে হয় মামলা। মামলার রায়ে চারজন শ্রমিক নেতার হয় প্রাণদণ্ড। এ চারজন ছিলেন অ্যানার্কিস্ট পার্টির সদস্য; যারা মনে করতেন, বল প্রয়োগের মাধ্যমে ধনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটাতে হবে। কিন্তু পরে জানা যায়, ওই অ্যানার্কিস্ট নেতারা বোমা ছোড়ার সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না। বোমা ছুড়েছিল মালিকপরে এজেন্ট। যুক্তরাষ্ট্রে এরপর শ্রমিকেরা পান বৈধভাবে শ্রমিক ইউনিয়ন গড়ার অধিকার। পেতে পারলেন তাদের দাবিদাওয়া পূরণের জন্য ধর্মঘটের অধিকার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শ্রমিকদের প্রতিদিন ৮ ঘণ্টার বেশি কাজ করানো হয় নিষিদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্রে শ্রমিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন অ্যানার্কিস্টরা। সেখানে সমাজতান্ত্রিকেরা কখনোই শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলনে কোনো বড় রকমের ভূমিকা পালন করেননি। কিন্তু ইউরোপে গড়ে ওঠা সমাজতন্ত্রীদের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক (The Second Socialist International) থেকে ১৮৮৯ সালে পয়লা মে-কে ঘোষণা করা হয় আন্তর্জাতিক শ্রমদিবস হিসেবে। ১৮৯০ সাল থেকে পয়লা মে প্রতি বছর পালিত হচ্ছে অনেক দেশেই আন্তর্জাতিক শ্রমদিবস হিসেবে। বাংলাদেশে পয়লা মে সরকারি ছুটি। আমরা সরকারিভাবে পালন করছি মে দিবস। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো কলকারখানার অর্থনীতি সেভাবে গড়ে ওঠেনি। বাংলাদেশ হয়ে আছে মূলত ুদ্র কৃষিজীবী মানুষের দেশ। এর অর্থনৈতিক সমস্যা, কলকারখানা সমৃদ্ধ ধনতান্ত্রিক দেশ থেকে অনেক ভিন্ন। মে দিবস উদযাপন তাই এ দেশে অর্থবহ নয়।
বাংলাদেশ থেকে এখন বহু মানুষ যাচ্ছেন বিদেশে। তারা বিদেশে কাজ করছেন শ্রমজীবী হিসেবে। কিন্তু তাদের নেই কোনো শ্রমিক ইউনিয়ন গড়ার অধিকার। তাদের খাটতে হচ্ছে প্রতিদিন ৮ ঘণ্টার অনেক বেশি। কাজ করতে হচ্ছে ব্যাপক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়; অনেক েেত্র যাকে বলে, প্রাণ হাতে নিয়ে। তারা বিদেশে কাজ করে দেশে আনছেন বৈদেশিক মুদ্রা। কিন্তু তা লাগছে না এ দেশে সেভাবে পুঁজি গঠনের কাজে। এরা বিদেশে অর্জিত অর্থ দিয়ে চড়া দামে কিনছেন জমি। অনেক ুদ্র কৃষক এদের কাছে চড়া দামে জমি বিক্রি করে শেষ পর্যন্ত পরিণত হচ্ছেন তেমজুরে। এর ফলে গ্রামীণ জীবনে বাড়ছে হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যা। আমাদের জমির পরিমাণ সীমিত। ধান ও পাট একই রকম জমিতে উৎপন্ন হয়। ব্রিটিশ শাসনামলে আইন করে পাট চাষ কমানো হয়েছিল। কারণ পাট উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে ধান উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছিল জমির অভাবে। পাট চাষ এখন আর এ দেশে লাভজনক নয়। বরং লাভজনক হয়ে উঠেছে ফল চাষ। কিন্তু ফল চাষ করতে গিয়ে কমছে ধানের আবাদ। এতে বাড়ছে আমাদের খাদ্য সমস্যা। কারণ ধান এখনো আমাদের মূল খাদ্যশস্য। আমাদের কৃষিতে অন্য রকম সমস্যাও প্রবল হয়ে উঠেছে। ক’দিন আগে কথা হচ্ছিল একজন কৃষিবিদের সাথে। তিনি আমাকে বলছিলেন বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির েেত্র বৈজ্ঞানিক গবেষণার অগ্রগতির কথা। তার বক্তব্য আমার ভালো লাগছিল। বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলে কৃষি উৎপাদন বাড়ছে। কিন্তু এই কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, কৃষিতে সৃষ্টি করছে সমস্যা। কৃষিপণ্যের পড়ে যাচ্ছে বাজারদর। কৃষক হচ্ছেন তিগ্রস্ত। কৃষিপণ্যের বাজারদর ঠিক রাখা আগের চেয়ে হয়ে উঠছে অনেক বড় রকমের সমস্যা। আগে আমাদের দেশে অনেক জাতের ধান ছিল, যা অনেক কম খরচে আবাদ করা যেত। এসব ধানের ফলন ছিল কম। কিন্তু সেই সাথে উৎপাদনের খরচও ছিল অনেক কম। আমরা বর্তমানে আবাদ করছি উচ্চফলনশীল জাতের ধান। এতে আবাদের খরচা পড়ছে অনেক বেশি। লাভতির হিসাব করে দেখা যাচ্ছে অনেক েেত্রই কৃষক হচ্ছেন তিগ্রস্ত। যেমন, এখন আমাদের দেশের উত্তরাঞ্চলে এক মণ উচ্চফলনশীল ধান উৎপাদন করতে খরচ পড়ছে গড়পড়তা ৬০০ টাকার কাছাকাছি। কিন্তু হাটে বাজারে কৃষককে ধান বিক্রি করতে হচ্ছে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা মণদরে। কৃষক পারছেন না ধান উৎপাদন করে লাভবান হতে। বলা হচ্ছে, সরকারকে ধান কিনে ধানের বাজারদর ঠিক রাখতে হবে। কিন্তু সরকারের টাকা আসে ট্যাক্সের টাকা থেকে। কৃষিপণ্যে ভর্তুকি দিতে গেলে সবার ওপর বাড়বে বাড়তি করের বোঝা। আমাদের অর্থনৈতিক সমস্যা হয়ে উঠেছে খুবই জটিল। ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ বলে এই সমস্যার সমাধান আনা সম্ভব হবে না। আমার মনে পড়ে, ১৯৬০-এর দশকের কথা। এ সময় আমাদের একজন খ্যাতনামা রাজনৈতিক নেতা বলেছিলেনÑ ‘ভোটের আগে ভাত চাই’। জানি না, ‘ভোট’ ও ‘ভাত’কে এ রকম পরস্পরবিরোধী ভাবার কী যুক্তি ছিল তার।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শ্রমজীবী জনসাধারণ কোনো দিনই চাননি তাদের দেশ থেকে গণতন্ত্রের বিলুপ্তি। এটা হতে পারে আমাদের অন্যতম শিণীয় বিষয়। যুক্তরাষ্ট্রের ছিল এবং আছে বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ। যুক্তরাষ্ট্রে গ্রেট ব্রিটেন থেকে যাওয়া সাদা মানুষ ব্যবহার করেছেন ব্রিটিশ প্রযুক্তি। ফলে অর্থনীতিতে আসতে পেরেছে কলকারখানার বিপ্লব। মার্কিন অর্থনীতিতে সামান্য ব্যক্তিও অনেক সহজে হতে পেরেছেন ধনী। সে দেশে এভাবে মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের সুযোগ থাকায় শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলন সাধারণভাবে থেকেছে কম সঙ্ঘাতময় হয়ে। যুক্তরাষ্ট্রে শ্রেণী সংগ্রামের দর্শন সেভাবে পেতে পারেনি প্রাধান্য। সেখানে এখন শ্রমজীবী ও অন্যান্য পেশাজীবী মানুষের ইউনিয়নগুলো হয়ে উঠেছে খুবই শক্তিশালী। এসব ইউনিয়ন ইচ্ছা করলে পারে ধর্মঘট করে তাদের দাবি আদায়ের জন্য চাপ সৃষ্টি করতে। কিন্তু মার্কিন ইউনিয়নগুলো এ রকম কিছু করতে চান না। যুক্তরাষ্ট্রে যদি প্রেসিডেন্ট মনে করেন, শ্রমিক ও বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের সাধারণ ধর্মঘট সে দেশের অর্থনীতিকে নিয়ে যেতে পারে বিশেষ বিপর্যয়ের মধ্যে, তবে তিনি সে েেত্র আইনত পারেন ধর্মঘট স্থগিত করার আদেশ দিতে। কিন্তু এ রকম আদেশ দেয়ার প্রয়োজন এখনো পড়েনি যুক্তরাষ্ট্রে সব পেশার মানুষ ইচ্ছা করলেই পারেন ধর্মঘট করতে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারীরা কখনোই পারেন না ধর্মঘট করে দাবিদাওয়া আদায় করতে। কারণ তাদের েেত্র ধর্মঘট করা নিষিদ্ধ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শ্রমিক ও অন্যান্য পেশাজীবী মানুষের ইউনিয়নকে থাকতে হয় রাজনৈতিক দল থেকে বিযুক্ত। কোনো ইউনিয়ন পারে না কোনো রাজনৈতিক দলকে চাঁদা প্রদান করতে। পান্তরে কোনো রাজনৈতিক দল পারে না কোনো ইউনিয়নের সাথে নিজেকে যুক্ত করতে। যুক্তরাষ্ট্রে শ্রমজীবী ও পেশাজীবী মানুষের গড়া ইউনিয়নগুলো তাই থাকে রাজনৈতিক দলের প্রভাবমুক্ত হয়ে। এটাও হতে পারে আমাদের শিণীয় বিষয়। কিন্তু বাংলাদেশে মে দিবস উদযাপিত হয়েছে এবং হচ্ছে বিশেষভাবে বামপন্থী নেতাদের নেতৃত্বে। এই বাম নেতারা এখনো ভাবছেন শ্রেণিসংগ্রামের মাধ্যমে অর্থনৈতিক জীবনে বিপ্লব ঘটানোর কথা। কিন্তু তাদের এই শ্রেণী সংগ্রামের ধারণা আর আমাদের দেশের বাস্তব অর্থনৈতিক অবস্থা কোনোভাবেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়। বাম রাজনীতি বিদেশে বেশ রদ্দি হয়ে উঠেছে। কিন্তু এ রাজনীতি আমাদের দেশে আওয়ামী লীগকে এখনো করছে প্রভাবিত। এটা হয়ে উঠেছে আমাদের দেশের বর্তমান রাজনীতিতে একটা বিশেষ সমস্যা।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

রবিবার, ২৯ এপ্রিল, ২০১২

পররাষ্ট্রনীতিতে বাংলাদেশ



২০১২-০৪-৩০

বিশ্বের কোনো দেশেরই ভবিষ্যৎ এখন আর কেবল তার নিজের দেশের ঘটনাবলির প্রবাহ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না। বিদেশের ঘটনাবলির প্রভাব এসে পড়ে তার ওপর। যুদ্ধ ভালো নয়। কিন্তু তবু এখনো যুদ্ধ হচ্ছে পৃথিবীর নানা দেশে নানা অঞ্চলে। এক দেশ আর এক দেশের সাথে জড়িয়ে পড়ছে যুদ্ধে। যুদ্ধের অবসান ঘটানোর জন্য গঠিত হয়েছিল জাতিসঙ্ঘ ১৯৪৫ সালে। কিন্তু জাতিসঙ্ঘ যুদ্ধ বন্ধ করতে পারেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাতিসঙ্ঘকে অগ্রাহ্য করেই আক্রমণ করল ইরাককে। আর ইরাকে এখনো প্রতিদিন হচ্ছে লোকয়। যুদ্ধ চলেছে আফগানিস্তানে। যুদ্ধের হুমকি দেয়া হচ্ছে ইরানকে। সব মিলিয়ে বিশ্বপরিস্থিতি হচ্ছে জটিল থেকে জটিলতর। আমরা একটা নিরাপদ বিশ্বে বাস করছি না। ধনী-দরিদ্র সব দেশেই সামরিক খাতে ব্যয় বাড়িয়ে চলেছে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কেবল তার ঘরোয়া রাজনীতি দ্বারা নিরূপিত হবে না। নিরূপিত হবে বিশ্বপরিস্থিতির ওপর, আর এই বিশ্বপরিস্থিতির বিশ্লেষণ করে গৃহীত হতে হবে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি। মনে হচ্ছে বিশ্ব পরিস্থিতি বিশ্লেষণে থাকছে আমাদের চিন্তায় যথেষ্ট ঘাটতি। আমরা বিশ্বপরিস্থিতির অনেকগুলো দিককে যেন নিতে চাচ্ছি না আমাদের বিবেচনায়। আমরা অনেক সমস্যাকে করে ফেলতে চাচ্ছি খুবই সরল। যা হয়ে উঠতে পারে আমাদের জন্য বিপজ্জনক। সম্প্রতি লন্ডনে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি বলেছেনÑ ভারত আর বাংলাদেশের ভাগ্য নাকি এক সূত্রেই গাঁথা। আর তাই তার পররাষ্ট্রনীতিও হতে হবে অভিন্ন। তিনি আরো বলেছেনÑ বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক এখন হয়ে উঠেছে খুবই ঘনিষ্ঠ। যেমন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল ১৯৭১ সালে। কিন্তু ১৯৭১ সালে কলকাতায় অবস্থিত তাজউদ্দীন সরকারের কোনো স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি ছিল না। তাকে অনুসরণ করে চলতে হচ্ছিল ভারত সরকারের নির্দেশ। তাই প্রশ্ন উঠছে বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের অবস্থা কি দাঁড়িয়েছে ১৯৭১ সালের তাজউদ্দীন সরকারেরই মতো। বাংলাদেশ সরকার না ভারত সরকার, প্রকৃত প্রস্তাবে কে নিয়ন্ত্রণ করছে এ দেশের পররাষ্ট্রনীতি?

আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লন্ডনে ভারতীয় সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেছেনÑ তিন বছরে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর মাঝারি পর্যায়ের কর্মকর্তারা নাকি ১৯ বার সেনা অভ্যুত্থানের চেষ্টা চালিয়েছেন। কিন্তু তারা সফল হতে পারেননি। বাংলাদেশ আছে সেনা অভ্যুত্থানের ঝুঁকির মধ্যে। যদি তিনি এ কথা সত্যি বলে থাকেন তবে সেটা কতটা সমীচীন হয়েছে তা নিয়ে থাকছে প্রশ্ন। বিদেশে দেশের ভেতরকার এই দুর্বলতাকে প্রকাশ করা দীপু মনির রাজনৈতিক পরিপক্বতার পরিচয় বহন করছে না। তিনি যেন চেয়েছেন ভারতের প্রিয়পাত্র হতে। যেটা এ দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য অবমাননাকর। কিন্তু দীপু এসব কথা বলে যেন চেয়েছেন তৃপ্তি পেতে। ভারত ও আমাদের স্বার্থ একসূত্রে গাঁথা নয়। চীন ও ভারতের মধ্যে বিরাজ করছে বিরাট সীমান্ত বিরোধ। বিরাজ করছে এশিয়ায় পরাশক্তি হওয়া নিয়ে প্রতিযোগিতা। কিন্তু বাংলাদেশের সাথে চীনের কোনো সীমান্ত বিরোধ নেই। আর পরাশক্তি হওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। কী করে বাংলাদেশ ও ভারতের স্বার্থ অভিন্ন হতে পারছে সেটা আমাদের কাছে মোটেও তাই স্বচ্ছ হতে পারছে না। আর স্পষ্ট হতে পারছে না বর্তমান বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক অনুসৃত পররাষ্ট্রনীতি। আওয়ামী লীগ দাবি করছে যে, সে অনুসরণ করে চলেছে শেখ মুজিবের অনুসৃত পররাষ্ট্রনীতি। কিন্তু শেখ মুজিব ঠিক কী চেয়েছিলেন সেটাও আমাদের কাছে এখনো হয়ে আছে যথেষ্ট বিভ্রান্তিকর। ১৯৭১ সালে শেখ মুজিব ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে। এ সময় তিনি কী ভেবেছিলেন তা আমরা জানি না। শেখ মুজিব পাকিস্তানের কারাগার থেকে ছাড়া পান ১৯৭২ সালের ৩ জানুয়ারি। এরপর তিনি ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের বিশেষ বিমানে করে যান লন্ডনে। সেখানে তিনি তদানীন্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হিথের সাথে আলোচনা করেন। তিনি কেন পাকিস্তান থেকে লন্ডনে যাওয়ার ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলোচনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন সে সম্পর্কে এখনো কিছু জানা যায় না।

আমি এ সময় ছিলাম কলকাতায়। কলকাতায় গুজব রটেছিল, শেখ মুজিব নাকি জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাথে একটি বিশেষ চুক্তি করেছিলেন। যাতে বাংলাদেশ ও বর্তমান পাকিস্তান হতে যাচ্ছে একটা কনফেডারেশন বা রাষ্ট্র সমবায়। এ কথা কত দূর সত্য তা আমরা বলতে পারি না। কিন্তু ভারতীয় বুদ্ধিজীবী মহলে এ নিয়ে সৃষ্টি হয়েছিল যথেষ্ট উদ্বেগ। শেখ মুজিব বাংলাদেশে ফিরে ১২ জানুয়ারি (১৯৭২) বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করেন। প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করার পর তিনি যোগ দেন ইসলামি সম্মেলন সংস্থায়। এ উপলে তিনি যান পাকিস্তানে। তিনি মতায় আসার পর কার্যত চাননি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। বাংলাদেশে যারা পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিল অথবা চাননি সাবেক পাকিস্তান ভেঙে যাক, তিনি চাননি তাদের বিচার করতে। কার্যত তিনি এ েেত্র প্রদর্শন করেছিলেন সাধারণ মার মনোভাব। ১৯৭৪ সালে তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টোকে বাংলাদেশ সফর করার জন্য আমন্ত্রণ জানান। ভুট্টো তার আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে আসেন বাংলাদেশে। এ থেকে মনে করা যায় যে, শেখ মুজিব চেয়েছিলেন, পাকিস্তানের সাথে বিশেষ মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ হতে। যদিও তিনি ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণে জুলফিকার আলী ভুট্টো সম্পর্কে করেছিলেন বিরূপ মন্তব্য। বর্তমান আওয়ামী লীগ চাচ্ছে না পাকিস্তানের সাথে কোনো প্রকার সুসম্পর্ক গড়তে। বরং চাচ্ছে পাকিস্তানবিরোধী কথা বলে এ দেশের মানুষের কাছে জনপ্রিয় হতে। কিন্তু ১৯৭১ সালের পরিস্থিতি আর বর্তমান পরিস্থিতি এক নয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষ ভারতকে যতটা বন্ধু ভেবেছে, এখন আর তা ভাবতে পারছে না। কিন্তু এই সহজ সত্যটাকে যেন আওয়ামী লীগের নেতারা উপলব্ধি করতে পারছেন না। আর তাই হয়ে পড়ছেন গণবিচ্ছিন্ন।

আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি পরম রবীন্দ্রভক্ত। গোটা আওয়ামী লীগ এখন রবীন্দ্রনাথের মধ্যে খুঁজে পেতে চাচ্ছে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বুনিয়াদ। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আর যা-ই হোন বাঙালি জাতীয়তাবাদী ছিলেন না। তিনি চাননি বাংলা ভাষাভিত্তিক কোনো পৃথক স্বাধীন দেশ গড়তে। তিনি আস্থাশীল ছিলেন অখণ্ড ভারতে। আর চেয়েছিলেন বাংলা বা অন্য কোনো ভাষা নয়, হিন্দি হতে হবে ভারতের একমাত্র রাষ্ট্র অথবা যোগাযোগ রার ভাষা। শেখ মুজিব ঠিক এ রকম রবীন্দ্রভক্তি প্রদর্শন করেননি। রবীন্দ্রনাথ তার মনমানসিকতায় প্রতিভাত হননি গুরুদেব হিসেবে। এ জন্যই তিনি অসুস্থ কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ভারত থেকে স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। রবীন্দ্রনাথকে নয়, তিনি নজরুলকেই প্রতিষ্ঠিত করেন বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবে। কিন্তু নজরুলকে অবহেলা করে বর্তমান আওয়ামী লীগ ভারতকে খুশি করার জন্য শুরু করেছে যেন রবীন্দ্রপূজা। যে রকম রবীন্দ্রপূজা এখন আর ভারতেও নেই। রবীন্দ্রনাথকে তারা চাচ্ছে বস্তুনিষ্ঠভাবে মূল্যায়ন করতে। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যের একটা বিরাট অংশকে ভারতে বলা হচ্ছে আসলে অনুবাদ সাহিত্য। রবীন্দ্রনাথের একাধিক ছোটগল্পে রয়েছে মার্কিন গল্প লেখক এডগার এলেন পোর প্রভাব। কবিতায় রয়েছে একাধিক ইংরেজ কবির লেখার ছায়া। উপন্যাসে পড়েছে গলস্ওয়ার্থ (J Galsworthy)-এর মতো লেখকের প্রভাব। রবীন্দ্রনাথের স্বকীয়তা নিয়ে এখন সৃষ্টি হতে পেরেছে যথেষ্ট সমালোচনা। রবীন্দ্রনাথ গীতাঞ্জলির জন্য ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তার এই ইংরেজি অনুবাদে থেকেছে বিলাতের কবি ইয়েটসের প্রভাব। ইয়েটস তার কবিতাগুলোর ইংরেজি অনুবাদকে করেছিলেন সম্পাদনা। দিয়েছিলেন তার বর্তমান রূপ। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি গীতাঞ্জলি বহন করে না কেবলই রবীন্দ্রপ্রতিভার পরিচয়। এসব কথা এখন বিশেষভাবে বলছেন ভারতীয় রবীন্দ্র সমালোচকরা। কিন্তু আমরা করছি রবীন্দ্রপূজা। দেখাচ্ছি রবীন্দ্রভক্তি। রবীন্দ্রনাথের গান আমাদের ভালো লাগে। কিন্তু এই গানেও আছে ইউরোপীয় গানের প্রভাব।

বাংলা গানে প্রথম ইউরোপীয় গানের প্রভাব বহন করে আনেন দ্বীজেন্দ্রলাল রায়। দ্বীজেন্দ্রলাল রায় রচিত ও সুরারোপিত গান ‘ধন ধান্য পুষ্পে ভরা’কে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত করার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু ভারত সরকারের চাপে সেটা করা সম্ভব হয়নি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার বাংলা’ গানটিকে চাপিয়ে দেন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে। এই গানটি রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছিলেন ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের সময়। এর ল্য ছিল বঙ্গভঙ্গ রদ করা। এর ল্য ছিল না কোনো পৃথক স্বাধীন বাংলাদেশ গড়া। রবীন্দ্রনাথ ও ঠাকুর পরিবার একসময় ছিলেন খুবই ব্রিটিশভক্ত। রবীন্দ্রনাথ তার গীতাঞ্জলিতে ‘ভারততীর্থ’ কবিতায় বলেছেন, ইংরেজকে শুচিমন করে ভারত শাসন করতে, ছেড়ে যেতে নয়। একপর্যায়ে রবীন্দ্রনাথ বলতেন তিনি বিশ্বমানবতায় বিশ্বাস করেন। তিনি সর্বপ্রকার জাতীয়তাবাদের বিরোধী। এ নিয়ে এ দেশে যারা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন করছিলেন তাদের সাথে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি হয় ভাবগত বিরোধ। কবি নজরুল ব্রিটিশবিরোধী কবিতা লিখে জেল খেটেছেন। তার আগে ব্রিটিশ শাসনবিরোধী কবিতা লিখে জেল খেটেছেন ইসমাইল হোসেন শিরাজী। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কখনোই এ রকম কিছু লিখেননি। বরং তার বিখ্যাত ‘চার অধ্যায়’ উপন্যাসে যা লিখেছেন, তা হতে পেরেছে ব্রিটিশ কর্তৃপরে কাছে খুবই গ্রহণযোগ্য। শরৎচন্দ্রের উপন্যাস ‘পথের দাবি’ ইংরেজ আমলে নিষিদ্ধ হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ তখন বলেনÑ শরৎচন্দ্র এ রকম উপন্যাস লিখে ঠিক কাজ করেননি। এ হলো রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণার পরিচয়। কিন্তু এই রবীন্দ্রনাথকেই এখন আওয়ামী লীগ সরকার তুলে ধরতে চাচ্ছে বাঙালি জাতীয়তাবাদের অন্যতম অংশ হিসেবে। আর এটা জড়িয়ে পড়ছে তাদের পররাষ্ট্রনীতিরও সাথে। কারণ এর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ভাবছে ভারতের সাথে গড়ে উঠতে পারবে বিশেষ সুসম্পর্ক।

অনেক কিছুই ঘটছে দণি এশিয়ায়। ভারত নির্মাণ করছে এমন পেণাস্ত্র, যা চীনের রাজধানী বেইজিংকে আঘাত করতে পারবে পরমাণু বোমা বহন করে। অন্য দিকে পাকিস্তান নির্মাণ করতে সম হয়েছে এ রকম পেণাস্ত্র, যা পরমাণু বোমা বহন করে ভারতের যেকোনো অঞ্চলকে আঘাত করতে সম। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের অস্ত্রভাণ্ডারে পারমাণবিক অস্ত্র ছিল না। কিন্তু পাকিস্তান এখন নিজেই পারছে পরমাণু বোমা বানাতে। বাংলাদেশ সরকার পাকিস্তানকে সামরিক দিক থেকে যতটা দুর্বল মনে করছে পাকিস্তান তা নয়। পাকিস্তানের সাথে চীনের সামরিক সহযোগিতা বাড়ছে। চীন পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে ইতোমধ্যেই নির্মাণ করেছে নৌঘাঁটি। সম্প্রতি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন পাকিস্তান সফরে যাওয়ার। মনে হচ্ছে এর ফলে পাকিস্তান ও রাশিয়ার মধ্যে সামরিক সহযোগিতা বাড়বে। আর এর ফলে দণি এশিয়ায় ভারত পাকিস্তান সামরিক শক্তির অনুপাত আগের তুলনায় অনেক ভিন্ন হয়ে পড়বে। বর্তমান বাংলাদেশ সরকার এটা উপলব্ধি করতে পারছে কি না আমরা তা অবগত নয়। বর্তমান পাকিস্তান হচ্ছে ব্রিটিশ শাসনামলের সেসব অঞ্চল নিয়ে গঠিত যেখান থেকে ব্রিটিশ-ভারতের সেনাবাহিনীতে এসেছে অধিক সৈন্য। বর্তমান পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশের মানুষ হলেন অনেক রণনিপুণ (War-Like)। ১৯৭১ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে সাবেক পাকিস্তান বাহিনী হেরে যায়। এর কারণ ছিল তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ হয়ে উঠেছিল তাদের বৈরী। জনসমর্থনের অভাবেই তাদের হেরে যেতে হয়। কিন্তু এখন সেই অবস্থা আর বিরাজ করছে না। তথাপি আওয়ামী লীগ একাত্তরের কথা বিবেচনা করে গ্রহণ করতে চাচ্ছে পররাষ্ট্রনীতি। যেটাকে বলা যেতে পারে মূলগতভাবেই ভুল।

আওয়ামী লীগ বলছে বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা। অন্য দিকে বিএনপি বলছে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের কথা। এই দুই দলের মধ্যে এখন বাংলাদেশে সৃষ্টি হতে পারছে চরম বিরোধ। এই দুই দলের বিরোধ কেবলই মতার ব্যাপার নয়, কিছুটা মতাদর্শেরও ব্যাপার। রাষ্ট্রপতি জিয়া চাননি পাকিস্তানের সাথে বিবাদ বিসংবাদ। তিনি চেয়েছেন, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদকে শক্তিশালী করতে। আর এ েেত্র চেয়েছেন বর্তমান পাকিস্তানের বেশ কিছুটা সহযোগিতা। আওয়ামী লীগের বাঙালি জাতীয়তাবাদ আর বিএনপির বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ ঠিক এক প্রকৃতির জাতীয়তাবাদ নয়। আর এই দুই দলের পররাষ্ট্রনীতিও তাই হতে পারে না একই রকম। বিএনপি ভারতের সাথে বৈরিতা চায় না। কিন্তু মৈত্রী গড়তে গিয়ে চায় না আপন জাতিসত্তাকে ভারতের মধ্যে বিলুপ্ত করতে।
গত সংখ্যার সংশোধনী : গত সংখ্যায় ভুলবশত ছাপা হয়েছিলÑ ভারতের সেনাবাহিনীতে টাটা কোম্পানির ট্রাক কেনা নিয়ে সংঘটিত ঘুষ কেলেঙ্কারি নিয়ে ঘটতে পেরেছে বিরাট অনুসন্ধান। সেখানে আসলে হবেÑ 
ভারতের সেনাবাহিনীতে টাট্রা কোম্পানির ট্রাক কেনা নিয়ে সংঘটিত ঘুষ কেলেঙ্কারি নিয়ে ঘটতে পেরেছে বিরাট অনুসন্ধান। টাট্রা একটি চেক কোম্পানি।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

রবিবার, ২২ এপ্রিল, ২০১২

দুর্নীতি নিয়ে কথা

দুর্নীতি নিয়ে কথা


আত্মপক্ষ

॥ এবনে গোলাম সামাদ ॥

দুর্নীতির একটা সংজ্ঞা দেয়া কঠিন। তবে সাধারণভাবে বলা যায়, দুর্নীতি সমাজজীবনের জন্য তিকর নীতি, যা সমাজসঙ্গতির বিনষ্ট ঘটায়। ঘটায় অনেক লোকের তি। খবরের কাগজে একটা ছোট্ট খবর পড়লাম। ঘটনাটি ঘটেছে যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান অঙ্গরাষ্ট্রে। সেখানকার এক বাসিন্দা আমান্ডা কেটন, যার বয়স ২৫ বছর, লটারিতে টাকা পেয়েছেন সাত লাখ ৩৫ হাজার ডলার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক অঙ্গরাষ্ট্রে লটারিকে মনে করা হয় দুর্নীতি। কারণ মানুষকে লটারি হঠাৎ পাইয়ে দেয় বিনা শ্রমে অনেক টাকা। শ্রমবিহীনভাবে অর্থ লাভকে সেখানে মনে করা হয় সমাজজীবনের জন্য তিকর। কারণ মানুষ এতে হয়ে উঠতে চায় নিছক ভাগ্যবাদী। চায় হঠাৎ টাকা পেয়ে বড়লোক হতে। কিন্তু লটারিতে টাকা পেয়ে খুব কম লোকই বাস্তবে বড়লোক হতে পারে। বহু লোক লটারির টিকিট কিনে তিগ্রস্ত হয়। লটারিতে টাকা পেয়েছেন আমান্ডা কেটন। তিনি ছিলেন খুবই দরিদ্র। মিশিগানের নিয়মানুসারে তিনি রেশনে খাবার কিনে খেতেন। এ রকম সস্তা রেশন গরিব মানুষকে দেয়া হয়। কিন্তু লটারিতে অত টাকা পাওয়ার পরেও কেটন সস্তায় রেশন নিয়েছেন। এ কারণে হয়েছে তার বিরুদ্ধে মামলা। মামলায় তিনি দোষী প্রমাণিত হলে তার হবে চার বছর সশ্রম কারাদণ্ড। মিশিগানের আইনানুসারে কেবল যারা দরিদ্র হিসেবে বিবেচিত, তারাই পেতে পারে রেশনে সস্তায় খাদ্য কিনতে। এই আইন ভঙ্গ করে আমান্ডা কেটনকে দাঁড়াতে হচ্ছে অপরাধীর কাঠগড়ায়। আইন ভঙ্গ করা দুর্নীতির অংশ। তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে মিশিগানের মানবাধিকার সংস্থা। এই সংস্থা বলেছে, কেটন রাতারাতি লটারিতে টাকা পেয়ে গরিব থেকে পরিণত হয়েছেন ধনী ব্যক্তিতে। কিন্তু তিনি এ ঘটনাকে গোপন করে গ্রহণ করেছেন দরিদ্রের প্রাপ্য রেশন। কেটনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। দোষী সাব্যস্ত হলে তাকে পেতে হবে সাজা। ভাবছিলাম আমাদের দেশের কথা। আমরা গরিব মানুষকে বেশ কিছু েেত্র সস্তায় খাদ্যশস্য প্রদান করছি, যাকে বলা হচ্ছে ভিজিএফ (ভালনারেবল গ্র“প ফিডিং)। এতে অনেক দুর্নীতি হচ্ছে। এমন অনেকে ভিজিএফ খাচ্ছেন, যা তাদের পাওয়া উচিত নয়। তবে কোনো মামলা হচ্ছে না এদের বিপ।ে অন্তত আমার চোখে পড়েনি এ রকম মামলা হওয়ার খবর। ক’দিন ধরে পত্রিকায় পড়লাম সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের কথা। তিনি দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়ে হারালেন মন্ত্রিত্ব। কিন্তু আবার হতে পারলেন দফতরবিহীন মন্ত্রী। এ রকম কাণ্ড আর কোনো দেশে ঘটতে পারত কি না আমরা জানি না। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে মনে করতাম পাকা রাজনীতিবিদ। তিনি মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিয়ে যথাযথ কাজই করেছিলেন। কিন্তু আবার মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করে নিজেকে হালকা করে ফেললেন। এভাবে মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করা মনে হয়, আরো একটা বড় দুর্নীতি। রাজনীতির েেত্র সৃষ্টি করা হলো একটা খারাপ নজির। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এটা না করলেও পারতেন। এতে থাকত তার রাজনৈতিক পরিপক্বতার পরিচয়। আমার মনে পড়ছে, ভারতের বিখ্যাত রাজনীতিবিদ লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর কথা। তিনি একসময় ছিলেন রেলমন্ত্রী। তখন হয়েছিল একটা শোচনীয় রেল দুর্ঘটনা। তিনি এর জন্য রেলমন্ত্রিত্ব পদ থেকে দিয়েছিলেন ইস্তফা। এর অনেক পরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওয়াহের লাল নেহরুর মৃত্যুর পর লাল বাহাদুর শাস্ত্রী হন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। তার চারিত্রিক দৃঢ়তা তাকে প্রদান করেছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রিত্ব। ১৯৬৫ সালে হয় কাশ্মির নিয়ে পাক-ভারত যুদ্ধ। সে যুদ্ধের মীমাংসা করতে এগিয়ে আসে তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন। লাল বাহাদুর শাস্ত্রী চাননি পাকিস্তানের সাথে বিবাদ। তিনি গ্রহণ করেন যুদ্ধ স্থগিত রাখার প্রস্তাব, যা গ্রহণ করার পরপরই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে লাল বাহাদুর শাস্ত্রী মারা যান। আমাদের রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের কি লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর সাথে কোনো সুদূর তুলনা করা চলে? শাস্ত্রী লেখাপড়া করেছিলেন সংস্কৃত টোলে। তিনি ছিলেন নিষ্ঠাবান হিন্দু। আর ছিলেন অসাধারণ নৈতিকতাবান ব্যক্তি। কিন্তু সুরঞ্জিত মোটেও তা নন। হলে এ দেশের রাজনীতির ইতিহাস নিতে পারত একটা ভিন্ন ধরনের রূপ। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত যা করলেন, সেটা প্রমাণ করল তিনি আওয়ামী লীগের আর পাঁচজন মতালোভী মন্ত্রীর মতোই একজন অতি সাধারণ মতালোভী রাজনৈতিক নেতা। তার মধ্যে নেই কোনো উচ্চতর নৈতিক আদর্শের অনুপ্রেরণা। থাকলে সেটা এ দেশের সবার জন্য কল্যাণজনক হতে পারত। হতে পারত গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার েেত্র একটি বিশেষ পদপে। কিন্তু তা হলো না। দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি হলো বিশেষভাবে বিবর্ণ। আওয়ামী লীগের একজন নেতা আবদুল জলিল বলেছেন, সুরঞ্জিতের ঘটনায় যাওয়া যাচ্ছে না সভ্যসমাজে; আওয়ামী লীগের ভেতর থেকেও উঠছে এ ঘটনার প্রতিবাদ।
বিলাতে রেলগাড়ি চলতে শুরু করে ১৮২৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে। এর আগে সেখানে ছিল ঘোড়ায় টানা রেলগাড়ি, যা চলত রেললাইনের ওপর দিয়ে। কিন্তু গাড়িগুলো টানত অনেকগুলো ঘোড়া মিলে। ১৮২৫ সাল থেকে শুরু হয় বাষ্পচালিত ইঞ্জিনের সাহায্যে রেলগাড়ি চলা। এর ফলে বিলাতের যোগাযোগব্যবস্থায় ঘটে বিরাট বিপ্লব। এটাকে বলা চলে সে দেশের শিল্প বিপ্লবের অন্যতম বুনিয়াদ। এই উপমহাদেশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে প্রথম রেল চলে ১৮৫৩ সালে। রেল চালু হয়েছিল রেল কোম্পানির উদ্যোগে। এতে কোনো সরকারি উদ্যোগ ছিল না। ছিল বিলাতের বেসরকারি কোম্পানির উদ্যোগ। রেলগাড়ি ছিল একটা ব্যবসায়ের ব্যাপার। আর তা বিলাতে এবং এই উপমহাদেশে প্রতিষ্ঠা পায় বেসরকারি কোম্পানির মাধ্যমে। রেল কোম্পানির জন্য প্রয়োজনীয় মূলধন এই উপমহাদেশে এসেছিল বিলাত থেকে। প্রথম রেলগাড়ি চলে পশ্চিমবঙ্গে। আর এর অনেক পরে উত্তর-পূর্ববঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গে রেলগাড়ি চলার পর রানীগঞ্জ অঞ্চল থেকে মালগাড়িতে করে কয়লা আনা অনেক সহজ হয়। কলকাতার কাছে গঙ্গার দুই ধার দিয়ে এর ফলে ব্রিটিশ পুঁজিতে স্থাপিত হতে পারে অনেক পাটকল। পাট প্রধানত উত্তর ও পূর্ববঙ্গের ফসল। কিন্তু পাটকল গড়ে ওঠে পশ্চিমবঙ্গে। সেখানে ঘটে বেশ কিছু শিল্প বিপ্লব। কার্ল মার্কস বিলাতে শিল্প বিপ্লব ঘটার অন্যতম কারণ হিসেবে বলেছেন রেলগাড়ির প্রবর্তনকে। তিনি তার একটি লেখায় বলেছেন, রেলগাড়িকে নির্ভর করে তদানীন্তন ভারতে আসবে শিল্প বিপ্লব। আর শিল্প বিপ্লব উন্মুক্ত করবে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ। কিন্তু কার্ল মার্কসের এই ভবিষ্যদ্বাণী বিলাতে ও ভারতের েেত্র সত্য হতে পারেনি। এই উপমহাদেশে রেলগাড়ি এক সময় ছিল যোগাযোগব্যবস্থার মেরুদণ্ড। কিন্তু খনিজ তেল-ইঞ্জিন আবিষ্কার হওয়ার পর এই উপমহাদেশেও প্রচলিত হয় বাস, ট্রাক ও মোটরগাড়ি। রেলের আর আগের মতো গুরুত্ব থাকে না। কারণ মালগাড়িতে করে জিনিসপত্র নেয়ার খরচ পড়ে কম।
বাংলাদেশ ভৌগোলিক দিক থেকে বড় নয়। ভারতের তুলনায় এখানে রেলের গুরুত্ব হয়ে পড়েছে অনেক কম। তাই রেলমন্ত্রীর কোনো পদ এখানে ছিল না। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ভাবছে, যোগাযোগব্যবস্থায় রেল পালন করতে পারে বিশেষ ভূমিকা। রেলের মাধ্যমে সে চাচ্ছে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সাথে বিশেষ যোগাযোগব্যবস্থা স্থাপন করতে; বাণিজ্যিক যোগাযোগ বাড়াতে। সম্ভবত ভারত সরকারের বুদ্ধিতেই বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার সৃষ্টি করেছে রেলমন্ত্রীর পদ। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বর্তমানে কম করে আটটি স্থান দিয়ে সহজেই রেল যোগাযোগ স্থাপন করা যায়। ব্রিটিশ শাসনামলে এই যোগাযোগ ছিল। এটা আবার স্থাপিত হলে সুগম হবে পূর্ব এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের মধ্যে যোগাযোগব্যবস্থা। ভারত সরকার এখন এটা বিশেষভাবে গড়ে তুলতে চাচ্ছে। আর সে চাচ্ছে বাংলাদেশে এমন এক ব্যক্তি রেলমন্ত্রী হোন, যার ওপর থাকবে তার একটা বিশেষ প্রভাব। অনেকের ধারণা, এ কারণেই সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত হতে পেরেছিলেন রেলমন্ত্রী। কিন্তু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত জড়িয়ে পড়লেন এক অভাবিত অর্থ কেলেঙ্কারিতে। তাই তাকে ছাড়তে হলো রেলমন্ত্রীর পদ। পরে তিনি আবার হলেন দফতরবিহীন মন্ত্রী। তাকে দফতরবিহীন মন্ত্রী করে আওয়ামী লীগ হারালো তার ভাবমূর্তি। খবরে প্রকাশ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পুত্র পাঁচ কোটি টাকা দিয়ে খুলেছেন একটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান। তিনি কোনো লটারিতে টাকা পাননি। তিনি হঠাৎ কী করে এত টাকার মালিক হলেন, তাতে জাগছে অনেকের প্রশ্ন। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, তিনি যা কিছু করেছেন, তা করেছেন গণতন্ত্রের স্বার্থে। কিন্তু দুর্নীতিকে নির্ভর করে কোনো দেশেই গণতন্ত্র সাফল্য পেতে পারে না।
ভারতের গণতন্ত্র আমাদের শ্রদ্ধার বিষয়। কিন্তু সে দেশের গণতন্ত্র হয়ে উঠেছে প্রশ্নের সম্মুখীন। ভারতের সেনাবাহিনীতে টাটা কোম্পানির ট্রাক কেনা নিয়ে সংঘটিত ঘুষ কেলেঙ্কারি নিয়ে ঘটতে পেরেছে বিরাট অনুসন্ধান। টাটা কোম্পানির পে থেকে ভারতের সেনাপ্রধানকে দেয়া হয়েছিল ঘুষের প্রস্তাব। বলা হয়েছিল, তিনি যদি টাটা কোম্পানির ট্রাক কেনেন তবে তাকে দেয়া হবে ১৪ কোটি ভারতীয় টাকা ঘুষ। কিন্তু তিনি তা নিতে রাজি হননি। তাকে যারা ঘুষ দিতে চেয়েছিলেন তারা হলেন সেনাবাহিনীর সাথে সংশ্লিষ্ট সাবেক উচ্চপদস্থ কর্মচারী। ভারতের সেনাবাহিনীতে কে সেনাপ্রধান হবেন তা নিয়ে এখন সুপ্রিম কোর্টে হতে পারছে মামলা। ভারতের সেনাবাহিনীর ভেতরের অবস্থা ভালো নয়, যা ভারতের গণতন্ত্রকে করে তুলতে পারে বিপন্ন। দুর্নীতি সব দেশেই আছে, তবে তারা যে সব দেশেই বড় সমস্যা তা নয়। জেলখানা সব দেশেই আছে, কিন্তু তাই বলে সব দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এক নয়। বাংলাদেশে দুর্নীতি ছিল এবং হয়ে আছে রাষ্ট্র পরিচালনার েেত্র অন্যতম মূল সমস্যা। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ঘটনা এই বাস্তবতাকেই আমাদের কাছে আবার নগ্ন করে তুলল।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত একসময় বাম রাজনীতি করতেন। দেশে দেশে বাম রাজনীতিকেরা হয়ে পড়েছেন যথেষ্ট দুর্নীতিগ্রস্ত। বিরাট সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার একটা কারণ হলো দুর্নীতিগ্রস্ত বাম রাজনীতি। দণিপন্থী নেতাদের মধ্যে কাজ করে কিছু ধর্মবিশ্বাস। ধর্মচেতনা তাদের নৈতিক হতে কিছু অনুপ্রেরণা জোগায়। কিন্তু বাম নেতাদের মধ্যে ধর্মচেতনার অভাব তাদের অনৈতিক করে তোলে সহজেই। সুরঞ্জিত বাবুদের তথাকথিত ধর্মনিরপেতা করে তুলছে সহজেই অনৈতিক। তাদের রাজনীতিতে থাকছে না কোনো নীতি-চেতনার বিশেষ আদর্শ। 
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

রবিবার, ৮ এপ্রিল, ২০১২

ভারতীয় প্রতিরাব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা

ভারতীয় প্রতিরাব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা



॥ এবনে গোলাম সামাদ ॥

ভারতের আছে এক বিরাট স্থলবাহিনী। কিন্তু এই বাহিনীর সমরশক্তি কতটুকু সেটা নিয়ে ভারতে এখন সৃষ্টি হতে পারছে সংশয়। সমপ্রতি ভারতের সেনাপ্রধান বিজয় কুমার সিং (ভি কে সিং) বলেছেন, ভারতের প্রতিরাব্যবস্থা মোটেও আধুনিক নয়। ট্যাঙ্ক বাহিনীর যে গোলাবারুদ আছে তা যেকোনো বড় যুদ্ধে দু’দিনের মধ্যেই ফুরিয়ে যেতে পারে। এ রকম সীমিত সমরশক্তি নিয়ে কোনো সেনাবাহিনীর প েযুদ্ধ করা সম্ভব নয়। তিনি আরো বলেন, সেনাবাহিনীতে চলেছে নানা দুর্নীতি। ভি কে সিংকে সদ্য অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল, তেজেন্দার সিং ৬০০ টাটার ট্রাক কেনার জন্য ১৪ কোটি রুপি ঘুষ দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তাতরা ট্রাক কিনতে সম্মত হননি। কারণ তার মতে এই ট্রাক উচ্চ মানসম্পন্ন নয়। তিনি (ভি কে সিং) ভারতীয় সেনাবাহিনীর দুর্বলতা এবং দুর্নীতি নিয়ে সমপ্রতি একটি চিঠি লিখেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে। ভি কে সিংকে খুব সহজ মানুষ বলে মনে হচ্ছে না। তার মধ্যেও রয়েছে যথেষ্ট জটিলতা। তিনি এ বছরের জানুয়ারি মাসের ১৫ তারিখে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে তার বয়স সম্পর্কে একটি মামলা দায়ের করেন। তিনি বলেন, ‘তার জন্ম তারিখ ঠিক লেখা হয়নি। তার জন্ম ১৯৫০ সালে নয়। তার জন্ম হয়েছে ১৯৫১ সালে।’ তাই তাকে এ বছর মে মাসের ৩১ তারিখে অবসর গ্রহণে বাধ্য করা ঠিক হচ্ছে না। ॥
কিন্তু ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বলেন, এফিডেভিট করে তিনি আইনত এখন আর বয়স কমাতে পারবেন না। তাকে তাই মে মাসের ৩১ তারিখে সেনাবাহিনী থেকে আইন মোতাবেক অবসর গ্রহণ করতে হবে। যেদিন ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এই রায় দিচ্ছিলেন, সে সময় ভারতের সেনাবাহিনীর একটি বিশেষ সাঁজোয়া ইউনিট ও ছত্রী বাহিনীর একটি ইউনিট ভারতের প্রতিরা মন্ত্রণালয়কে অবহিত না করে যাত্রা শুরু করে রাজধানী দিলিস্ন অভিমুখে। যাকে অনেকে সন্দেহ করছেন সামরিক অভ্যুত্থানের একটি প্রচেষ্টা হিসেবে। যা সফল হতে পারেনি, ঠিক সময়ে প্রতিরা দফতর এর বিপ ব্েযবস্থা নিতে পারার ফলে। খবরটি প্রকাশিত হয়েছে ভারতের The Indian Express নামক দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাতায় এপ্রিল মাসের ৪ তারিখে। এই খবর প্রকাশ হওয়ার পর সারা ভারতে তোলপাড় শুরু হয়েছে। মনে করা হচ্ছে, সেনাবাহিনী এবার না পারলেও আগামীতে পারে মতা দখল করতে। আশ্চর্যজনকভাবে, ভি কে সিংয়ের বিরুদ্ধে গ্রহণ করা হচ্ছে না কোনো ব্যবস্থা। অন্য যেকোনো দেশ হলে তাকে মতাচ্যুত হতে হতো। পেতে হতো সেনাবাহিনীর আইন ভঙ্গ করার জন্য বিধি মোতাবেক শাস্তি। কিন্তু তিনি এখন পর্যন্ত সেনাবাহিনীতে বহাল আছেন। কেবল তাই নয়, সাংবাদিকদের সাথে কথা বলছেন অনেকটা খোলামেলাভাবে। সেনাবাহিনীর অনেক স্পর্শকাতর ব্যাপার থাকছে তার এসব কথোপকথনের মধ্যে। বিখ্যাত মার্কিন সেনাপতি ম্যাক আর্থার ১৯৫২ সালে কোরিয়া যুদ্ধের সময় তখনকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানের সাথে ভিন্নমত পোষণ করেন। 
মার্কিন প্রেসিডেন্ট এ কারণে তাকে করেছিলেন পদচ্যুত। কিন্তু ভারতের প্রেসিডেন্ট ভি কে সিংকে পদচ্যুত করার কথা ভাবতে পারছেন না। মনে হচ্ছে ভি কে সিংয়ের বিরাট প্রভাব আছে সেনাবাহিনীর মধ্যে। ভারত সরকার তাই ভয় পাছে তার বিপ েকোনো ব্যবস্থা নিতে। তারা তাকে কেবল সরিয়ে দিতে চাচ্ছেন এ বছর মে মাসের ৩১ তারিখে। প্রস্তাব উঠেছে তার জায়গায় লেফটেন্যান্ট জেনারেল বিক্রম সিংকে ভারতের সেনাপ্রধান করতে। কিন্তু অনেকেই চাচ্ছেন না বিক্রম সিংকে সেনাপ্রধান করতে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে দুর্নীতির। তার বিপ েআছেন ভারতের সাবেক নৌবাহিনীপ্রধান অ্যাডমিরাল এল এন রামদাস ও সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এন গোপালস্বামী। তারা বিক্রম সিংয়ের নিয়োগ ঠেকাতে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেছেন। 
কঙ্গোয় জাতিসঙ্ঘ শান্তি মিশনে থাকার সময়ও তার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি অভিযোগ ছিল বলে উলেস্নখ করা হয়। তিনি কঙ্গোতে যান জাতিসঙ্ঘের ভারতীয় শান্তিবাহিনীর সেনাপরিচালক হিসেবে। এসব থেকে মনে হচ্ছে, ভারতের সেনাবাহিনীর মধ্যে শুরম্ন হয়েছে মতার লড়াই। এর পরিণতি শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়াবে তা বলা যাচ্ছে না। বর্তমান সেনাপ্রধান ভি কে সিং ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে বলেছেন, ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা RAW (Research and Analysis Wing) একটি গোপন বাহিনী পরিচালনা করছে ভারতের অরুণাচল প্রদেশে। এই বাহিনীর ওপর ভারতের মূল সেনাবাহিনীর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এর কাজ হলো তিব্বতে যারা চীনের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধে নিযুক্ত তাদের সাহায্য করা। ভারতের সেনাবাহিনীতে তাই সৃষ্টি হচ্ছে পরিচালনা সঙ্কট। এদের কার্যকলাপে চীন-ভারত যুদ্ধ বাধলে ভারতীয় সৈন্য পড়তে পারে বিশেষ বিপাকে। 
অরুণাচলে চীন এখনো ভারতের সার্বভৌমত্ব মানতে চাচ্ছে না। চীন বলছে, ভারতের অরুণাচলে প্রায় ৭৬ হাজার ৮০০ বর্গকিলোমিটার জায়গা ভারত দখল করে রেখেছে। ভারতের উচিত হবে আলোচনার মাধ্যমে এই জায়গা সম্পর্কে সমঝোতায় আসা। এই জায়গা নিয়ে এবং লাদাখের কিছু এলাকা নিয়ে ১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বাধে চীন-ভারত যুদ্ধ; যা শেষ হয় ওই বছর নভেম্বর মাসে। এই যুদ্ধে ভারত হেরে যায় শোচনীয়ভাবে। কিন্তু ভারত-চীন এখন পর্যন্ত এই এলাকা কে কতটুকু নিয়ন্ত্রণ করবে তা নিয়ে কোনো সমঝোতায় আসতে পারেনি। এলাকাটি হয়ে আছে বিশেষভাবে বিরোধপূর্ণ। এই এলাকায় তাই ভারতের সেনাবাহিনীকে না জানিয়ে RAW যে তৎপরতা চালাচ্ছে, সেটা ভারতীয় সেনাবাহিনী সমর্থন করতে পারে না। ভি কে সিংয়ের এই বক্তব্য ভারতে সৃষ্টি করেছে বিশেষ চাঞ্চল্য। 
মনে হচ্ছে ভারতের প্রতিরাব্যবস্থা হয়ে পড়তে চাচ্ছে ভেতর থেকেই দুর্বল। কারণ সেনাবাহিনীর অন্যতম প্রধান কথা হচ্ছে, শৃঙ্খলা। কোনো বিশৃঙ্খল সেনাবাহিনী কোনো যুদ্ধেই জয়ী হতে পারে না। ভারতের প্রতিরাব্যবস্থা ভারতের নাগরিকদের চিন্তার বিষয়। তবে বাংলাদেশের উচিত হবে এ েত্ের ভারতের ঘটনাপ্রবাহের ওপর সজাগ দৃষ্টি রাখা। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার হয়ে উঠেছে খুবই ভারতপ্রেমী। ভারতের গোলযোগে অনেক সহজেই তাই জড়িয়ে পড়তে পারে বাংলাদেশ। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত একই অ েঅবস্থান করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি গণতন্ত্রী দেশ। কিন্তু সে ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশকে আপন নিয়ন্ত্রণে রাখার ল্যে ওইসব দেশে সমর্থন দিয়ে এসেছে সেনাশাসকদের। ভারতের েত্ের যে ঠিক কী নীতি অনুসরণ করবে তা বলা যাচ্ছে না। সাবেক পাকিস্তানে ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খানকে মতায় আসতে সহায়তা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র তার আপন স্বার্থের কথা বিবেচনা করে। ভারতের কোনো সেনাপ্রধান আগামীতে একইভাবে, একই রকম কারণে পেতে পারেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ বিবেচনা। 
লেখক : প্রবীণ শিৰাবিদ, কলামিস্ট