বৃহস্পতিবার, ১২ জানুয়ারী, ২০১২

আওয়ামী লীগ-সিপিবি মৈত্রী


২০১১-১২-২৬

মার্কসবাদ ও লেনিনবাদের মধ্যে পার্থক্য আছে। কার্ল মার্কস যেখানে জোর দিয়েছিলেন রাজনীতিতে শ্রেণী-চেতনার ওপর, লেনিন সেখানে জোর দিয়েছিলেন কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার ওপর। লেনিনের মতে, কমিউনিস্ট পার্টি গড়তে হবে সার্বক্ষণিক কর্মী দিয়ে; যারা হবে পেশাদার বিপ্লবী। এই বিপ্লবীরা এক দেশের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে দেশটাকে পরিচালিত করবে। ক্রমে নিয়ে যাবে দেশকে শ্রেণীহীন সমাজের পথে। কার্ল মার্কস ১৮৪৮ সালে বিলেতে চার্টিস্ট আন্দোলনকে সমর্থন করেন। তিনি বলেছিলেন, বিলেতে গণতান্ত্রিক রাজনীতির মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস'া গড়ার সম্ভাব্যতার কথা। তিনি মনে করেছিলেন, ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় বিলেতে জনমতের মূল্য আছে। জনমত সৃষ্টি করে তাই এগোনো যাবে সমাজ পরিবর্তনের পথে; কোনো রক্তক্ষয়ী বিপ্লব ব্রিটেনের জন্য প্রয়োজন হবে না। কিন' লেনিন উদার গণতন্ত্রে আদৌ আস'াশীল ছিলেন না। তিনি আস'াশীল ছিলেন এক দলের রাজত্বে। তিনি মনে করতেন, কমিউনিস্ট পার্টিকে হতে হবে রাষ্ট্রের সর্বময় কর্তা। আর তার কর্তৃত্বের মাধ্যমেই সমাজজীবনে আসবে প্রয়োজনীয় বৈপ্লবিক পরিবর্তন। লেনিনের এই মতবাদ সমাজতান্ত্রিক শিবিরে বিভক্তি এনে দিয়েছিল। বিশেষ করে তার দেশ রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রীরা মেনশেভিক ও বলশেভিক এই দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। লেনিন হন বলশেভিক দলের নেতা, যারা পরে নিজেদের অভিহিত করেন কমিউনিস্ট হিসেবে। ১৯১৭ সালে ঘটে রুশ বিপ্লব। কমিউনিস্টরা সেখানে ক্ষমতায় আসে। আর ক্ষমতায় থাকে ১৯৯১ সালের ডিসেম্বর পর্যন-। অর্থাৎ কমিউনিস্টরা ৭৪ বছর ধরে শাসন করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। রাশিয়া এবং আরো ১৪টি রিপাবলিক নিয়ে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। যা এখন ভেঙে পড়েছে। প্রমাণিত হয়েছে কমিউনিস্টদের দাবির অনেক কিছুই সত্য ছিল না। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে রাশিয়ায় গড়ে উঠেছে অনেক কলকারখানা। অর্থনীতিতে এসেছে সমৃদ্ধি। কিন' এটা কমিউনিস্ট দর্শনের সূত্র ধরে হয়নি। হয়েছে রাশিয়ার মানুষের অদম্য চেষ্টার ফলেই। কমিউনিস্ট শাসন ছাড়াই সুদীর্ঘ ৭৪ বছরে রাশিয়ার অর্থনীতির ক্ষেত্রে ঘটতে পারত কলকারখানার বিপ্লব। রাশিয়ার অর্থনীতিতে যেভাবে শিল্পবিপ্লব ঘটতে পেরেছে, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের আর ১৪টি প্রজাতন্ত্রে তা ঘটতে পারেনি। ফলে সৃষ্টি হতে পারে অর্থনৈতিক বৈষম্য। আর সেই সাথে সৃষ্টি হতে পারে রুশ প্রাধান্যের বিপক্ষে মনোভাব। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার একটা কারণ হলো, রুশ জাতীয়তাবাদের বিপক্ষে অন্য জাতীয়তাবাদের বিরোধ। কার্ল মার্কস বলেছিলেন, মানুষের ইতিহাস শ্রেণী-সংগ্রামের ইতিহাস। তিনি জাতিসত্তার বিরোধ সম্পর্কে কিছু বলেননি। অথচ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়েছে জাতিসত্তার বিরোধে। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ দিয়ে এর ব্যাখ্যা করা যায় না। রাশিয়ায় কমিউনিস্টরা ক্ষমতা হারিয়েছে। একদলের রাজত্বের জায়গায় রাশিয়ায় মানুষ চাচ্ছে বহুদলীয় উদার গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা। চীনে কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় আছে, কিন' সে কমিউনিস্ট পার্টির লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে, চীনকে একটা বিরাট সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত করা; কোনো সাম্যবাদী সমাজ জীবন গড়ে তোলা নয়। সমাজতন্ত্রের পথ ছেড়ে চীনা কমিউনিস্টরা গ্রহণ করেছে মুক্তবাজার অর্থনীতি। আজকের বিশ্বে কমিউনিস্ট দর্শন পড়েছে মহাসঙ্কটে। বলতে হয়, তা চলেছে বিলুপ্তিরই পথে। মুক্তবাজার অর্থনীতি যে ভালোভাবে চলছে, সেটাও বলা চলে না। যুক্তরাষ্ট্রে শুরু হয়েছে ওয়াল স্ট্রিট দখল করার আন্দোলন। সারা ইউরোপে বাজার অর্থনীতিতে দেখা দিয়েছে সঙ্কট। মানুষ চাচ্ছে অর্থনীতিতে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ। অর্থাৎ মুক্তবাজার অর্থনীতির দর্শনে মানুষ যে এখনো যথেষ্ট আস'াশীল, তা বলা যায় না। বিশ্বজনমত ঢুকে পড়তে চাচ্ছে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির দিকে; যাকে এক সময় কমিউনিস্টরা বলতেন, ভেজালমিশ্রিত দর্শন। এর আসল লক্ষ্য হচ্ছে ধনতন্ত্রকে রক্ষা করা। কিন' এখন তারা ঠিক এ রকম কথা আর বলতে পারছেন না। কারণ, চীন ধরেছে কার্যত রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত মিশ্র অর্থনীতির পথ। রাশিয়াও চাচ্ছে অনুরূপ অর্থনীতিকে গ্রহণ করতে। এক সময় বলা হতো, রাশিয়া প্রায় পরিণত হয়েছে আদর্শ সমাজতান্ত্রিক দেশে। কিন' এই দাবি যে সত্য ছিল না, তার অনেক প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে ১৯৯১ সালের পর। রাশিয়ায় উদয় ঘটেছে একাধিক ধনকুবেরের। রাশিয়া একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ হলে কখনোই এত অল্প সময়ে এত ধনকুবেরের উদয় হতে পারত না। কমিউনিস্টরা কোনো দেশেই এখন আর আগের মতো জনপ্রিয় নয়, বাংলাদেশেও নয়। কিন' শেখ হাসিনা বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাথে হাত মিলিয়ে করছেন মৈত্রী জোট গঠন। জানি না, এর দ্বারা তিনি কিভাবে রাজনৈতিক শক্তি অর্জনের কথা চিন-া করতে পারছেন। আওয়ামী লীগে আছে অনেক ত্যাগী কর্মী। তাদের মূল্যায়ন না করে জোটে সিপিবির কর্মীদের প্রাধান্য প্রদান করলে সিপিবি ও আওয়ামী লীগ কর্মীদের মধ্যে দেখা দিতে পারে বড় রকমের বিরোধ; যা আওয়ামী লীগের ওপর মহলের পক্ষে শেষ পর্যন- সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়তেই পারে। এ ছাড়া মতবাদগত বিরোধ দেখা দিতে পারে। কারণ সিপিবির আছে একটা বিশেষ দর্শন। আওয়ামী লীগের সে রকম কোনো সুনির্দিষ্ট, সুস্পষ্ট রাজনৈতিক দর্শন নেই। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ব্রিটিশ লেবার পার্টির চিন্তাধারার দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। তিনি গণতন্ত্র বলতে বুঝতেন ব্রিটিশ সংসদীয় পদ্ধতির গণতন্ত্রকে। অর্থনীতিতে তিনি ছিলেন মিশ্র অর্থনীতির পক্ষে। এক কথায় বলা চলে তার দর্শন ছিল যাকে বলে, কল্যাণব্রতী রাষ্ট্র গড়া, তারই পক্ষে। কল্যাণব্রতী রাষ্ট্রের মূলনীতি হলো দু’টি। একটি হলো, সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তির জীবনযাত্রার ন্যূনতম মান রাষ্ট্রের দায়িত্বে নিশ্চিত করা। অপরটি হলো নাগরিকদের রাষ্ট্রিক দায়িত্বে কর্মসংস'ানের ব্যবস'া করা। রাষ্ট্রকে সেসব সুযোগ সুবিধার ব্যবস'া করতে হবে, যাতে লোকে নিরাপত্তা, ন্যূনতম জীবনযাত্রার মান ও সভ্যজীবন ভোগ করতে পারে। বেকার, দারিদ্র্য, বার্ধক্য ও অসুস' অবস'ার নিরাপত্তার অভাব, বাণিজ্যচক্র এবং প্রকট ধনবৈষম্য দূর করতে হবে। সোহরাওয়ার্দী সমাজতন্ত্র বা কমিউনিজমকে স্বীকার করে নিতে চাননি। কারণ তিনি মনে করতেন, মানুষের জীবনে ব্যক্তিস্বাধীনতার মূল্য আছে। আর গণতন্ত্রের মাধ্যমেই ব্যক্তিস্বাধীনতা সুরক্ষিত হতে পারে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বিলেতে লেখাপড়া শিখেছিলেন। ব্রিটিশ চিন-াচেতনা তাকে প্রভাবিত করেছিল। তিনি ব্রিটিশ শাসনামলে মুসলিম লীগে যোগ দেয়ার আগে ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের স্বরাজ্য পার্টির সদস্য। পরে (১৯৩৬) যোগ দেন মুসলিম লীগে। ১৯৪৭-এর পর তিনি মুসলিম লীগ ভেঙে গড়েন আওয়ামী মুসলিম লীগ।
আওয়ামী শব্দটা আরবি। শব্দগত অর্থে জনসাধারণ। অর্থাৎ আওয়ামী মুসলিম লীগ বলতে বোঝায় জনগণের মুসলিম লীগ। পরে মুসলিম কথাটা বাদ পড়ে দলের নাম দাঁড়ায় আওয়ামী লীগ। লীগ শব্দটা ল্যাটিন, বাংলা ভাষার নয়। লীগ বলতে ঠিক দল বোঝায় না। বোঝায় পরস্পরের সহযোগী মানুষের সঙ্ঘ। কার্ল মার্কস পার্টি ও লীগ শব্দ দু’টিকে এক করে দেখেননি। তিনি গড়তে সাহায্য করেছিলেন কমিউনিস্ট লীগ। ঢাকায় মুসলিম লীগ গঠিত হলেও বাংলার মুসলমানদের প্রধান দল হয়ে ওঠেনি। একসময় বাংলার মুসলমানদের প্রধান দল ছিল ফজলুল হক সাহেবের কৃষক প্রজা পার্টি। অবশ্য এ দলে হিন্দুরাও যোগ দিতে পারত। কৃষক প্রজা পার্টি একপর্যায়ে হয়ে উঠেছিল বাংলার মুসলমানদের প্রধান দল। অনেক পরে মুসলিম লীগ হয়ে ওঠে তখনকার সারা ভারতের মতো বাংলার মুসলমানদেরও প্রধান দল। বাংলার মুসলমান পকিস-ান প্রতিষ্ঠার দাবিকে সমর্থন করেছিল। ১৯৪০ সালে লাহোরে মুসলিম লীগের বিখ্যাত ‘পাকিস্তান প্রস-াব’ উত্থাপন করেছিলেন বাংলার বিখ্যাত নেতা আবুল কাশেম ফজলুল হক। আজ বোঝানোর চেষ্টা চলেছে, পাকিস-ান গঠিত হয়েছিল বাংলাভাষী মুসলমানকে বিবেচনায় না রেখে, কিন' ইতিহাস তা বলে না। এই উপমহাদেশ পাকিস-ান ও ভারতে বিভক্ত হওয়ার অনেক আগে, ১৯০৫ সালে তখনকার বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি বিভক্ত হয়েছিল। বাংলাভাষী মুসলমান এই বিভক্তিকে স্বাগত জানিয়েছিল। যার মূলে কাজ করেছিল একটা মুসলিম স্বতন্ত্র চেতনা। ইতিহাসের এই পটভূমিকে মনে না রাখলে আজকের বাংলাদেশের উদ্ভবকে বিশ্লেষণ করা যায় না।
এই উপমহাদেশে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা করা হয় ১৯১৪ সালে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার মূলে তিনজন ব্রিটিশ কমিউনিস্ট বিশেষ অবদান রাখেন। তারা হলেন- জন ব্রাডলি, হাচিংসন ও ফিলিপসপ্রাস্ট। এ তিনজনের মধ্যে ফিলিপসপ্রাস্টের অবদানই ছিল সবচেয়ে বেশি। কমিউনিস্ট দর্শন সরাসরি রাশিয়া থেকে ভারতে আসেনি; এসেছে গ্রেট ব্রিটেন ঘুরে। কিন' ব্রিটেনের রাজনীতিতে কমিউনিস্টরা কোনো দিনই উল্লেখযোগ্য শক্তিতে পরিণত হতে পারেনি। উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে ব্রিটিশ লেবার পার্টি। ১৯৪৫ সালের নির্বাচনে গ্রেট ব্রিটেনে লেবার পার্টি ক্ষমতায় আসে। লেবার পার্টির শাসনামলে ১৯৪৭ সালে ভারত পায় স্বাধীনতা। আর সেই সাথে সৃষ্টি হয় সাবেক পাকিস-ান। পাকিস-ান হয়েছিল ভারতের কংগ্রেস দলের সাথে একটা সমঝোতা করেই। কংগ্রেস সে সময় ভেবেছিল পাকিস্তানের দাবি না মানলে ব্রিটেন এই উপমহাদেশ ছাড়বে না। কংগ্রেস পাকিস-ানের দাবিকে মেনে নেয় কৌশলগত কারণেই; কিন' বরাবরই চেয়েছে পাকিস্তানের বিলুপ্তি। ১৯৭১ সালে সাবেক পাকিস্তানকে ভেঙে দেয়া সম্ভব হয়। ইন্দিরা গান্ধীও বাংলাদেশের স্বাধীনতা মেনে নেন কৌশলগত কারণেই। তিনি ভেবেছিলেন ধীরে ধীরে বাংলাদেশকে ভারতের অঙ্গীভূত করে নেয়ারই কথা। ১৯৭১ সালে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সাথে ভারত সরকারের একটি গোপন চুক্তি হয়। সে চুক্তিতে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের কোনো পৃথক সেনাবাহিনী থাকবে না; থাকবে কেবল মিলিশিয়া। বাংলাদেশে স'ায়ীভাবে থাকবে ভারতীয় সৈন্য। ভারতের হাতে থাকবে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষার ভার। কিন' এই চুক্তিটি শেষ পর্যন- টিকতে পারেনি। টিকতে না পারার একটি কারণ হলো মার্কিন চাপ। আর একটি বড় কারণ হলো, শেখ মুজিবের বিরোধিতা। যতগুলো কারণে তাজউদ্দীনের রাজনৈতিক পরাজয় ঘনিয়ে আসে, তার মধ্যে একটি ছিল এই গোপন চুক্তি। আমি এই চুক্তির কথা প্রথম অবগত হতে পারি ভারতের বিজেপি দলের পূর্বসূরি, জনসঙ্ঘ দলের ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা থেকে। এ বিষয়ে অবগত হই পশ্চিমবঙ্গের একজন মুসলিম নাগরিকের কাছ থেকেও। ১৯৬০-এর দশকে এই উপমহাদেশে কমিউনিস্ট পার্টি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। সাবেক কমিউনিস্ট পার্টির একটি অংশ পরিচালিত হতে থাকে সোভিয়েত ইউনিয়নের নির্দেশে। অপর অংশ পরিচালিত হতে থাকে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাবে। ১৯৭১-এর যুদ্ধকে চীনপন'ী কমিউনিস্টরা মুক্তিযুদ্ধ বলেনি। বলেছে এই যুদ্ধ হচ্ছে, ভারতের ষড়যন্ত্রের ফল, যার লক্ষ্য বাংলাদেশকে স্বাধীন করা নয়, সাবেক পাকিস-ান রাষ্ট্রকে দুই টুকরো করে দেয়া মাত্র। অন্য দিকে সোভিয়েত প্রভাবিত কমিউনিস্টরা ১৯৭১-এর যুদ্ধকে মুক্তিযুদ্ধ আখ্যা দেয়। প্রবাসী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন সোভিয়েতপন'ী কমিউনিস্ট। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার চলেছে মূলত সোভিয়েত-নির্ভর কমিউনিস্টদেরই পরিচালনায়। শেখ হাসিনা সিপিবির সাথে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছেন। কিন' সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়েছে। সিপিবি বহন করছে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন-নির্ভর কমিউনিস্টদেরই ঐতিহ্য; যারা আজ মোটেও শক্তিশালী নয়। সোভিয়েত-নির্ভর কমিউনিস্ট পার্টি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে একটি গভীর সমঝোতা হতে পেরেছিল ১৯৭৫ সালে। মূলত তাদের কথা অনুসারে গঠিত হয়েছিল বাকশাল। কিন' বাকশাল গঠন দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে ঠেলে দিয়েছিল বিরাট বিপর্যয়ের মধ্যে। বাংলাদেশের মানুষ মেনে নিতে চায়নি এক দলের রাজত্ব। বিশেষ করে কমিউনিস্টদের প্রাধান্য। আজ আবার নতুন করে আওয়ামী লীগ ও সিপিবি ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। এই ঐক্যের ফল যে শুভ হবে, এমন ভাবা যায় না। সিপিবি বলছে, তারা ১৯৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে অগ্রধিকার দেবে। তারা চাচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীকে ধ্বংস করতে। এভাবে দেশের দু’টি বড় রাজনৈতিক দলকে ধ্বংস করে তারা দেশকে চাচ্ছে একদলীয় রাজনীতির আওতায় নিয়ে আসতে। আওয়ামী লীগকে সামনে রেখে দেশের রাষ্ট্রক্ষমতা অধিকার করতে। কিন' তাদের এই চেষ্টার ফলে দেশে ভয়াবহ সংকট অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে যার ফল চলে যেতে পারে তাদের অভিলাষের সম্পূর্ণ বিপক্ষে।
উদার গণতন্ত্রের সাফল্য নির্ভর করে জনমত, রাজনৈতিক দল এবং অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ওপর। যে গ্রেট ব্রিটেনের কাছ থেকে আমরা আধুনিক গণতন্ত্রের ধারণা লাভ করেছি, সেই দেশে এই তিনের অভাব ঘটেনি। ব্রিটেনে যায় ইচ্ছেমতো দল গড়া ও জনমত গঠন করা। নির্বাচন হয় নিরপেক্ষ ও অবাধ। ব্রিটেনে কোনো দলই চায় না, নির্বাচনে কারচুপি হোক। কিন' বাংলাদেশে এই পরিসি'তি বিরাজ করছে না। বাংলাদেশে তাই উঠেছিল নির্বাচনের সময় পৃথকভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের দাবি। আজ আওয়ামী লীগ চাচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস'া বাতিল করতে। জনমনে তাই আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিলেতে গণতন্ত্র সফল হয়েছে; কারণ বিলেতে রাষ্ট্র (State) ও সরকারকে (Government) সমার্থক ভাবা হয় না। রাষ্ট্র একটি স'ায়ী প্রতিষ্ঠান। সেখানে সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে যে রাজনৈতিক দল সরকার গঠনের যোগ্যতা অর্জন করে, সেই দল কর্তৃক সরকার গঠিত হয়। বিলেতে কোনো রাজনৈতিক দল প্রশাসনে হস-ক্ষেপ করে না। প্রশাসন চলে দেশের প্রতিষ্ঠিত আইন অনুসরণ করে। প্রশাসনের আছে একটা পৃথক সত্তা। কিন' আমাদের দেশে রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে পার্থক্য বজায় রাখা হচ্ছে না। প্রশাসনে করা হচ্ছে সরকারি হস-ক্ষেপ; যা হয়ে উঠছে মানবাধিকার ও আইনের শাসনের পরিপন'ী। মানবাধিকার ও আইনের শাসন বাদ দিলে অচল হয়ে পড়তে চায় গণতন্ত্র। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার কলকাতা থেকে বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনার মোস-াফিজুর রহমানকে ঢাকায় ফিরিয়ে আনল। তার অপরাধ, তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সরাসরি জানান, পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশের সাথে তিস-ার পানিবণ্টনে দিল্লির চুক্তি সইয়ের বিরুদ্ধে অবস'ান গ্রহণ করেছেন এবং তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সাথে ঢাকা সফরে যাবেন না। জনাব রহমানকে কলকাতা থেকে ঢাকায় আনা হলো। কারণ তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-সংক্রান- খবরটি গোপনে জানতে পেরে সরাসরি বাংলাদেশ সরকারকে অবহিত করেন। প্রটোকল অনুসারে তার উচিত ছিল খবরটি দিল্লিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনারকে জানানো। কিন' তিনি সেটা না করে খবরটি সরাসরি জানান বাংলাদেশ সরকারকে। এটা নাকি ‘গুরুতর অপরাধ’। কিন' আমাদের মনে হয়, কলকাতা থেকে তাকে সরিয়ে নেয়া হলো ভারতের চাপে। আর আওয়ামী লীগ সরকার তাকে এভাবে সরিয়ে এনে করল ক্ষমতার অপব্যবহার। অন্য কোনো দেশ হলে এটা তারা করতে যেত না।
আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি বলছেন, দিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার তাকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে কোনো সংবাদ সরবরাহ করেননি। তাই তিনি ভেবেছিলেন, তিস-ার পানিবণ্টন চুক্তি হবেই। কলকাতায় বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনার এক অমার্জনীয় অপরাধ করেছেন। কিন' এ কথা ভাবার কোনো সঙ্গত কারণ আছে বলে আমাদের মনে হচ্ছে না। আমরা সরকারি লোক নই। আমরা কলকাতার বিশেষ টিভি চ্যানেল ‘২৪-ঘণ্টা’ প্রদত্ত খবরের মাধ্যমে অনেক আগেই জেনেছিলাম, তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি হবে না। কিন' দিল্লিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার এবং প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উপদেষ্টা গওহর রিজভী বলছিলেন, তিস-ার পানিবণ্টন চুক্তি হবেই হবে। এর ফলে সৃষ্টি হয় বিরাট বিভ্রানি-। বাংলাদেশ সরকারের উচিত ছিল ডেপুটি হাইকমিশনারের দেয়া খবরকে গুরুত্ব দেয়া। কিন' সেটা না করে তাকে দেয়া হলো শাসি-। এ রকম শাসি- দেয়া হতে থাকলে প্রশাসন অচল হয়ে পড়বে। চালানো যাবে না দেশ। কমিউনিস্টরা রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে কোনো পার্থক্য করতে চায় না। কমিউনিস্টদের প্রভাবে আওয়ামী লীগ এ ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে বাড়িয়ে তুলবে আরো জটিলতা।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন