মঙ্গলবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১২

বাংলাদেশে হিন্দিপ্রীতি

॥ এবনে গোলাম সামাদ ॥ ভাষা মানুষের জীবনে একটা বিরাট বাস-বতা। মানুষ ভাষার মাধ্যমে মনোভাব ব্যক্ত করে। ভাষার মাধ্যমে চিন-া করে। ভাষার মাধ্যমে ধরে রাখতে চায় তার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে। ভাষা আধুনিক জাতীয়তাবাদের অন্যতম উপাদান; যদিও একমাত্র উপাদান নয়। জাতিসত্তার দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয় ভাষাকে কেন্দ্র করে। রাশিয়ানরা রুশ ভাষা শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেছিল হাঙ্গেরিতে; কিন' হাঙ্গেরিয়ানরা এটা মেনে নিতে চায়নি। হাঙ্গেরিয়ায় রুশবিরোধী অভ্যুত্থানের এটা ছিল একটা কারণ। বাংলাদেশের মানুষ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করেছে, উর্দু ভাষার আধিপত্য মেনে নিতে চায়নি বলে। ব্যাকরণগত দিক থেকে হিন্দি আর উর্দুর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। হিন্দি ও উর্দুর মধ্যে একটা পার্থক্য হলো, উর্দু ভাষায় থাকতে দেখা যায় ফারসি ও আরবি শব্দের প্রাধান্য। অন্য দিকে হিন্দি ভাষায় থাকতে দেখা যায় সংস্কৃত শব্দের প্রাধান্য। এ ছাড়া হিন্দি ভাষা লেখা হয় দেব নাগরি অক্ষরে। অন্য দিকে উর্দু লেখা হয় আরবি-ফারসি অক্ষরে। হিন্দি প্রধানত বলে উত্তর ভারতের গ্রামের লোকে; কিন' উর্দু বলে শহরের বাসিন্দারা। এ দিক থেকে উর্দুকে বলতে হয় শহুরে ভাষা। হিন্দি এখনো শহুরে ভাষা হয়ে উঠতে পারেনি। হিন্দি খুব গ্রহণপটু ভাষা নয়। অর্থাৎ হিন্দি চায় না বিদেশী শব্দকে সহজে গ্রহণ করতে। পক্ষান-রে উর্দু অনেক গ্রহণপটু ভাষা। ইংরেজি ভাষা থেকে উর্দু অনেক শব্দ গ্রহণ করেছে এবং এখনো করছে। এ দিক থেকে উর্দু হলো অনেক সমৃদ্ধ ভাষা। অনেক ভাষাতাত্ত্বিকের মতে উর্দু সাহিত্য হিন্দি সাহিত্য থেকে আছে এগিয়ে।
ব্রিটিশ শাসনামলে সেনাবাহিনীতে চলত রোমান উর্দু। রোমান উর্দু বলতে বোঝাত রোমক বর্ণমালায় লিখিত উর্দুকে। উর্দুর বিশেষ বিকাশ ঘটতে পেরেছে ব্রিটিশ শাসনামলে। উর্দু এখন পাকিস-ানের রাষ্ট্রভাষা। কিন' এখনো উর্দু পাকিস-ানের কোনো প্রদেশের মানুষের মাতৃভাষা হয়ে ওঠেনি। উর্দু এখনো বলতে গেলে হয়ে আছে উত্তর ভারতের বিস-ীর্ণ অঞ্চলের মানুষের মাতৃভাষা। ভারতের এক সময়ের প্রধানমন্ত্রী ভিপি সিং গর্ব করে বলেছিলেন, উর্দু তার মাতৃভাষা। জওয়াহের লাল নেহরু ঠিক হিন্দি বলতে পারতেন না। বক্তৃতা দিতেন আসলে উর্দু ভাষাতেই। উর্দু ভাষার প্রাণকেন্দ্র হলো ভারতের উত্তর প্রদেশ। ভারতের উর্দুভাষী অঞ্চল থেকে যারা গেছেন পাকিস-ানে, তাদের সাথে ঠিক বনিবনা হচ্ছে না স'ানীয় বাসিন্দাদের। উর্দু করাচি শহরে চলে, কিন' সিন্ধু প্রদেশে নয়। ভারতে ভাষা এখনো হয়ে আছে একটা বড় রকমের সমস্যা। দক্ষিণ ভারতে দ্রাবিড় ভাষা পরিবারভুক্ত ভাষায় যারা কথা বলেন তারা মানতে চাচ্ছেন না হিন্দির দৌরাত্ম্য। ফলে এখনো করা সম্ভব হয়নি হিন্দিকে বাস-বে রাষ্ট্রভাষা। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের কাজ-কারবার এখনো চলেছে ইংরেজি ভাষারই মাধ্যমে। তামিলনাড়ুতে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার হিন্দি ভাষায় কোনো চিঠি লিখলে তার সাথে দিতে হচ্ছে ইংরেজি অনুবাদ। এ হলো আজকের ভারতের ভাষা সমস্যার ক্ষেত্রে এক বিশেষ বাস-বতা।
কথাগুলো বলতে হচ্ছে এই কারণে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক সমপ্রতি বলেছেন, ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নত করার লক্ষ্যে আমাদের হিন্দি ভাষা শেখা উচিত (নয়া দিগন-, ২৩ জানুয়ারি ২০১২)। কিন' তিনি বলেননি হিন্দি শেখার মাধ্যমে ভারতের সাথে আমাদের সম্পর্ক উন্নত হবে কিভাবে। কারণ বাংলাদেশের পশ্চিমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ। পশ্চিমবঙ্গের ভাষা হলো বাংলা। হিন্দি শিখে তাদের সাথে সম্পর্কের উন্নয়ন সম্ভব নয়। আমাদের উত্তর-পূর্বে রয়েছে ভারতের যে সাতটি প্রদেশ, তাদের কারো প্রাদেশিক সরকারি ভাষা হিন্দি নয়। হিন্দি ভাষার আধিপত্যের বিরুদ্ধে এসব প্রদেশের মানুষের মনে সৃষ্টি হতে পেরেছে প্রবল ক্ষোভ। হিন্দি ভাষা শিখে আমরা তাই এদের সাথে উন্নত সম্পর্ক সৃষ্টির কথা ভাবতে পারি না। তাদের সাথে উন্নত সম্পর্ক সৃষ্টি করতে হলে আমাদের শিখতে হবে এসব অঞ্চলের মানুষের ভাষা। বিশেষ করে আসামের অহমিয়া, মেঘালয়ের খাসিয়া ও মিজোরামের মিজো ভাষা। কারণ এদের সাথে আছে আমাদের সাধারণ সীমান-। আমরা তাই বুঝতে সক্ষম হচ্ছি না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি কী করে বলতে পারছেন হিন্দি ভাষা শিখে ভারতের সাথে উন্নত সম্পর্ক সৃষ্টির কথা। বাংলা যত লোকের মাতৃভাষা, তাদের মধ্যে শতকরা ৬০ ভাগের বাস বাংলাদেশে। আর শতকরা ৪০ ভাগের বাস হলো ভারতে। কিন' পশ্চিম বাংলার বাইরে ভারতের বাংলাভাষী মানুষ এখন বাংলা ভাষায় কথা বলতে ভয় পাচ্ছেন। কারণ তাদের বিবেচনা করা হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে আগত অবাঞ্ছিত মানুষ হিসেবে। এভাবে বাংলাভাষী মানুষকে অবাঞ্ছিত ভাবলে বাংলাদেশের মানুষের সাথে ভারতের সম্পর্ক কখনওই উন্নত হতে পারবে না। বাংলা ভাষা সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে ভারত সরকারকেও। বাংলা ভাষাকে দিতে হবে বিশেষ মর্যাদা। কিন' ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এ সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন বলে আমাদের মনে হচ্ছে না।
ভারতের ২৮টি প্রদেশের মধ্যে ৯টির প্রাদেশিক সরকারি ভাষা হলো হিন্দি। এই প্রদেশগুলো হলো- বিহার, ঝাড়খন্ড, ছত্তিশগড়, হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, উত্তরাচল ও রাজস'ান। এদের কারো সাথে বাংলাদেশের কোনো সীমান- নেই। পশ্চিমবঙ্গের সীমান- আছে বিহার ও ঝাড়খন্ডের সাথে; কিন' আমাদের এদের সাথে কোনো সীমান- নেই। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, বিহারের পুর্নিয়া জেলায় অনেক লোক বাংলা ভাষায় কথা বলেন। ঝাড়খন্ডেও রয়েছে অনেক বাংলাভাষাভাষী মানুষ। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রদেশগুলোর মধ্যে আসামের গোয়ালপাড়া ও কাছার জেলার মানুষ কথা বলেন বাংলা ভাষায়। ত্রিপুরা রাজ্যে এক সময় চলত টিপরা ভাষা। কিন' এখন সেখানকার ভাষা বিশেষভাবেই হয়ে উঠেছে বাংলা। বাংলা ভাষার স'ান পৃথিবীর মূল ভাষাগুলোর মধ্যে জনসংখ্যার দিক থেকে সপ্তম কি অষ্টম। ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা যথেষ্ট উন্নত। বিশেষ করে হিন্দি ভাষার তুলনায়। তাই হিন্দি চর্চা করে ভারতের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা করা বৃথা। হিন্দির চেয়ে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমেই আমরা ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের মানুষের সাথে প্রয়োজনে অনেক সহজে যোগাযোগ স'াপন করতে পারি। ভারত ঠিক এক জাতির দেশ নয়। ভারত কার্যত বহু জাতির দেশ। ভারতকে আমাদের সেভাবেই বিচার করতে হবে। তা না হলে ভারত সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি হতে চাইবে বিভ্রানি-কর। অনেক কিছুই ঘটছে ভারতে। হিন্দি ভাষায় যেমন এখন ব্যবহারের চেষ্টা চলছে আরবি-ফারসি শব্দ বাদ দিয়ে সংস্কৃত শব্দের ব্যবহার বৃদ্ধির; তেমনি আবার দক্ষিণ ভারতের দ্রাবিড়ভাষী মানুষেরা চাচ্ছেন তাদের ভাষায় যেসব সংস্কৃত শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটেছে সেসব শব্দকে বাদ দিতে। সমগ্র দক্ষিণ ভারতের দ্রাবিড়ভাষী অঞ্চলে সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে সংস্কৃত শব্দবিরোধী মনোভাব। বিশেষ করে তামিলভাষী প্রদেশ তামিলনাড়-তে। তামিলনাড়-কে ব্রিটিশ শাসনামলে বলা হতো মাদ্রাজ প্রদেশ। কিন' ব্রিটিশ শাসন অবসানের পর প্রদেশটির নাম হয়েছে তামিলনাড়-। তামিল ভাষায় ‘নাড়-’ শব্দের অর্থ হলো দেশ। তামিলনাড়- শব্দের বাংলা করলে বলতে হবে তামিলদের দেশ। তামিলনাড়- হলো দ্রাবিড় ভাষাভাষী সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র। ভারতে দেখা দিয়েছে আর্য সংস্কৃতির মধ্যে বিশেষ বিরোধ। ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমানে- আর্য সংস্কৃতির প্রসার কখনওই সেভাবে ঘটেনি। এখানে রয়েছে মঙ্গলীয় মানব ধারার প্রাধান্য। ভারত বিভক্ত হয়ে পড়ছে আর্য, দ্রাবিড় ও মঙ্গল (কিরাত) দ্বন্দ্বে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের সর্বোচ্চ জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্র। এখানে হিন্দি শিক্ষার ব্যবস'া করা অন্যায় হয়েছে বলে আমরা মনে করি না। কিন' হিন্দি শিক্ষার গুরুত্ব নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি যে বক্তব্য দিয়েছেন তার সাথে কোনোভাবেই পোষণ করতে পারছি না ঐকমত্য। তিনি এমন এক সময় তার এই অভিমত ব্যক্ত করলেন যখন দেশে ঘটছে আরো অনেক কিছু। আমরা পাকিস-ান আমলে উর্দু শিখতে চাইনি, কিন' এখন ভারতের সাথে উন্নত সম্পর্ক সৃষ্টির নামে শিখতে চাচ্ছি হিন্দি। আমাদের এই হিন্দি শিখতে চাওয়া ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের কতটা চাপের ফল সেটা নিয়েও জাগতে পারছে সন্দেহ। এই হিন্দি শেখার হুজুগ বিশেষভাবে উঠতে পারছে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। যেটা জনমনে সন্দেহের সৃষ্টি করছে বাংলাদেশের ওপর ভারতীয় আধিপত্যবাদ বিস-ারের পরিকল্পনার একটা চেষ্টা হিসেবে।
২০১২ সালের ১৯ জানুয়ারি লন্ডনে প্রবাসী বিখ্যাত বাংলাভাষী সাংবাদিক সিরাজুর রহমান রেডিও তেহরানকে একটি সাক্ষাৎকার প্রদান করেছেন। এতে তিনি বলেছেন, ১৯৭১ সালে তাজউদ্দিন সরকার ভারত সরকারের সাথে ৭ দফা চুক্তি করেছিল। সেই চুক্তিতে ছিল বাংলাদেশে নিজস্ব কোনো সেনাবাহিনী থাকবে না। থাকবে না স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি। ভারত বাংলাদেশের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব নেবে। কিন' শেখ মুজিব এই চুক্তি মানেননি। ভারত সরকার এখন অগ্রসর হচ্ছে ১৯৭১ সালের চুক্তি বাস-বায়ন করার লক্ষ্যে। সিরাজুর রহমান সাহেবের বক্তব্য কতটা নির্ভরযোগ্য তা আমরা বলতে পারি না। তবে ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন বিবিসির সাংবাদিক। আর সেই সুবাদেই তিনি তাজউদ্দিন সরকার সম্পর্কে নানা বিষয়ে হলেন বিশেষভাবে জ্ঞাত। তাই তার কথা হেলাফেলা করা চলে না। একই সময়ে আমরা দেখছি, ভারত এখন চাচ্ছে কেবল আমাদের প্রতিরক্ষাব্যবস'াকে দুর্বল করতেই নয়, এ দেশে হিন্দি ভাষার প্রসার বাড়াতেও। বলা হচ্ছে, হিন্দি ও বাংলা নিকট সম্পর্কীয় ভাষা। ব্যাকরণগত দিক থেকে যা আদৌ সত্য নয়। আমাদের তাই প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে ভারতের অভিসন্ধি সম্পর্কে বিশেষভাবে সচেতন হওয়ার। ভারত পাকিস-ান প্রতিষ্ঠার দাবিকে মেনে নিয়েছিল কৌশলগত কারণে। সে এখন চাচ্ছে পাকিস-ানের ধ্বংস। সে এটা চাচ্ছে মার্কিন সহযোগিতায়। বাংলাদেশ সম্পর্কেও তার মনোভাব বাংলাদেশের অনুকূল নয়। সমপ্রতি আমাদের প্রধানমন্ত্রী গিয়েছিলেন ত্রিপুরায়। ত্রিপুরার মানুষ আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে যেভাবে সংবর্ধনা জানিয়েছেন, সেটা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের মনঃপূত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। পরোক্ষভাবে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে প্রটোকল নিয়ে।
ভারতের খ্যাতনামা সাংবাদিক কুলদীপ নায়ার আরব উপদ্বীপ থেকে ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত ও বহুল পঠিত গালফ নিউজ পত্রিকার ২৮ জানুয়ারি ২০১২ সংখ্যায় লিখেছেন- তার কাছে যেসব সংবাদ আছে, তা থেকে সিদ্ধান- করা যায়, বাংলাদেশে সমপ্রতি যে সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টা হয়েছিল তাতে ছিল আসামের উলফা এবং মনিপুর ও নাগাল্যান্ডের স্বাধীনতাকামী সংগঠনের সংশ্লিষ্টতা। তাই একে কেবল বাংলাদেশের একটি রাজনৈতিক ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। কুলদীপ নায়ারের বক্তব্য যদি নির্ভরযোগ্য হয়, তবে বলতে হবে, উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজনৈতিক পরিসি'তি সম্পর্কে আমাদের অধিক অবগত হতে হবে। হিন্দি ভাষার মাধ্যমে সারা ভারতের মানুষ কী ভাবছে সেটা উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। কারণ ভারতে কেবল হিন্দিভাষী মানুষ বাস করে না; ভারত বহুভাষী মানুষের আবাসভূমি।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

রবিবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০১২

সিমলা চুক্তি ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার


২০১১-১২-০৫

ভারত ও পাকিস-ানের মধ্যে সিমলা চুক্তি সম্পাদিত হয় ১৯৭২ সালের ৩ জুলাই। ১৯৭১ সালে ডিসেম্বর মাসের ১৭ দিনজুড়ে হয় ভারত-পাকিস-ান যুদ্ধ। এতে তদানীন-ন পূর্ব
পাকিস-ানে জয়ী হয় ভারত। হারে পাকিস-ান। ভারতের হাতে বন্দী হয় প্রায় ৯৩ হাজার সৈন্য। সিমলা চুক্তি অনুসারে এই ৯৩ হাজার যুদ্ধ বন্দীদের (POW) পাকিস-ানের হাতে ছেড়ে দেয়া হয়। এদের কাউকেই যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচার করা হয় না। এ ছাড়া সিমলা চুক্তিতে ভারত ও পাকিস-ান উভয়ই রাজি হয় যে, ভবিষ্যতে তাদের মধ্যে কোনো বিরোধ দেখা দিলে তার নিষ্পত্তি করতে হবে আলোচনার মাধ্যমে, কোনো যুদ্ধের মাধ্যমে নয়। চুক্তিটির নাম হয় সিমলা চুক্তি। কারণ এটি সম্পাদিত হয় ভারতের হিমাচল প্রদেশের রাজধানী সিমলা শহরে। সিমলায় ভারত ও পাকিস-ান এই দুই দেশরে প্রতিনিধিরা চুক্তির আগে দিয়ে করেন আলোচনা সভা, যা ইতিহাসেখ্যাত হয়ে আছে সিমলা সম্মেলন হিসেবে। এই সম্মেলনে ভারতীয় পক্ষের নেতৃত্ব দেন ভারতের তদানীন-ন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। আর পাকিস-ানের পক্ষের নেতৃত্ব করেন তদানীন-ন প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ জুলফিকার আলী ভুট্টো। এই সম্মেলনে বাংলাদেশকে ডাকাই হয়নি। বাংলাদেশকে ডাকা হয়নি এর একটা কারণ ছিল, জুলফিকার আলী ভুট্টোর আপত্তির কারণে। ভুট্টো আপত্তি তোলেন, ১৯৭১-এর যুদ্ধ হয়েছে ভারত-পাকিস-ানের মধ্যে। বাংলাদেশ নামে তখন কোনো রাষ্ট্র ছিল না।
পাকিস-ান বাংলাদেশের সাথে কোনো যুদ্ধ করেনি। যুদ্ধ করেছে ভারতের সাথে। ঢাকায় রমনার মাঠে পাকিস-ানের পূর্বাঞ্চলের সেনাপতি লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজী ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করেন কেবল ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে। তিনি মুক্তিযুদ্ধের কোনো সেনানায়কের কাছে পৃথকভাবে আত্মসমর্পণ করেননি। তাই সিমলা সম্মেলনে বাংলাদেশের কোনো প্রতিনিধি থাকতে পারে না। যুদ্ধ বাংলাদেশ-পাকিস-ানের মধ্যে হয়নি। হয়েছে কেবল ভারত-পাকিস-ানের মধ্যে। জুলফিকার আলী ভুট্টোর কথায় যুক্তি ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় পরাজিত হয়েছিল জার্মানি। জার্মান সৈন্য পৃথকভাবে আত্মসমর্পণ করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেট ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সেনাপতিদের কাছে। অন্য দিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান পরাজিত হয়ে আত্মসমর্পণ করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেট ব্রিটেন, চীন, নেদারল্যান্ডস, আস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের কাছে পৃথক পৃথকভাবে। অন্য দিকে ১৯৭১-এ পাক বাহিনী কেবলই তদানীন-ন পূর্ব পাকিস-ানে আত্মসমর্পণ করেছিল এককভাবে ভারতীয় বাহিনীর কাছে। ভারত সে দিন বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সেনাপতি জেনারেল মোহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানীকে আসতে দেয়নি রমনার মাঠে। যে কারণেই হোক, তাকে আটকে রাখা হয়েছিল কুমিল্লার ক্যান্টনমেন্টে। ভারত কেন এটা করেছিল তার কোনো ব্যাখ্যা এখন পর্যন- পাওয়া যায়নি। আর এর ফলে ১৯৭১ সালে যুদ্ধ খাতাপত্রে পরিচিত হয়ে আছে কেবল ভারত-পাকিস-ান যুদ্ধ হিসেবে। যদিও ১৯৭১ সালের যুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের সাহায্য-সহযোগিতা ছাড়া পাকিস-ানের সাথে যুদ্ধে কখনই ভারতের পক্ষে জেতা সম্ভব হতো না।
১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস-ানের মধ্যে যে যুদ্ধ হয়, তাতে তদানীন-ন পূর্ব পাকিস-ানের মানুষ গ্রহণ করেনি পাকিস-ানের পক্ষ। ভারত কেবল লড়াই করেছে তার পশ্চিম রণাঙ্গনে। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে যে যুদ্ধ হয়, তা শেষ হয় ১৬ ডিসেম্বরে। ভারত একপক্ষীয়ভাবে ১৭ ডিসেম্বর ঘোষণা করে পশ্চিম পাকিস-ানের যুদ্ধবিরতি। ভারতের ব্রিগেডিয়ার আর এন মিশ্র যুদ্ধশেষে সাংবাদিকদের বলেন, মুক্তিবাহিনীর সহযোগিতা ছাড়া বাংলাদেশে যুদ্ধে জেতা সহজ হতো না। বাংলাদেশের মানুষ আমাদের নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন। তাই আমরা যুদ্ধে বিজয়ী হতে পেরেছি। বাংলাদেশের মানুষ আমাদের বলেছে কোথায় কিভাবে পাক বাহিনী যুদ্ধে অবস'ান নিয়েছে। তারা দিয়েছেন আমাদের গোপন সংবাদ। এসব সংবাদ যুদ্ধে ভারতীয় সৈন্যকে বিশেষভাবে সাহাষ্য করেছে। বাংলাদেশের মানুষ ভারতীয় সৈন্যকে করেছে খাদ্য সরবরাহ। নৌকা দিয়ে সাহায্য করেছে নদী পার হতে। তাদের সাহায্য-সহযোগিতা ভারতের সেনাবাহিনীকে দিয়েছে মনোবল, দিয়েছে গতি। আর তাই ভারতীয় সৈন্য মরেছে কম। অনেক সহজেই যুদ্ধ করতে পেরেছে পাক বাহিনীর সাথে। মিশ্রর এই বিবৃতি থেকে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে ১৯৭১ সালের লড়াইয়ের চেহারা। কিন' পাক বাহিনী যেহেতু আত্মসমর্পণ করেছিল কেবল ভারতীয় সেনাদের হাতে, তাই যুদ্ধটা বিশ্ববাসীর কাছে এ সময় খ্যাত হয় কেবল পাক-ভারত যুদ্ধ হিসেবে। আর সিমলা চুক্তি সম্পন্ন হয় কেবল ভারত ও পাকিস-ানের মধ্যে। এতে বাংলাদেশ কোনো অংশ নিতে পারে না। কেন ১৯৭১-এর যুদ্ধে ভারত মুক্তিযুদ্ধের অধিনায়ককে রমনার ময়দানে আসতে দেয়নি সেটা আমরা বলেছি, এখনো আছে রহস্যময় হয়ে। তবে এর একটা কারণ হতে পারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৩ ডিসেম্বর তাদের বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ এন্টারপ্রাইজকে বাহরাইন থেকে পাঠায় বঙ্গোপসাগরে। অন্য দিকে ভিয়েতনাম থেকে পাঠায় তাদের সপ্তম নৌবহরের একাধিক জাহাজ। এ সময় আমি ছিলাম কলকাতায়। কলকাতায় মানুষকে বলতে শুনেছি, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন নাকি বলেছেন তদানীন-ন পূর্ব পাকিস-ানে যুদ্ধ থামাতে। না হলে মার্কিন সৈন্য অবতরণ করবে তদানীন-ন পূর্ব পাকিস-ানে। তারা ধরে নেবে পূর্ব পাকিস্তান হচ্ছে পাকিস-ানের অংশ। পাকিস্তানের সাথে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোপন সামরিক চুক্তি। যাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানকে প্রতিরক্ষার ব্যাপারে সাহায্য করতে বাধ্য। মার্কিন চাপ ১৯৭১- এর ডিসেম্বরের যুদ্ধকে প্রশমিত করেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি পৃথক বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনে। তার ছিল ভিন্ন রকম পরিকল্পনা। সে ভেবেছিল বাংলাদেশে অনেক সহজে সে তার প্রভাব বিস-ার করতে পারবে। আর বাংলাদেশ হবে পাকিস-ানের চেয়ে তার অনুগত রাষ্ট্র। শেখ মুজিবুর রহমান রাজনীতি করেছেন মার্কিন সমর্থনে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাই ধরেই নিয়েছিল একটা পৃথক বাংলাদেশ হবে তার জন্য বিশেষ সহায়ক রাষ্ট্র; বৈরী রাষ্ট্র নয়। ১৯৭২ সালের ১৫ মার্চ বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে। এর মূলেও ছিল মার্কিন চাপ। ভারত স্বেচ্ছায় বাংলাদেশ থেকে তার সৈন্য সরায়নি। মার্কিন চাপেই সে বাধ্য হয় সৈন্য সরিয়ে নিতে। এসব কথা শুনেছি, একাধিক লোকের মুখে, কলকাতা থেকে দেশে ফেরার পর।
আমি চাকরি করতাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে অনেক অধ্যাপকের কাছে অনেক কথা শুনেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন পাকিস-ানের সমর্থক অধ্যাপক। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থক অধ্যাপক। আর ছিলেন ভারতের সমর্থক অধ্যাপকও। নানা রকম আলোচনা শুনেছি বিশ্ববিদ্যালয় মহলে। এ থেকে যে ধারণা আমার মনে গড়ে উঠেছে, তা হলো ১৯৭১-এর যুদ্ধে শেষ পর্যন- থেকেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপ খুবই প্রবলভাবে। ১৯৭১-এর যুদ্ধের গতি প্রকৃতিকে বিশ্লেষণ করতে হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে করা যায় না। অন্য দিকে ১৯৭১-এ হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের মধ্যে বিশেষ মৈত্রী চুক্তি। এই যুদ্ধে তদানীন-ন সোভিয়েত ইউনিয়নেরও ছিল বিশেষ ভূমিকা। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতকে যুদ্ধে সাহায্য করেছিল নেপথ্যে। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার সোভিয়েত ইউনিয়নকে কথা দেয় যে, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলে চট্টগ্রাম বন্দরে সোভিয়েত ইউনিয়ন পেতে পারবে নৌঘাঁটি গড়ার অধিকার; যদি সে সেটা চায়। চট্টগ্রাম বন্দর থাকবে সোভিয়েত নিয়ন্ত্রণে। সোভিয়েত নৌবাহিনীর জাহাজ ছিল দক্ষিণ ভারতের বিশাখাপত্তম বন্দরে। সোভিয়েত জাহাজ থেকে টর্পেডো ছুড়ে ডুবিয়ে দেয়া হয় পাকিস-ানের ডুবোজাহাজ গাজীকে। গাজী আসলে পাকিস-ানের জাহাজ ছিল না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এটা পাকিস-ানকে ধার দিয়েছিল ১৯৬৪ সালে। নৌযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন অংশ নিয়েছিল। রুশ সেনাপতিরা ১৯৭১-এ ভারতকে রণকৌশল গঠনে দিয়েছিল বিশেষ সাহায্য-সহযোগিতা। পাকিস-ানের যুদ্ধ কেবল হয়ে থাকেনি ভারত-পাকিস-ানের মধ্যে যুদ্ধ। ১৯৭১-এর যুদ্ধ পরোক্ষভাবে হয়েছিল পাকিস-ান-সোভিয়েত যুদ্ধ। রণনীতিতে ভারতীয় সৈন্য উন্নত কৌশল প্রদর্শন করতে পেরেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে আসা বিশেষজ্ঞদের কারণে। অর্থাৎ ১৯৭১-এর পাক- ভারত যুদ্ধ কেবল ভারত-পাকিস-ানের মধ্যকার যুদ্ধ ছিল না। এতে জড়িয়ে পড়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও। ইন্দিরা গান্ধী চাননি যুদ্ধ একটা বৃহত্তর
আন-র্জাতিক রূপ পরিগ্রহ করুক। ভারত তাই যুদ্ধকে সংক্ষিপ্ত করে। আর চায় না পাকিস-ানকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দিতে। সে খুশি হয় সাবেক পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করতে পেরেই। আজ যখন আমি ’৭১-এর যুদ্ধকে ফিরে দেখি, তখন এ রকমই মনে হয় আমার কাছে।
সিমলা চুক্তি নিয়ে বেশ কিছু আলোচনা করেছেন ভারতের একজন বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব পিলু মোদি (Piloo Mody)। পিলু মোদি একটা বই লেখেন ১৯৭৩ সালে। বইটির নাম Zulfi my Friend|। পিলু মোদি ছিলেন জুলফিকার আলী ভুট্টোর বাল্যবন্ধু। তিনি তার বইয়ে জুলফিকার আলী ভুট্টো সম্পর্কে অনেক কিছু লিখেছেন। অনেক কিছু লিখেছেন সিমলা সম্মেলন সম্পর্কে। যা থেকে পাওয়া সম্ভব ইতিহাস লেখার বেশ কিছু উপকরণ। পিলু মোদি হিন্দু সমপ্রদায়ভুক্ত ব্যক্তি নন। তিনি হলেন ভারতীয় পারসি (Parsi) ধর্ম সমপ্রদায়ভুক্ত ব্যক্তি। ভারতে পারসি সমপ্রদায় জনসংখ্যার দিক খেকে খুবই নগণ্য। কিন' অর্থনীতি ও রাজনীতির ক্ষেত্রে এরা হলেন খুবই প্রতিপত্তিশালী। ভারতের সবচেয়ে বড় শিল্পপতি ছিলেন জমসেদজী টাটা (তাতা)। যিনি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন টাটা কোম্পানি। ভারতের রাজনীতিতে পারসিরা রেখেছেন বিশেষ প্রভাব। ভারতের বিখ্যাত রাজনৈতিক দাদাভাই নৌরজি ছিলেন পারসি। নৌরজি প্রথম ভারতীয়দের মধ্যে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে নির্বাচিত হন। এটা ছিল সে সময় একটা বিরাট ঘটনা। মিনুমাসানি ছিলেন ভারতের একজন বিশিষ্ট সমাজতান্ত্রিক নেতা। তিনি তার লেখার মাধ্যমে ভারতীয় রাজনীতিতে রেখেছেন বিশেষ প্রভাব। ভারতের বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক হোমি জাহাঙ্গীর ভবা হলেন পারসি সমপ্রদায়ভুক্ত। মহাজাগতিক রশ্মি নিয়ে এর গবেষণা হয়ে আছে খুবই খ্যাত। ১৯৭১-এর যুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এস এইচ এফ জে মানিক শ (পরে মার্শাল) ছিলেন পারসিক সমাজভুক্ত। পিলু মোদি ছিলেন ভারতীয় পার্লামেন্টের সদস্য এবং ভারতীয় স্বতন্ত্র দলের একজন খুবই নামকরা নেতা। ১৯৭২ সালে যখন সিমলা সম্মেলন হচ্ছিল তখন তিনি যান সিমলায়। দেখা করেন ভুট্টোর সাথে। তিনি তাকে দেন বহুবিধ পরামর্শ। এ রকম করাটা তার পক্ষে সম্ভব হয়েছিল তার বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের কারণেই। ইন্দিরা গান্ধী তাকে বিরত রাখতে পারেননি ভুট্টোর সাথে দেখা ও উপদেশ প্রদান করা থেকে। অন্য কোনো ব্যক্তি হলে তাকে চিহ্নিত হতে হতো ভারতীয় আইনানুসারে দেশদ্রোহী হিসেবে। কিন' পিলু মোদিকে তা হতে হয়নি। পিলু মোদি তার বইয়ে বলেছেন- ইন্দিরা গান্ধী সিমলা সম্মেলনে ওঠান যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে কিছুসংখ্যক ব্যক্তিকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচার করার প্রসঙ্গটি। জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেন, এতে তার আপত্তি নেই। কিন' বিচার হতে হবে জেনেভা কনভেনশন অনুসারে। জেনেভা কনভেনশন অনুসারে যুদ্ধবন্দী হত্যা হলো অন্যতম যুদ্ধাপরাধ। জেনেভা কনভেনশনানুসারে যুদ্ধবন্দীকে হত্যা করা যায় না। কিন' পূর্ব পাকিস-ানে ইপিআর তাদের হাতে ধরা পড়া পাক বাহিনী সৈন্যকে বন্দী অবস'ায় হত্যা করেছে। জেনেভা কনভেনশনানুসারে হতে হবে তাদের বিচার। পিলু মোদি তার বইয়ে বলেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা উঠতে পারত কাদেরিয়া বাহিনী সম্পর্কে। কাদেরিয়া বাহিনীর নেতা কাদের সিদ্দিকী অমানবিকভাবে নির্বিচারে বিহারি হত্যা করেছেন। সেটাও পড়তে পারে যুদ্ধাপরাধেরই মধ্যে। ইন্দিরা গান্ধী তাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পর্কে আর বেশি দূর অগ্রসর হতে চাননি। কারণ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে গেলে দেখা দিত সমূহ জটিলতা। যুদ্ধাপরাধ ঘটেছে দুই পক্ষ থেকেই। এক পক্ষ থেকে নয়।
আন-র্জাতিক নিয়মে করতে হতো যুদ্ধাপরাধের বিচার। আর আন-র্জাতিক নিয়মে বিচার হলে, বিচারে পাকিস-ান পেতে পারত অধিক সুবিধা। এ কথা বলেছেন, পিলু মোদি তার লেখা Zulfi my Friend বইয়ে। পিলু মোদির মতে, জুলফিকার আলী ভুট্টো ও শেখ মুজিবের মধ্যে রাজনৈতিক বিরোধ ছিল যথেষ্ট গভীর। জুলফিকার আলী ভুট্টো ছিলেন বিশেষভাবেই দ্বিজাতিতত্ত্বে বিশ্বাসী। জুলফিকার আলী ভুট্টো ছিলেন সিন্ধি। কিন' তিনি কখনোই তোলেননি সিন্ধি জাতীয়তাবাদের ধ্বনি। কিন' শেখ মুজিব চেয়েছেন পাকিস-ানের মধ্যে থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধ্বনি তুলে পাকিস-ানের প্রধানমন্ত্রী হতে। জনাব ভুট্টো মেনে নিতে পারেননি পাকিস-ানে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে। তিনি মনে করেন বাঙালি জাতীয়তাবাদ দেবে সাবেক পাকিস-ানকে দ্বিখণ্ডিত করে। পরবর্তী ঘটনা ভুট্টোর ধারণাকে, পিলু মোদির মতে, যথার্থ প্রমাণ করেছে।
সিমলা চুক্তি অনুসারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গ আর ওঠা উচিত ছিল না। কিন' এখন নতুন করে উঠছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গ। এর একটি কারণ, বিশ্বরাজনীতির ধারা বিশেষভাবেই বদলে গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক সময় তার পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ করেছে কমিউনিজম রোধের লক্ষ্য সামনে রেখে। এখন তাকে পেয়ে বসেছে জঙ্গি ইসলাম আতঙ্কে। বর্তমানে বাংলাদেশে যাদের যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচার করা হচ্ছে তাদের প্রায় সবাই সাধারণভাবে পরিচিত ইসলামপন'ী হিসেবে। ১৯৭১ সালে এরা সবাই ছিলেন অত্যন- তরুণ। এরা কতটা যুদ্ধাপরাধের সাথে জড়িত ছিলেন সেটা তর্কের বিষয়। শেখ মুজিব চাননি এদের বিচার করতে। কিন' এখন এদের উঠতে হচ্ছে বিচারের কাঠগড়ায়। মনে হচ্ছে, সারা দেশে অনেক যুদ্ধাপরাধী আছে। আর তারা হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের রাজনীতির প্রধান সমস্যা। কয়েক মাস আগে বাংলাদেশে এসেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। মনমোহন সিং বাংলাদেশে সফরে আসার ঠিক আগে দিয়ে বলেন যে, বাংলাদেশ ভরে উঠেছে মুসলিম মৌলবাদে। মুসলিম মৌলবাদী দল জামায়াতে ইসলামীকে সমর্থন করে বাংলাদেশের শতকরা ২৫ ভাগ মানুষ। পরে তিনি তার এই বক্তব্যকে প্রত্যাহার করে নেন। মনে হচ্ছে জামায়াতকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে বিশেষ করে উঠানো হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রসঙ্গটি। এ ক্ষেত্রে আছে ভারতেরও একটি ভূমিকা। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন লাভের আশায় উদ্যোগ নিয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের। অথচ ১৯৭২-এর সিমলা চুক্তি অনুসারে এ রকম বিচার অনুষ্ঠান হওয়া উচিত ছিল না। সিমলা চুক্তির কোনো মূল্য এখন আর নেই।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব মিথ্যা হতে যাচ্ছে

২০১১-১১-২১

কয়েক মাস ধরে শোনা যাচ্ছে, প্রায় এক শ বছর ধরে প্রতিষ্ঠিত জার্মান ইহুদি বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের (১৮৭৯-১৯৫৫) আপেক্ষিক তত্ত্ব নাকি ভুল প্রমাণিত হতে যাচ্ছে। কারণ আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুসারে কোনো কিছুর গতিবেগ আলোর গতিবেগের চেয়ে অধিক হতে পারে না। কিন' বর্তমানে কিছু বৈজ্ঞানিক দাবি করছেন, নিউট্রিনো (Neutrino) নামক মৌলকণিকার গতিবেগ হতে পারে আলোর চেয়ে সামান্য বেশি। যদি এটা আরো পরীক্ষার মাধ্যমে সত্য বলে প্রমাণিত হয়, তবে আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব বাতিল হয়ে যাবে। তাকে ধরে রাখা সম্ভব হবে না। আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের উদ্ভব হয়েছিল মাইকেলসন মার্লির বিখ্যাত পরীক্ষাকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে। এক সময় মনে করা হতো, বিশ্ব পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে এমন কিছু দ্বারা; যা বহন করে আলোক, বিদ্যুৎ ও চৌম্বক তরঙ্গ।
এই এমন কিছুকে বিজ্ঞানীরা বলতেন ইথার। কিন' ইথারের ধারণা সত্য হলে আলোর গতিবেগ সব ক্ষেত্রে এক হতে পারে না। বিভিন্ন দিক থেকে আলোর গতিবেগ নির্ণীত হলে তাতে ধরা পড়ত পার্থক্য। কিন' মাইকেলসন মার্লির পরীক্ষা থেকে দেখা যায়, এরকম পার্থক্য ঘটছে না। আলোর গতিবেগ সব দিক থেকে হচ্ছে সমান। আইনস্টাইন তার আপেক্ষিক তত্ত্বে চান এর কারণ ব্যাখ্যা করতে। এটা করতে গিয়ে বাতিল হয়ে যায় ইথারের ধারণা। আপেক্ষিক তত্ত্বে বলা হয়, আলোর গতিবেগ সর্বত্র সমান হতে বাধ্য। এটা দেখানো হয় বিশেষ গাণিতিক সূত্রের দ্বারা। আপেক্ষিক তত্ত্ব থেকে আসে বস'র আপেক্ষিক জড় মানের (Relative Mass) ধারণা। ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জে জে টমসন (J J Thomson) পরীক্ষার মাধ্যমে দেখতে পান, মৌলবস'কণিকা ইলেকট্রনের গতিবেগ বাড়ার সাথে সাথে তার জড়মান বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ তার গতিবেগ বাড়াতে হলে প্রয়োজন হয় আরো অধিক পরিমাণ বলের। এই বলের বৃদ্ধির পরিমাণ বিজ্ঞানী নিউটনের দেয়া সূত্র অনুসারে করা যায় না। আইনস্টাইন ১৯০৫ সালে দেখান, তার আপেক্ষিক তত্ত্বের সাহায্যে এই জড়মান বৃদ্ধির হিসাব সম্ভব। তিনি প্রদান করেন তার বিখ্যাত জড় ও তেজের মধ্যকার সমভরতার (Equivalence of Mass and Energy) ধারণা। এই ধারণা অনুসারে জড়বস'কে ভাবা যায় তেজের একটি ঘনীভূত সুপ্ত রূপ। আইনস্টাইনের এই ধারণা থেকে আসে পরমাণু বোমা তৈরির ভিত্তি। আমাদের দেশে রূপপুরে যে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র স'াপিত হতে যাচ্ছে, তাতে ইউরেনিয়াম পরমাণু ভেঙে বিদ্যুৎ শক্তি উৎপন্ন হবে আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব থেকে প্রাপ্ত সূত্র অনুসরণ করে। পরমাণু বোমার বিস্ফোরণ আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বকে বিশেষভাবে গ্রহণীয় করে তোলে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, আইনস্টাইনের ব্যক্তিগত অনুরোধে
তদানীন-ন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট পরমাণু বোমা নির্মাণের জন্য প্রদান করেন বিপুল অর্থ। আইনস্টাইন ব্যক্তিগতভাবে এক সময় ছিলেন বিশেষভাবে শানি-বাদী ও যুদ্ধের বিরোধী। কিন' তারই ইচ্ছায় উদ্ভব হতে পেরেছে পরমাণু বোমার মতো জনবিধ্বংসী মারণাস্ত্রের উদ্ভব। আপেক্ষিক তত্ত্ব, তত্ত্ব হিসেবে ভুল প্রমাণিত হলেও তার প্রদত্ত জড় ও তেজের সমভরতার হিসাব টিকে যাবে বলেই মনে হয়। আমরা বলেছি, আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুসারে জড়বস'কে মনে করা যায় তেজের (Energy) ঘনীভূত রূপ মাত্র। কিন' এই ধারণাকে অনেকে স্বীকার করতে চাননি। বিষয়টি নিয়ে থেকেছে বিতর্ক। মৌলকণিকাদের (Elementary Particles) দু’টি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়- ফার্মিয়ন (Fermion) ও বোসন (Bosons)। ফার্মিয়ন নামটা এসেছে বিখ্যাত ইতালিয়ান বৈজ্ঞানিক এনডিকো ফার্মির নাম থেকে। অন্য দিকে বোসন নামটি এসেছে বাঙালি বৈজ্ঞানিক সত্যেন্দ্রনাথ বসুর (১৮৯৪-১৯৭৪) নাম থেকে; যিনি এক সময় ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক। বোসন কণিকারা অনুসরণ করে বসু- আইনস্টাইন প্রদত্ত সংখ্যাতত্ত্বের সূত্র। ফার্মিয়ন কণিকা অনুসরণ করে ফার্মি প্রদত্ত সংখ্যাতত্ত্ব (Statistics)। এই দুই সংখ্যাতত্ত্বের মধ্যে পার্থক্য আছে। ফার্মিয়নদের সংখ্যা যেভাবে ঠিক থাকে বোসনদের সংখ্যা সব অবস'ায় সেভাবে ঠিক থাকে না। ফার্মিয়নদের মধ্যে পড়ে ইলেকট্রন, প্রোটনের মতো মৌলকণিকা। পক্ষান-রে বোসনের মধ্যে পড়ে আলোর কণিকা (ফোটন) এবং কিছু মেশন নামক কণিকা। অর্থাৎ পদার্থ বিজ্ঞানে আছে নানা জটিলতা। ১৯৬০ সালে বিখ্যাত ব্রিটিশ পদার্থবিদ জি পি টমসন (G P Thomso) ব্রিটেনে বিজ্ঞান সমিতির এক সভায় বলেন, জড়বস'কে কেবলই তেজের একটা সুপ্ত অবস'া হিসেবে বিবেচনা করা সঙ্গত নয়। অর্থাৎ ১৯৬০-এর দশকে আইনস্টাইনের ধারণা নিয়ে উঠতে পেরেছিল প্রশ্ন। আমি ব্যক্তিগতভাবে পদার্থ বিজ্ঞানের সাথে সংশ্লিষ্ট নই। তাই এ ব্যাপারে কোনো সুনির্দিষ্ট মতামত প্রদান করতে পারি না। কিন' পদার্থ বিজ্ঞানের অনেক ধারণা যুক্ত হয়ে পড়েছে দর্শনের সাথে; যা ভাবায় আমাদের মতো মানুষকেও। মানুষ জন্মায়, বেড়ে ওঠে, বৃদ্ধ হয়; মারা যায়। সময়ের ধারণা মানুষের মধ্যে বিশেষভাবে সৃষ্টি হতে পেরেছে জন্ম-মৃত্যুকে ঘিরেই। আমরা আমাদের জীবনে যেসব ঘটনাকে প্রত্যক্ষ করি তাদের সাজায় সময়ের ভিত্তিতে। ভূত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের ধারণা আমাদের জীবনের ধারণার সাথে, বেঁচে থাকার সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে গ্রোথিত। অন্য দিকে বস'দের আমরা সাজাই স'ানে, নির্দিষ্ট দূরত্বে। এভাবেই গড়ে ওঠে আমাদের ব্যবহারিক জীবনের স'ান-কালের ধারণা। আপেক্ষিক তত্ত্বে স'ান-কালকে দেখা হয় একত্রে। স'ান ছাড়া কালের অসি-ত্ব নেই। আবার কাল ছাড়াও স'ানের অসি-ত্ব নেই। আপেক্ষিক তত্ত্বের স'ান-কালের ধারণা আমাদের ব্যবহারিক জীবনের স'ান-কালের ধারণার সাথে খাপ খেতে চায় না। তার জ্যামিতি হলো যথেষ্ট জটিল। ইউক্লিডের জ্যামিতি থেকে যা হলো ভিন্ন। ইউক্লিডের জ্যামিতিতে সরল রেখার অসি-ত্ব আছে। কিন' আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের জ্যামিতির মাপে সরল রেখার অসি-ত্ব নেই। সব রেখাই কোনো না কোনোভাবে বাঁকা। যা বুঝতে হলে গ্রহণ করতে হয় বার্নার্ড রিম্যানের (Bernhard Riemann) জ্যামিতিকে। আমরা শুনেছি, নিউট্রিনোর (Neutrino) গতি আলোর কণার (Photon) গতির চেয়ে বেশি হতে পারে। এ কথা প্রমাণিত হলে নাকি প্রমাণিত হবে সময় নেগেটিভ হতে পারে, এই ধারণ। কিন' সময় কি কখনো নেগেটিভ হতে পারে? সময় নেগেটিভ হলে, সে ক্ষেত্রে বৃদ্ধ হতে থাকবে যুবক; যুবক হতে থাকবে কিশোর; কিশোর হতে থাকবে শিশু; আর শেষে শিশু প্রবিষ্ট হবে মাতৃগর্ভে। কী বিচিত্র সব ধারণা। যা আমাদের সবাইকে বিস্মিত না করে পারে না। আর তাই বিজ্ঞানীসমাজে কেবল নয়, সবার মধ্যেই উঠছে বিশেষ আলোচনা। কিন' জগৎটা কেবলই অঙ্কের হিসাব নয়। অঙ্কের হিসাবের সীমাবদ্ধতা আছে। কেউ বিশ বছরে তিন হাত লম্বা হলে, চল্লিশ বছরে ছয় হাত লম্বা হয়ে যায় না। বাস-ব জগৎ অনুসরণ করে তার নিজের নিয়ম, যা অঙ্কের হিসাবনির্ভর নয়। বিশুদ্ধ পদার্থ বিজ্ঞান খুব বেশি গণিতের হিসাবনির্ভর। আর এই গণিতের হিসাব থেকে এমন অনেক ধারণা আসে, যা আমাদের মনে জাগায় বিরাট বিস্ময়। যেমনটি জাগাচ্ছে আমাদের মনে সমপ্রতি।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

পানিবিদ্যুৎ উৎপাদন প্রসঙ্গে


২০১১-১২-১২

মানুষ একসময় ঝর্ণার পানিপ্রবাহের সাহায্যে গম পিষবার জন্য জাঁতা ঘুরিয়েছে। সে সময় বিদ্যুৎশক্তি সম্পর্কে মানুষের কোনো ধারণাই ছিল না। ঝর্ণা, জলপ্রপাত, নদীর স্রোতের সাহায্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ধারণা মানুষের মাথায় এসেছে অনেক পরে। ১৮৩১ সালে বিখ্যাত ব্রিটিশ বৈজ্ঞানিক মাইকেল ফ্যারাডে পরীক্ষামূলকভাবে দেখেন যে, চুম্বকের পাশে তারের কুণ্ডলীকে দ্রুত ঘোরালে তার মধ্যে তড়িৎ প্রবাহের উদ্ভব ঘটে। তার এই আবিষ্কারকে নির্ভর করে একাধিক ইঞ্জিনিয়ারের চেষ্টায় ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে এসে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য নির্মিত হয় ডায়নামা। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে ঝর্ণা, জলপ্রপাত, নদীর স্রোতকে বিশেষভাবে কাজে লাগিয়ে শুরু হয় ডায়নামার সাহায্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন। নলের সাহায্যে পানি প্রবাহিত করে ডায়নামার চাকা ঘুরিয়ে যে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়, তাকে ইংরেজিতে বলা হয়ে থাকে হাইড্রো ইলেকট্র্র্র্র্র্র্রিসিটি। বাংলায় আমরা একে বলি, পানি বিদ্যুৎ অথবা জলবিদ্যুৎ। এই উপমহাদেশে প্রথম পানিবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মিত হয় দার্জিলিং শহরে ১৮৯৭ সালে। ঝর্ণার পানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস'া হলো। দার্জিলিংয়ে এটা করা সহজ হয়েছিল, কারণ ঝর্ণার প্রবাহ এখানে সারা বছর প্রায় একই রকম থাকে। এর একটা কারণ হলো, দার্জিলিংয়ে শীতকালেও বেশ কিছু পরিমাণে বৃষ্টি হয়। বৃষ্টির পানি পাহাড় থেকে প্রবাহিত হয় ঝর্ণার আকারে। তবে পানিবিদ্যুৎ উৎপাদন উত্তর ভারতে সেভাবে সাফল্য পেতে পারেনি। দক্ষিণ ভারতের অনেক জায়গায় তা পেয়েছে যথেষ্ট সাফল্য। ব্রিটিশ আমলে কর্ণফুলী নদীর পানিপ্রবাহকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা করা হয়েছিল, যাকে বাস-বে রূপদান সম্ভব হয় পাকিস-ান আমলে। কর্ণফুলী নদীতে এক জায়গায় আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে পানি ধরে রেখে তার প্রবাহের সাহায্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয় ১৯৬২ সাল থেকে। বাংলাদেশের অন্য জায়গা পাহাড়ি নয়। এখানে নদীর ঢাল সামান্য। এ রকম নদীর পানিপ্রবাহ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় না। বিদ্যুৎ উৎপন্ন করার জন্য যথেষ্ট উঁচু থেকে নিচুতে পানি প্রবাহিত হওয়ার প্রয়োজন হয়। এর ফলে পানির স'ায়ীত্তিক শক্তি পরিণত হয় পানির গতিশক্তিতে। পানির গতিশক্তি ঘোরাতে পারে বিশেষভাবে নির্মিত ডায়নামার চাকা। গতিশক্তি থেকে উৎপন্ন হতে পারে তড়িৎশক্তি বা চলতি কথায় যাকে বলা হয় পানিবিদ্যুৎ। পানিবিদ্যুৎ তৈরিতে অনেক ক্ষেত্রে অনেকগুলো বাস-ব অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। পানিবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য অনেক ক্ষেত্রে প্রয়োজন পানি ধরে রাখার জন্য কৃত্রিম হ্রদের। এই হ্রদ থেকে বিশেষ নলের সাহায্যে পানি প্রবাহিত করে এনে ঘোরানো হয় ডায়নামার বিশেষ ধরনের চাকা, যাকে বলা হয় টারবাইন। কৃত্রিম হ্রদে অনেক ক্ষেত্রে জমতে থাকে পলিমাটি। পলিমাটি জমে কৃত্রিম হ্রদ ভরাট হলে পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্র হয়ে পড়ে অকেজো। এ ছাড়া যেকোনো নদীর ওপর আড়াআড়ি বাঁধ নির্মাণ করে আটকালে ওই নদীতে পানির প্রবাহ মন'র হয়। এর ফলে নদীর খাতে জমতে থাকে পলিমাটি। নদীর খাত পলিমাটিতে ভরে গেলে ওই নদী দিয়ে পানিপ্রবাহের সময় সৃষ্টি হয় আগের তুলনায় বেশি বন্যা। কারণ নদীর দুই ধারে নদীর পানি উপচে পড়ে। ইংরেজি ভাষায় ‘ড্যাম’ বলতে বোঝায় কোনো নদীর ওপর দেয়া উঁচু আড়াআড়ি বাঁধকে। ড্যাম কথাটার বাংলা অনেকে করেন ‘ভেড়ি’। ভেড়িবাঁধ দিলে তার এক পাশে নদীর পানি জমে কৃত্রিম হ্রদ সৃষ্টি হয়। ইংরেজিতে ব্যারাজ বলতেও বোঝায় নদীর ওপর দেয়া আড়াআড়ি বাঁধ। তবে এই বাঁধ ভেড়ির মতো অত উঁচু হয় না। এ ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয় না কোনো কৃত্রিম হ্রদের। ব্যারাজ শব্দের বাংলা অনেকে করেন ‘জাঙ্গাল’। গঙ্গার (পদ্মার) ওপর ভারত সরকার নির্মাণ করেছে ফারাক্কা ব্যারাজ। ভেড়ি ও জাঙ্গালের মধ্যে থাকে অনেক পানি কপাট (Sluice Gates)। এগুলো তাদের ইচ্ছামতো খুলে ও বন্ধ করে ভেড়ি ও জাঙ্গালের মধ্যে দিয়ে নদীর পানি প্রবাহিত করা চলে। সাধারণত জাঙ্গাল তৈরি করে কৃষিতে পানি সেচের ব্যবস'া করা হয়। ব্রিটিশ শাসনামলে তখনকার ভারতের সিন্ধু প্রদেশে সিন্ধু নদীর ওপর ১৯৩২ সালে নির্মাণ করা হয়েছিল সক্কর ব্যারাজ। এর ফলে সিন্ধু নদীর পানি বিশেষভাবে সেচের কাজে ব্যবহার করা সম্ভব হয়েছিল। ভারত সরকার ফারাক্কায় যে ব্যারাজ নির্মাণ করেছে, তাতে পশ্চিমবঙ্গে কৃষির কোনো উন্নতি হয়নি। আসলে এই জাঙ্গাল নির্মিত হয়েছিল শীতকালে গঙ্গার পানি আটকে তা বিশেষ খালের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত করে ভাগীরথী নদীতে ফেলার জন্য। এভাবে ভাগীরথী নদীতে শীতকালে পানির প্রবাহ বাড়িয়ে কমানোর চেষ্টা হয়েছিল কলকাতা বন্দরে পলি জমার সমস্যাকে। কিন' বাস-বে এই সমস্যার সমাধান হয়নি। ফারাক্কা জাঙ্গালে গঙ্গার পানির ধাক্কা খেয়ে এখন গঙ্গার খাত ক্রমেই সরে যাচ্ছে উত্তরে; পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলার দিকে। মালদহ জেলায় এর জন্য সৃষ্টি হচ্ছে বড় রকমের ভাঙন। গঙ্গা নদী ক্রমেই উত্তর দিকে সরে যাবে। উত্তর দিকে সরে যেয়ে তা নতুন খাতে প্রবাহিত হতে থাকবে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে। এ রকমই অনুমিত হচ্ছে। আর তাই ফারাক্কায় যে জাঙ্গাল নির্মিত হয়েছে তা হয়ে পড়বে বিশেষভাবে অকেজো। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ফারাক্কা হলো মুর্শিদাবাদের একটি গ্রামের নাম। ফারাক্কা জাঙ্গালের এক দিকে হলো এই গ্রাম।
এখন আমরা শুনছি ভারতের মনিপুর রাজ্যে বরাক নদীর ওপর একটি ভেড়ি নির্মাণের সিদ্ধান- গ্রহণ করা হয়েছে, যার সাহায্যে বরাক বা বক্রবাক নদীর পানি আটকে করা হবে বিদ্যুৎ উৎপাদন। বরাক নদীর উদ্ভব হয়েছে নাগা মনিপুর জলপ্রপাত থেকে। বরাক নদী মনিপুরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে এসে প্রবেশ করেছে আসামের কাছাড় জেলায়। ওই জেলার মধ্য দিয়ে তা প্রবাহিত হয়ে এসে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশের সিলেট জেলায়। সিলেটে জেলায় প্রবেশ করে তা দু’টি শাখানদীতে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। একটি শাখার নাম হলো সুরমা আর একটি শাখার নাম কুশিয়ারা। কুশিয়ারা নদীকে এক সময় বলা হতো বক্রবাক বা বরাক। কিন' এখন আর তা বলা হয় না। কুশিয়ারা ও সুরমা নদী একত্র হয়ে উদ্ভব ঘটেছে কালনী নামক নদীর। কালনী নদী এসে পড়েছে ব্রহ্মপুত্রে। কালনী ও পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের মিলিত প্রবাহের নাম হলো মেঘনা। টিপাই একটি নদীর নাম। টিপাই নদীর উদ্ভব হয়েছে ভারতের মিজোরাম প্রদেশের লুসাই পাহাড়ে। সেখান থেকে তা প্রবাহিত হয়ে এসে মনিপুরে মিলিত হয়েছে বরাক নদীর সাথে। যেখানে বরাকের সাথে টিপাই নদী মিলিত হয়েছে তার কাছের একটি গ্রামের নাম হলো টিপাইমুখ। এই টিপাইমুখ গ্রামে টিপাই ও বরাক নদীর মিলিত ধারা, যা বরাক নামেই পরিচিত, তার ওপর নির্মাণ করা হচ্ছে টিপাই পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এর জন্য নির্মাণ করা হচ্ছে ভেড়ি। এই ভেড়ি নির্মাণ করা হলে বরাক নদীতে আর আগের মতো পানি আসবে না। বরাক নদীতে পানির অভাব হলে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে আসামের কাছাড় জেলা। ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ। সুরমা ও কুশিয়ারা নদীতে ঘটবে পানির অভাব। পানির অভাব ঘটবে মেঘনা নদীতেও। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বলছেন, টিপাইমুখে ভেড়ি নির্মাণে বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি হবে না। কিন' ক্ষতি হওয়ার বেশ সম্ভাবনা আছে। আর তাই প্রয়োজন মনমোহন সিংয়ের বচনকে যাচাই করে গ্রহণ করা। নেপাল ও ভারতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে কুশি নদী। নেপাল-ভারত সীমানে- ভারত কুশি নদীর ওপর নির্মাণ করেছে জাঙ্গাল। এই জাঙ্গালের দরুন কুশি নদীতে নেপালে এবং ভারতের বিহার প্রদেশে এখন আগের চেয়ে হচ্ছে অনেক বেশি বন্যা। ২০০৮ সালে কুশি নদীতে যে বন্যা হয়েছে তার ফলে নেপালে গৃহহীন হয়েছে ৫০ হাজার এবং বিহারে নাকি ৩০ লাখ মানুষ। নেপাল অভিযোগ করেছে, ভারত কুশি নদীর ওপর যে জাঙ্গাল তৈরি করেছে, তার জন্য দেয়া উচিত ছিল নদীর দুই তীরে বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য শক্ত করে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ (Embankment)। কিন' ভারত সেটা দেয়নি। এ ছাড়া ভারত কর্তৃপক্ষ বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ মেরামতে দেখিয়েছে উদাসীনতা এতে দুর্বল বাঁধ ভেঙে হতে পেরেছে ভয়াবহ বন্যা। নেপালের এই অভিযোগ কতটা সত্য, আমরা তা বলতে পারি না। বরাক নদীর ওপর ভেড়ি নির্মাণের ফলে হতে পারে এ রকম বন্যা। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে মনিপুর, আসামের কাছাড় এবং বাংলাদেশের সিলেট জেলার অধিবাসীরা। মনমোহন সিং বলছেন, টিপাই ভেড়ি বাংলাদেশের কোনো ক্ষতির কারণ হবে না। কিন' তা অবশ্যই হতে পারে একাধিকভাবে ক্ষতির কারণ। বাংলাদেশের মানুষ রাজনৈতিক কারণে টিপাই ভেড়ির বিরোধিতা করছেন না। বিরোধিতা করছেন ভৌগোলিক কারণে। বরাক কেবল ভারতের নদী নয়, বাংলাদেশেরও। তাই আন-র্জাতিক প্রথানুসারে বরাক নদীর ওপর কোনো পরিকাঠামো নির্মাণ করার আগে ভারতের উচিত বাংলাদেশকে এর সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোকে যথাযথভাবে জানানো। কিন' ভারত তা জানাতে চাচ্ছে না। কোনো পানিবিদ্যুৎ জননকেন্দ্র স'াপনে আগে ভালো করে হিসাব করা উচিত, যে নদী থেকে শক্তি সংগ্রহ করা হবে, তার অববাহিকা থেকে কত পানি প্রতি বছর ওই নদীতে এসে পড়ে। এর কত অংশ মাটিতে শুষে নেয়। বছরের কোন সময়ে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয় এবং নদীতে সর্বাপেক্ষা পানির পরিমাণ ও পানির স্রোত সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে, আর কখনোই বা নদীতে সবচেয়ে কম পানি থাকে। বরাক নদীতে জুন থেকে অক্টোবর মাস পর্যন- সবচেয়ে বেশি পানি থাকে। কারণ এই সময় ওই অঞ্চলে আমাদের দেশের মতোই দক্ষিণ-পশ্চিম মওসুমি বায়ুর প্রভাবে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়। অন্য সময় কিছু বৃষ্টিপাত হলেও তার পরিমাণ খুব কম। আবার সব বছরে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ সমান হয় না। সে জন্য বরাক নদীতে আমাদের দেশের নদীর মতোই সব সময় পানির প্রবাহ একই থাকে না। এর জন্য নদীর পানিপ্রবাহের গতিশক্তি কমবেশি হয়। পানিবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বরাক নদীতে দিতে হবে যথেষ্ট উঁচু ভেড়ি; যাতে কৃত্রিম হ্রদ বা পানি সঞ্চয় আধারের আয়তন ও গভীরতা এমন হতে পারে যে,পানির স্রোত শীত ও গ্রীষ্ম উভয়কালেই ইচ্ছামতো নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আমরা বরাক নদীর পানিপ্রবাহ সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞাত নই। ভারত সরকার এ নদী সম্পর্কে আমাদের দিতে চাচ্ছে না প্রাসঙ্গিক তথ্য ও উপাত্ত। ভারত সরকারের আচরণ আমাদের কাছে তাই মনে হচ্ছে রহস্যজনক। আমরা তাদের আশ্বাসে পারছি না আশ্বস্ত হতে। বাংলাদেশের মানুষ তাই ভারত সরকারের ওপর হচ্ছে ক্ষুব্ধ। কিছু ব্যক্তি বাংলাদেশে এই ক্ষোভকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক লক্ষ্য পূরণের চেষ্টা করতে পারেন। কিন' বাংলাদেশের মানুষের এ ক্ষেত্রে সাধারণ ক্ষোভ কেবল ভারতবিরোধী মনোভাব থেকে উদ্ভূত হচ্ছে- এ রকম ভাবার কোনো কারণ নেই। ভারত সরকার ১৯৭৫ সালে বলেছিল, ফারাক্কা জাঙ্গাল বাংলাদেশের জন্য কোনো ক্ষতির কারণ হবে না। কিন' আমরা এখন আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারছি যে, এই জাঙ্গাল বাংলাদেশের জন্য হয়ে উঠেছে এক মহা ক্ষতিরই কারণ। বাংলাদেশের মানুষের ক্ষোভ হলো যথেষ্ট বাস-ব অভিজ্ঞতাভিত্তিক। এর মূলে কেবলই কোনো ভারতবিরোধী রাজনীতি কাজ করছে না- এটা থাকতে হবে ভারতীয় নেতাদের উপলব্ধিতে, যদি তারা চান ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে মসৃণ করে তুলতে।
সম্প্রতি বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে বিবেচনা করে। কারণ বাংলাদেশ হলো একটা গণতন্ত্রমনা উদার, মুসলিম অধ্যুষিত দেশ। জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ ছোট রাষ্ট্র নয়। বাংলাদেশের মানুষ যথেষ্ট কর্মঠ এবং রাজনীতি সচেতন। সর্বোপরি বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস'ান এমন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই দেশটিকে তার নীতিনির্ধারণে গুরুত্ব না দিয়ে পারে না।’ মজিনা বলেছেন, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।’ যদি তা-ই হয় তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নদীর পানি নিয়ে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে যে সমস্যার উদ্ভব হয়েছে, তাতে মধ্যস'তা করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র এখন ভারতের সাথে বিশেষ মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ। তাই যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব আগের তুলনায় এখন অনেক সহজেই পড়তে পারে ভারতের ওপর। নদী বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের যথেষ্ট অভিজ্ঞতা আছে। একসময় নদী নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হয়েছিল কানাডা ও মার্কিন যুক্তরষ্ট্রের মধ্যে। কিন' এই বিরোধ নিষ্পত্তি হতে পেরেছে খুবই শানি-পূর্ণভাবে। একসময় নদী নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকোর মধ্যে। কিন' এই বিরোধও তারা মেটাতে পেরেছেন শান্তিপূর্ণভাবে। মার্কিন সদিচ্ছা ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে এনে দিতে পারে নদী-বিরোধের ক্ষেত্রে একটি শানি-পূর্ণ সমাধান। যুক্তরাষ্ট্র অতীতে এই অঞ্চলের রাজনীতিতে রেখেছে বিশেষ প্রভাব। ১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস-ান যুদ্ধ সংক্ষিপ্ত হতে পেরেছিল মার্কিন চাপে। যুক্তরাষ্ট্রের চাপে ভারত বাংলাদেশ থেকে সৈন্য সরিয়ে নিয়েছিল ১৯৭২ সালের ১৫ মার্চের মধ্যে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই উপমহাদেশের রাজনীতিতে এখনো যথেষ্ট প্রভাব ফেলতেই পারে।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট
গত সংখ্যার সংশোধনী
গত সংখ্যায় ভুলবশত ছাপা হয়েছিল- ‘প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় পরাজিত হয়েছিল জার্মানি। জার্মান সৈন্য পৃথকভাবে আত্মসমর্পণ করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেট ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সেনাপতিদের কাছে।’ আসলে সেখানে হবে- ‘প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মতো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও পরাজিত হয়েছিল জার্মানি। জার্মান সৈন্য পৃথকভাবে আত্মসমর্পণ করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেট ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সেনাপতিদের কাছে।’

দেশের সার্বভৌমত্ব


২০১১-১২-১৯

॥ এবনে গোলাম সামাদ ॥

ক’দিন আগে (১৪ ডিসেম্বর, ২০১১; বাংলাদেশ প্রতিদিন) পত্রিকার একটি খবর চোখে পড়েছিল। শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা: আলিম চৌধুরীর স্ত্রী শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী বলেছেন, ১৯৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হওয়া প্রয়োজন। কারণ তাদের বিচার না হলে বাংলাদেশ পাকিস-ানে রূপান-রিত হবে। তিনি আরো বলেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার্থে বিএনপি ও জামায়াতের কার্যক্রম শহীদদের অবমাননার শামিল। হীন এই কার্যক্রমের জন্য এদের নেতা ও কর্মীদের শাসি- দেয়া উচিত।
১৯৭১ সালে আমি দেশে ছিলাম না। ১৯৭১ সালে এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে আমি চলে যাই কলকাতায়। আর সেখানেই কাটে ১৯৭১ সাল। কলকাতা থেকে দেশে ফিরেছিলাম ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। দেশের বহু ঘটনাই কলকাতায় বসে যথাযথভাবে অবহিত হতে পারিনি। অনেক ঘটনার কথা জেনেছি কলকাতা থেকে দেশে ফেরার পর। শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যা ছিল একটি ভয়াবহ ও ঘৃণ্য কাজ। কিন' কারা কী লক্ষ্যে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল সেটা আমার কাছে এত দিন পরেও স্বচ্ছ হতে পারেনি। যেসব বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছিল তাদের মধ্যে সবচেয়ে খ্যাতনামা ব্যক্তি হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে সদ্য ইন্তেকাল করা জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর ভাই মুনীর চৌধুরীকে। মুনীর চৌধুরীর সাথে আমার কোনো ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল না। তবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে খুব কাছ থেকে একবার তার বক্তৃতা শোনার সুযোগ হয়েছিল। বক্তৃতাটি শেষ পর্যন- হয়ে উঠেছিল বিশেষভাবেই রাজনৈতিক। সে সময় আমার কিছু সহকর্মীর মুখে শুনেছিলাম মুনীর চৌধুরী চীনপন'ী কমিউনিস্ট ভাবধারায় দীক্ষিত ব্যক্তি। আমি ঠিক বলতে পারি না তাদের এই ধারণা কতটা গ্রহণযোগ্য। কিন' তার চিন্তাচেতনা যে মস্কোপন'ী কমিউনিস্টদের ধারার সাথে ছিল না, সেটা অনুমান করতে পেরেছিলাম। ১৯৭১ সালে এ দেশের চীনপন'ী কমিউনিস্টরা সাবেক পাকিস-ানকে ভেঙে দেয়ার পক্ষে ছিলেন না। তারা নারাজ ছিলেন ১৯৭১-এর যুদ্ধকে মুক্তিযুদ্ধ বলতে। আলবদর আর রাজাকারদের সাথে সে সময় বামপন'ী কমিউনিস্টদের কোনো সঙ্ঘাত ছিল না, ছিল না রেষারেষি। কেন তারা মুনীর চৌধুরীর মতো একজন ব্যক্তিকে হত্যা করতে যাবে, সেটা আমার হিসাবে মেলে না। মুনীর চৌধুরীকে যদি হত্যা করা না হতো তবে এই হত্যার প্রচলিত ব্যাখ্যা আমার কাছে সহজেই গ্রহণযোগ্য হতো। কিন' তা এখন হতে পারে না মুনীর চৌধুরী নিহত হওয়ার কারণে। মুনীর চৌধুরীর বড় ভাই কবীর চৌধুরী যত দূর জানি ছিলেন দক্ষিণপন'ী কমিউনিস্ট ঘেঁষা। অর্থাৎ যাদের বলা হতো মস্কোপন'ী কমিউনিস্ট, তিনি ছিলেন তাদেরই সাথে। কিন' তাকে হত্যা করা হয়নি। হত্যা করা হয়েছে মুনীর চৌধুরীকে। ১৯৭১ সালে এ দেশের দক্ষিণপন'ী কমিউনিস্টরা পুরোপুরি হাত মিলিয়েছিলেন শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে। কিন' তাদের কেউ খুন হননি আলবদর রাজাকারদের হাতে। অন-ত আমার জানা মতে। ১৯৭১-এর অনেক ঘটনাই তাই আমার হিসাবে মিলতে চায় না। যত দূর জানি, কবীর চৌধুরীর আরেক ভাই ছিলেন, বিশেষভাবেই পাকিস-ানপন'ী। পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করার সময় তিনি বাংলাদেশ ত্যাগ করেন বর্তমান পাকিস-ানের লক্ষ্যে। আমার মনে পড়ছে জহির রায়হানের কথা। জহির রায়হানের সাথে আমার পূর্বপরিচয় ছিল না। পরিচয় হয় কলকাতায়। জহির রায়হান ছিলেন চীনপন'ী কমিউনিস্ট। কেন তিনি ১৯৭১-এ কলকাতায় গিয়েছিলেন আমি তা জানি না। কলকাতায় তার কোনো আশ্রয় ছিল না। আমি তাকে একটা অস'ায়ী আশ্রয়ের ব্যবস'া করে দিতে পেরেছিলাম। আমি এটা করে দিয়েছিলাম তার জীবন থেকে নেয়া ছায়াছবি দেখে ভালো লেগেছিল বলে; তিনি চীনপন'ী ছিলেন বলে নয়। জহির রায়হান ১৯৭২ সালে মারা যান রহস্যজনকভাবে। ঢাকা এই সময় ছিল ভারতীয় বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। পাকবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে নয়। আলবদর, রাজাকারেরা যে তাকে মেরে ফেলেনি সেটাও সুনিশ্চিত। কিন' তার মৃত্যু এখনো হয়ে আছে রহস্যাবৃত। জহির রায়হানকে সম্ভবত মেরে ফেলা হয় তার রাজনৈতিক বিশ্বাসের জন্য। ১৯৭১-এ আমি ছিলাম কলকাতায়। কলকাতায় সিপিআই (এম) সমর্থকদের বলতে শুনেছি, শেখ মুজিব হলেন মার্কিন অ্যাজেন্ট। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্দেশে তিনি ধরা দিয়েছিলেন ইয়াহিয়ার হাতে। তিনি আসলে স্বাধীন বাংলাদেশ হওয়ার পক্ষে নন। কলকাতায় থাকার সময় আমি পশ্চিম বাংলার গ্রামে গিয়েছি। পশ্চিম বাংলার মুসলমানেরা ছিলেন ১৯৭১-এর যুদ্ধের বিশেষ বিরোধী। তাদের বক্তব্য ছিল এটা কোনো মুক্তিযুদ্ধ নয়। ইন্দিরা গান্ধী ষড়যন্ত্র করে ভেঙে দিতে চাচ্ছেন পাকিস-ানকে। এটা আসলে হলো তার ষড়যন্ত্রেরই ফল। শেখ মুজিবুর রহমান ঠিক কী চেয়েছিলেন আমার কাছে এখনো তা স্বচ্ছ নয়। তিনি ৭ মার্চ রমনা ময়দানে যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, তাতে তিনি দাবি করেন, তিনি হলেন পাকিস-ানের সংখ্যাগুরু দলের নেতা। তাই তার আছে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার অধিকার। কিন' ইয়াহিয়া সেটা হতে দিচ্ছেন না। তাই এবারের সংগ্রাম হয়ে উঠেছে মুক্তির সংগ্রাম। আমার মনে হয়, ইয়াহিয়া যদি আইনানুসারে শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী করতেন তবে সাবেক পাকিস্তান ভেঙে পড়ত না। ১৯৭১-এ যা ঘটেছে সেটা ঘটতে পেরেছে তদানীন-ন পাকিস-ানের সামরিক জান্তার রাজনৈতিক ভুলের কারণেই। ১৯৭২ সালের ৩ জানুয়ারি শেখ মুজিব মুক্তি পান পাকিস্তানের কারাগার থেকে। কিন' পাকিস-ানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে তিনি ভারত হয়ে বাংলাদেশে আসেননি। তিনি ৮ জানুয়ারি পাকিস্তান থেকে যান গ্রেট ব্রিটেনে। সেখানে দেখা করেন গ্রেট ব্রিটেনের তদানীন-ন প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ-এর সাথে। কেন তিনি পাকিস-ান থেকে গ্রেট ব্রিটেনে যাওয়ার সিদ্ধান- নিয়েছিলেন সেটা এখনো রয়েছে অজ্ঞাত। সাংবাদিক অ্যান'নি মাসকারেনহাস তার বহুল পঠিত বাংলাদেশ : এ লিগ্যাসি অব ব্লাড বইয়ে বলেছেন, শেখ মুজিব তাকে (মাসকারেনহাস) বলেন যে, তিনি (শেখ মুজিব) পাকিস-ানের সাথে সম্পর্ক ছেদ চাচ্ছেন না। রাখতে চাচ্ছেন একটা বিশেষ রকমের সংযোগ (Link)। তবে এই সম্পর্কে তিনি বিস্তারিতভাবে কিছু আলোচনা করতে ইচ্ছুক নন, যা বলার তা তিনি বলবেন বাংলাদেশে যেয়ে, তার সহকর্মীদের সাথে আলোচনা করার পরে। শেখ মুজিব ১৯৭২ সালের ৩ জানুয়ারি কারামুক্ত হয়ে চার দিন পাকিস-ানে ছিলেন। এই ক’দিন তার সাথে তদানীন-ন পাকিস-ানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টোর অনেক আলোচনা হয়েছিল। এসব আলোচনার একটা প্রভাব সম্ভবত পড়েছিল তার ওপর। ভুট্টো তাকে বলেছিলেন, বাংলাদেশ দখল করেছে ভারতীয় বাহিনী। একমাত্র শেখ মুজিব তার বিপুল জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণমুক্ত করতে পারেন। না হলে বাংলাদেশ কার্যত চলে যাবে ভারতের নিয়ন্ত্রণে। প্রকৃত পরিসি'তিকে বোঝার জন্য শেখ মুজিব যান ব্রিটেনে। বিলাতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে এ বিষয়ে অবগত হতে চান তিনি। শেখ মুজিব ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশে ফেরার পর তাজউদ্দীনের সাথে তার গুরুতর মতভেদ ঘটে। একপর্যায়ে তাজউদ্দীন বাদ পড়েন মন্ত্রিপরিষদ থেকে। অনেক ঘটনাই নেপথ্যে ঘটেছিল। ১৯৫৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তদানীন-ন পাকিস-ানের হয়েছিল একটি গোপন চুক্তি। এই চুক্তির কারণে, ১৯৭১-এর ১৪ ডিসেম্বর কয়েকটি মার্কিন রণতরী ও বিমানবাহী জাহাজ এন্টারপ্রাইজ এসে পৌঁছায় বঙ্গোপসাগরে। মার্কিন চাপে ভারত বাধ্য হয়েছিল যুদ্ধ থামাতে এবং প্রধানত মার্কিন চাপেই ১৯৭২ সালের ১৫ মার্চের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ভারত তার সৈন্য সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিল। সেটা ছিল ঠাণ্ডা লড়াইয়ের যুগ। ঠাণ্ডা লড়াইয়ের জন্য ঘটতে পেরেছিল অনেক ঘটনা। ভারত ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন ছিল এক অক্ষে। এখন অবস'া সম্পূর্ণ বদলে গেছে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়েছে। কমিউনিজম এখন আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কোনো সমস্যা নয়। এখন তাকে পেয়ে বসেছে জঙ্গি ইসলাম আতঙ্কে। তার পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে এই আতঙ্ক রাখছে বিশেষ প্রভাব। ইসলাম এখন হয়ে উঠেছে বিশ্বরাজনীতির একটা উল্লেখযোগ্য উৎপাদক (Factor)। যেটা ১৯৭১-৭২ সালে ছিল না। বর্তমান বিশ্বপরিসি'তি সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপ ধারণ করেছে। ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন অবস'ান করছে একই অক্ষে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি এক দিকে যেমন নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে ইসলাম আতঙ্ক দিয়ে, অন্য দিকে তেমনি আবার নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে চীন আতঙ্ক দিয়ে। এই দুই আতঙ্ক নির্ধারণ করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছে ভারতকে দিয়ে এশিয়ায় চীনকে সংযত রাখতে। এই পরিসি'তিতে বাংলাদেশকে ভাবা উচিত অনেক ভিন্নভাবে। কিন' আমরা সেটা করতে যাচ্ছি না। আমরা এখনো থাকতে চাচ্ছি ১৯৭১-এর যুগে। আমাদের চিন্তা থেমে আছে ১৯৭১-এর জগতে। সেটাকে বলতে হবে জাতির অসি-ত্বের জন্য বিপজ্জনক।
ভারতের পত্রপত্রিকার খবর অনুসারে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ থেকে নাকি প্রায় দুই কোটি লোক চলে গিয়েছেন ভারতে। যারা ভারতের জন্য হয়ে উঠেছেন বিশেষ সমস্যার কারণ। সুব্রামনিয়ান এক সময় ছিলেন ভারতের প্রতিরক্ষা বিভাগের সাথে সংশ্লিষ্ট। এখন তিনি হলেন ভারতের বিজেপি দলের নেতৃস'ানীয় ব্যক্তি। তিনি বলেছেন যে, ভারতের উচিত হবে খুলনা ও সিলেট অঞ্চলের কিছু জায়গা দখল করা। এই জায়গা দখল করে সেখানে বাংলাদেশ থেকে ভারতে চলে আসা দুই কোটি লোকের বাসস'ানের ব্যবস'া করে দেয়া। সুব্রামনিয়ান ভারতের একজন সাধারণ নাগরিক নন। তার চিন-াধারা ভারতকে তার নীতিনির্ধারণে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। আমাদের দেশে কথিত বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিতরা এই ব্যাপারটি নিয়ে কোনো কিছু ভাবছেন কি না আমি সে সম্পর্কে জ্ঞাত নই। পত্রপত্রিকায় প্রচার চলছে ১৯৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের শাসি- না দিলে বাংলাদেশ আবার পরিণত হবে পাকিস্তানে। ছড়ানো হচ্ছে ইচ্ছাকৃতভাবে পাকিস-ান-বিদ্বেষ। কিন' পাকিস-ান-বিদ্বেষ ছড়িয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সুরক্ষিত করা যাবে না। আমাদের ভাবতে হবে বর্তমান পরিসি'তির উপযোগীভাবে। কোনো জাতির জীবনে একটি যুদ্ধই শেষ যুদ্ধ হয় না। অনেক যুদ্ধ করেই বাঁচতে হয় একটা জাতিকে। আমাদের জাতীয় জীবনে ১৯৭১-এর যুদ্ধকে শেষ যুদ্ধ ভাবার কোনো কারণ আছে বলে আমার মনে হয় না। এ দেশের মানুষ এখন আর একাত্তরের মতো ভারতপ্রেমী হয়ে নেই। দেশে ভারতবিমুখী প্রবণতার সৃষ্টি হয়েছে বিএনপি ও জামায়াতের রাজনীতির কারণে নয়। বাংলাদেশের প্রতি ভারতের ব্যবহার এ দেশের মানুষের মনোভাবকে করে তুলছে ভারতবিমুখী। এটা কোনো পাকিস-ান-প্রবণতার পরিচয় বহন করছে না। পাকিস-ান বাংলাদেশ থেকে ১৭০০ কিলোমিটার দূরে। সে আর আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য কোনো হুমকি সৃষ্টিকারী দেশ নয়। কিন' ভারত আছে আমাদের তিন দিক ঘিরে। ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক কারণে এ দেশের মানুষ বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারতের উদ্দেশ্য নিয়ে সচেতন হয়ে উঠেছে এবং হয়ে উঠছে সন্দিহান। তারা চাচ্ছে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করতে। দেশকে আবার পাকিস-ান বানাতে নয়। খবরে প্রকাশ, চীন পাকিস-ান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরে প্রয়োজনে সৈন্য সমাবেশ ঘটাতে পারে। ভারত বাংলাদেশকে কব্জা করতে চাইলে চীন কী নীতি গ্রহণ করবে সেটা আমাদের কাছে এখনো জল্পনারই বিষয়। তবে মনে হয় এই উপমহাদেশে একটা বড় রকমের যুদ্ধ হতে পারে। আর আমাদের প্রস'ত থাকা প্রয়োজন এই যুদ্ধের জন্য। প্রাচীন যুগে যুদ্ধ হয়েছে রাজায় রাজায়। যুদ্ধ সীমাবদ্ধ থেকেছে দু’টি রাজার সেনাবাহিনীর মধ্যে। কিন' এখন যুদ্ধ হয় দেশে দেশে। যুদ্ধ হয়ে ওঠে ‘টোটাল ওয়ার’ বা সামগ্রিক যুদ্ধ। এতে জড়িয়ে পড়ে একটি দেশের সমগ্র জনসমষ্টি। যুদ্ধ একটি ক্ষতিকর ভয়াবহ ঘটনা। কিন' এর জন্য প্রস'ত থাকতে হয় একটি দেশের প্রতিটি নাগরিককে। আমাদেরও প্রস'ত থাকতে হবে।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

রাশিয়ায় উদার গণতন্ত্রের অভিযাত্রা ও আমরা


২০১২-০১-০২

১৯৯১ সালের ডিসেম্বর মাসে রাশিয়ায় কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতাচ্যুত হয়। এই ক্ষমতাচ্যুতিতে কোনো রক্তপাত ঘটেনি। শান্তিপূর্ণভাবেই রাশিয়ায় ঘটতে পেরেছে বিরাট এক রাজনৈতিক পরিবর্তন, যার কথা আগে ভাবা যায়নি। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল ১৫টি প্রজাতন্ত্রের সমন্বয়ে গঠিত। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে ঘটেনি কোনো রক্তপাতের ঘটনা। এটাও বিশেষ লক্ষণীয় ঘটনা। রাশিয়ায় কিছু দিন আগে রুশ পার্লামেন্টের (দুমা) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। কিন' এই নির্বাচন নিয়ে এখন সৃষ্টি হয়েছে সংশয়। বলা হচ্ছে, রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ভ্লাদিমির পুতিন নির্বাচনে কারচুপি করে বিজয়ী হয়েছেন। রাশিয়ায় উঠেছে এই নির্বাচন বাতিল করে নতুন নির্বাচন করার দাবি। মস্কোসহ রাশিয়ার বিভিন্ন শহরে মানুষ করছে পথসভা, করছে মিছিল। বলছে, পুতিন ক্ষমতা ছাড়ো। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট মেদভেদেভ নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে কি না সেটা অনুসন্ধান করার জন্য নির্দেশ প্রদান করেছেন। যদি প্রমাণ হয়, নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে, তবে তার ফল কী দাঁড়াবে আমরা তা বলতে পারি না। পুতিন বলছেন, সে দেশের মানুষ পথে নামছে, বিক্ষোভ করছে; এর মূলে আছে মার্কিন অর্থের প্রভাব। রাশিয়া একটা অনেক প্রাচীন দেশ। রুশরা যথেষ্ট দেশপ্রেমিক। পুতিনের অভিযোগ রুশ জনমতকে খাটো করে দেখছে। একসময় রুশ কমিউনিস্ট পার্টি বলত, তাদের বিরুদ্ধে যারা, তারা সবাই ‘শ্রেণিশত্রু’ আর সাম্রাজ্যবাদীদের অর্থপুষ্ট। পুতিনের কথায় শোনা যাচ্ছে কতকটা সেই পুরনো সুরের সঙ্গীত। কিন' রুশ জনমত এখন যে পরিসি'তিতে এসে পৌঁছেছে, তাতে এই যুক্তি তাদের ওপর খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারবে বলে মনে হয় না। রাশিয়া আর ফিরে যাবে না অতীতের একদলীয় শাসনব্যবস'ায়। রাশিয়ায় বলবৎ থাকবে বহুদলীয় গণতন্ত্র। রাশিয়া একটি বিরাট সামরিক শক্তি। রাশিয়ায় রয়েছেন প্রথম শ্রেণীর বহু বৈজ্ঞানিক ও কৃৎকৌশলী। তারা সবাই উদার গণতন্ত্রের পক্ষে। পুতিন এদের টপকে এক দলের শাসনব্যবস'াকে ফিরিয়ে আনতে পারবেন বলে মনে হয় না। পুতিনের রাজনীতির পেছনে কাজ করছে উগ্র রুশ জাতীয়তাবাদ। কিন' এই জাতীয়তাবাদ একদলীয় শাসনের পক্ষে নয়। এই জাতীয়তাবাদ নয় জার্মানির নাৎসি জাতীয়তাবাদের মতো। নাৎসি জার্মান জাতীয়তাবাদ চেয়েছে এক দলের শাসনব্যবস'ার মাধ্যমে শক্তিশালী জার্মানি গঠন করতে। কিন' বর্তমান রাশিয়ায় এ রকম অন্ধ জাতীয়তাবাদী দল নেই। আর রাশিয়ানরা ভাবছেন না যুদ্ধ করে সারা পৃথিবী জয় করে রুশ প্রাধান্য বিস-ারের। অনেক মার্কিন বিশেষজ্ঞ বলছেন, আরব মুসলিম বিশ্বে যে রকম অভ্যুত্থান ঘটছে, রাশিয়াতেও অনুরূপ উত্থান ঘটার সম্ভাবনা আছে। কিন' তাদের এই ধারণাকে মেনে নেয়া যায় না। রাশিয়া অনেক গোছানো দেশ। আর রুশ জাতীয়তাবাদ আরব জাতীয়তাবাদের মতো নয়। বর্তমান আরবদের সাথে তুলনা করা চলে না রুশদের। সেটা করার চেষ্টা চলেছে। রাশিয়ায় গণতন্ত্রের অভিযাত্রা মনে হয়, শান্তিপূর্ণ পথ ধরেই চলবে। মানুষ কোনো দেশেই চাচ্ছে না একদলীয় শাসনব্যবস'া। কারণ, ক্ষমতা মানুষকে দুর্নীতিপরায়ণ করে তুলতে চায় চূড়ান-ভাবে। গণতান্ত্রিক ব্যবস'ায় থাকে একাধিক দল। রাজনৈতিক ক্ষমতা তাই চরমভাবে মানুষকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে তুলতে পারে না। রাজনৈতিক সমস্যা ক্ষমতার সমস্যা। এই সমস্যার সমাধান কেবল বহুদলীয় গণতন্ত্রের মাধ্যমে বাস-বে আসতে পারে। বহুদলীয় উদার গণতন্ত্রের এটাই হলো মূল যুক্তি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এখন আর কেউ দুইবারের বেশি প্রেসিডেন্ট হতে পারেন না। এই আইন আগে তাদের দেশে ছিল না। ১৯৫১ সালে মার্কিন সংবিধান সংশোধন করা হয়। সংবিধানে বলা হয়, কোনো ব্যক্তি আট বছরের বেশি মার্কিন প্রেসিডেন্ট থাকতে পারবেন না। এখন তাই যুক্তরাষ্ট্রে দুইবারের বেশি কেউ প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনে দাঁড়াতে পারেন না। রাশিয়াতে প্রেসিডেন্ট হওয়ার ক্ষেত্রে এ রকম কোনো আইন, যত দূর জানি এখনো প্রবর্তিত হয়নি। মার্কিন গণতন্ত্র প্রেসিডেন্ট-কেন্দ্রিক। কিন' রাশিয়ান গণতন্ত্র আধা প্রেসিডেন্ট, আধা প্রধানমন্ত্রীনির্ভর। এ ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে কার কতটা ক্ষমতা, সেটা এখনো সুস্পষ্ট নয়। পুতিন এর আগে ছিলেন প্রেসিডেন্ট। পরে তিনি ক্ষমতা ছেড়ে দেন মেদভেদেভের হাতে। নিজে হলেন প্রধানমন্ত্রী। এখন আবার নাকি চাচ্ছেন রুশ প্রেসিডেন্ট হতে। রাশিয়ার সংবিধানকে তাই বলা যাচ্ছে না একটা ‘সংবিধান’। কিন' তবুও মানুষ সে দেশে এগিয়ে চলেছে উদার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠারই পথে। তারা আর ফিরে যেতে ইচ্ছুক নয় একদলীয় শাসনব্যবস'ায়। রাশিয়ার একদলীয় শাসনব্যবস'া বাংলাদেশে প্রভাব ফেলেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাবে আওয়ামী লীগ চেয়েছিল একদলীয় রাষ্ট্রব্যবস'ার প্রবর্তন করতে। গঠিত হয়েছিল বাকশাল। কিন' এ দেশের মানুষ বাকশাল মেনে নিতে সম্মত হয়নি। বাকশাল গঠন করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ পড়েছিল বিরাট বিপর্যয়েরই মধ্যে। বাকশাল গঠনকে বিশেষভাবে সমর্থন করেছিলেন এ দেশের তখনকার মস্কোপন'ী কমিউনিস্টরা। পত্রিকার খবর দেখে খুশি হলাম যে, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) বর্তমানে বলছে, হাইকোর্টের আলোকে আরো দুই টার্মের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস'া বজায় রাখা উচিত। আমার মনে হয়, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কট কাটাতে হলে আপাতত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস'াকে বজায় রাখা উচিত হবে। বাংলাদেশে কেবল শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন করে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করা সম্ভব হবে না। রাশিয়ার মতো দেশে ভোট কারচুপির অভিযোগ উঠেছে। বর্তমানে বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক সমস্যার উদ্ভব হয়েছে, তার সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিয়ন্ত্রণে আগাম অবাধ নির্বাচনের। আওয়ামী লীগ যে পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করছে তাতে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়েছে। আওয়ামী লীগ যে সাংস্কৃতিক নীতি অনুসরণ করছে, তা বাংলাদেশের সংস্কৃতির বিকাশে সৃষ্টি করছে প্রতিকূলতা। আওয়ামী লীগ বলছে, ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে হবে। তাদের আওয়ামী লীগ তুলনা করছে অসুরের সাথে। এ দেশের হিন্দুদের আওয়ামী লীগ বলছে, মা দুর্গা যেমন অসুর বধ করেন, তেমনি এ দেশের হিন্দুদের উচিত হবে ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বধ করতে উদ্বুদ্ধ হওয়া। কারণ তারা অসুরসদৃশ। আওয়ামী লীগের এ ধরনের বক্তব্য হিন্দু-মুসলমান বিরোধকে বিশেষভাবে বাড়িয়ে তুলতেই পারে। আওয়ামী লীগের বক্তব্য শুনে মনে হচ্ছে, কারা যুদ্ধাপরাধী, সেটা ঠিক করাই আছে এবং বিচারটা হচ্ছে একটা লোক দেখানো ব্যাপার। যুদ্ধাপরাধীদের হত্যা করতে হবে। কিন' এ রকম হত্যার রাজনীতি দেশকে শেষ পর্যন- গৃহযুদ্ধের পথেই ঠেলে নিয়ে যাবে যার ফলাফল হবে খুবই অনিশ্চিত। এ রকম গৃহযুদ্ধ বাংলাদেশে ডেকে আনতে পারে ভারতীয় হস্তক্ষেপ। এটা আমাদের অর্থাৎ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পক্ষের শক্তির কাম্য হতে পারে না।
আওয়ামী লীগ এক দিকে বলছে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা, অন্য দিকে দেখাচ্ছে মা দুর্গার প্রতি বিশেষ ভক্তি। তাদের এই নীতি কোনোভাবেই বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অনুকূল হতে পারে না। শেখ মুজিব বাকশাল গঠন করেছিলেন। কেন তিনি তা গঠন করেছিলেন সেটা আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। কারণ এর আগে তিনি সংগ্রাম করেছেন উদার গণতন্ত্রের জন্য। সমালোচনা করেছেন সামরিক শাসনের। শেখ মুজিব কখনোই বাঙালির সংস্কৃতির নামে মা দুর্গার পূজা করতে বলেননি। কিন' তার তনয়া বিশেষভাবে দেখাচ্ছেন মা দুর্গার প্রতি ভক্তি। এক সময় বাংলাদেশের রাজনীতির ওপর পড়েছিল মার্কসবাদ-লেনিনবাদের বিরাট প্রভাব। কিন' এখন মার্কসবাদ- লেনিনবাদ সারা বিশ্বেই হয়ে উঠেছে প্রশ্নের বিষয়। এ দেশের বামপন'ী বলে পরিচিতদের বিষয়টিকে বিশেষভাবে উপলব্ধি করতে হবে। মার্কস তার অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে দু’টি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব প্রদান করেছিলেন। একটি হলো উৎপাদনী শক্তি আর একটি হলো উৎপাদনী সম্পর্ক। তিনি কখনোই বলেননি উৎপাদনী শক্তিকে বিকশিত না করে উৎপাদন সম্পর্কে পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে বলে। মার্কস উৎপাদিকা শক্তি বলতে বুঝিয়েছেন, উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ, উৎপাদনের অনুকূল পরিবেশ, উৎপাদন কলাকৌশলের স-র প্রভৃতি যা কিছু উৎপাদনের কাজে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে এবং উৎপাদনের সহায়তা করে, তাদের সব কিছুকে একত্র করে। পক্ষান-রে উৎপাদনী সম্পর্ক বলতে তিনি বুঝিয়েছেন, উৎপাদনে অংশগ্রহণকারী মানুষের মধ্যে সৃষ্ট সম্পর্ক বা শ্রমবিভাজনকে। সাম্যবাদী সমাজ গড়তে হলে সমাজে অর্থনৈতিক উৎপাদন এমন হতে হবে যাতে সমাজের সবাইকে ন্যূনতম অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য প্রদান সম্ভব হতে পারে। উৎপাদন না বাড়িয়ে বণ্টনে সমতা আনা সম্ভব হতে পারে না। মার্কসের এই বক্তব্য মিথ্যা হয়ে যায়নি। সারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এখন আওয়াজ উঠেছে- ওয়াল স্ট্রিট দখল করো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এতটা উৎপাদনী শক্তির বিকাশ ঘটেছে যে, সেখানে অর্থনৈতিক বণ্টনব্যবস'া সমতাবাদী হতে পারে। কিন' সব দেশের অবস'া এই পর্যায়ে নয়, যদিও সব দেশের রাষ্ট্রের লক্ষ্য হওয়া উচিত দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে বেঁচে থাকতে সহায়তা করা। কোনো আধুনিক রাষ্ট্রেরই কেবল লক্ষ্য হতে পারে না দেশের অভ্যন-রীণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং দেশকে বিদেশের আক্রমণ থেকে রক্ষা করা। সব রাষ্ট্রকেই হতে হবে কম-বেশি কল্যাণব্রতী। দারিদ্র্যকে বিবেচনা করতে হবে একটি সামাজিক সমস্যা হিসেবে; কেবলই ব্যক্তির সমস্যা হিসেবে নয়।
বাংলাদেশে উৎপাদনী শক্তি বিকাশের ওপর প্রদান করতে হবে অধিক গুরুত্ব। সেটাই হবে মূল বামপন'া। অন্য দিকে রাজনীতির ক্ষেত্রে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় দিতে হবে যথাযথ গুরুত্ব। কারণ গণতন্ত্র ছাড়া অর্থনৈতিক বিকাশ রুদ্ধ হতে চাইবে। এক দলের রাজত্বে, এক দল মানুষ হয়ে ওঠে বিশেষ সুবিধাভোগী। তারা যে কেবল রাজনৈতিক কারণে বিশেষ সুবিধা ভোগ করতে পারে, তা নয়। তাদের হাতে চলে যেতে থাকে অর্থনৈতিক ক্ষমতা। সমাজে সৃষ্টি হয় বড় রকমের আয় বৈষম্য। সৃষ্টি হতে পারে না সমতাবাদী সমাজজীবন।

সংশোধনী : গত সংখ্যায় এক স'ানে ভুলবশত ছাপা হয়েছিল- ‘এই উপমহাদেশে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা হয় ১৯১৪ সালে’। সেখানে হবে- ‘এই উপমহাদেশে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা হয় ১৯২৪ সালে। অবশ্য কেউ কেউ বলেন ১৯২২ সালে।’
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

রামকৃষ্ণ মিশনের ডাকে বাংলাদেশের সাড়া


২০১২-০১-১৬

বাংলাদেশে এখন এমন অনেক কিছু ঘটছে, যার কথা ক’দিন আগেও ভাবা যেত না। পত্রিকার খবরে পড়লাম, রামকৃষ্ণ মিশনের ডাকে বাংলাদেশ থেকে বিশেষ অতিথি হিসেবে পশ্চিমবঙ্গে গিয়েছিলেন আহমেদ আকবর সোবহান। আহমেদ আকবর সোবহান বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট শিল্পপতি এবং বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান। তাকে রামকৃষ্ণ মিশনের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল একজন জনসেবক হিসেবে। ইতঃপূর্বে কোনো মুসলমানকে রামকৃষ্ণ মিশন এভাবে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল বলে আমাদের জানা নেই। আকবর সোবহানকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে এমন এক সময়ে, যখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে পড়ছে ভারতের বিশেষ প্রভাব। তাই মনে হচ্ছে আকবর সোবহানের রামকৃষ্ণ মিশনের অনুষ্ঠানে যোগদানে আছে বিশেষ রাজনৈতিক তাৎপর্য। রামকৃষ্ণ মিশন মানবসেবায় নিয়োজিত। কিন' তার এতে যোগদান কতটা মানবসেবাধর্মের সাথে সংশ্লিষ্টতার কারণে হতে পারল সেটা হয়ে উঠেছে প্রশ্নের বিষয়। প্রশ্নের বিষয় হয়ে উঠেছে বসুন্ধরা গ্রুপের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নিয়ে। আমাদের দেশে অনেকেরই ধারণা নেই রামকৃষ্ণ মিশন সম্পর্কে। তাই আমরা রামকৃষ্ণ মিশন নিয়ে কিছু আলোচনা করতে যাচ্ছি।
যিনি এখন শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস (১৮৩৬- ১৮৮৬) নামে খ্যাত, তার পিতৃপ্রদত্ত নাম ছিল গদাধর চট্টোপাধ্যায়। ১৮৩৬ খ্রিষ্টাব্দে হুগলি জেলার কামারপুকুর গ্রামের এক গরিব ব্রাহ্মণের ঘরে তার জন্ম হয়। পূজা-অর্চনাই ছিল এই ব্রাহ্মণ পরিবারের আয়ের উৎস। গদাধরকে তার অগ্রজ রাজকুমার কলকাতায় নিয়ে আসেন এবং নিজের টোলে ধর্ম বিষয়ে শিক্ষা দেন। কলকাতার বিখ্যাত জমিদার রানী রাসমণি দক্ষিণেশ্বরে একটি কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন (১৮৫৫)। গদাধরের ভড় ভাই রাজকুমার সেই মন্দিরের প্রথম পূজক নিযুক্ত হন। তার তিরোধানের পর তার ভাই গদাধর ওই কাজে নিযুক্তি পান। গদাধর ছিলেন কালী সাধক। তিনি বলতেন, তিনি কালী মাতার সাক্ষাৎ লাভ করে থাকেন যোগ পদ্ধতির মাধ্যমে। তিনি মা কালীকে মনে করতেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের চালিকাশক্তি হিসেবে। তিনি তার শিষ্যদের নানা উপদেশ দিতেন। একপর্যায়ে তার শিষ্যরা তাকে মনে করতে থাকেন অবতার হিসেবে। তিনি খ্যাত হয়ে ওঠেন শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস হিসেবে। পরমহংস মানে হলো, শুদ্ধচিত্ত, সংযত-আত্মা নির্বিকার সমদর্শী ব্রহ্মানন্দে মগ্ন যোগি পুরুষ। তিনি এক পর্যায়ে বলেন, মানবসেবার কথা। বলেন, মানবসেবাকে ধর্মের মূলকথা হিসেবে গ্রহণ করতে। তার বক্তব্যের মধ্যে এক দিকে থাকে কালীভক্তি অন্য দিকে থাকে মানবতার পূজার কথা। কালীপূজা মানুষকে করতে চায় রহস্যময় শক্তির সান্নিধ্য লাভে উদ্যোগী। অন্য দিকে মানবসেবা মানুষকে করে রক্তমাংসে গড়া আর্তমানুষকে সাহায্য করতে উদ্বুদ্ধ। আর্তমানুষকে সাহায্য করার জন্য গঠিত হয় রামকৃষ্ণ মিশন। রামকৃষ্ণের অনেক শিষ্যের মধ্যে সর্বপেক্ষা খ্যাতিমান শিষ্য হলেন স্বামী বিবেকানন্দ (১৮৬৩-১৯০২)। স্বামী বিবেকানন্দের প্রকৃত নাম ছিল নরেন্দ্রনাথ দত্ত। নরেন্দ্রনাথ দত্তের পিতা ছিলেন রাজা রামমোহন রায়ের ভক্ত। রামমোহন ছিলেন নিরাকার একঈশ্বরবাদী ও মূর্তি পূজার ঘোরবিরোধী। তিনি গঠন করেন ব্রাহ্মসমাজ। কী করে এরকম পরিবারের একটি সন-ান রামকৃষ্ণের মাধ্যমে প্রভাবিত হতে পারলেন সেটা এখনো স্পষ্ট নয়। কিন' তিনি বিশেষভাবেই প্রবাভিত হন রামকৃষ্ণের ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে এবং হয়ে ওঠেন সনাতন হিন্দুধর্মের প্রতি অনুরক্ত। মা কালীকে তিনিও মনে করেন বিশ্বের চালিকাশক্তি এবং সব শক্তির অনি-ম উৎস। বলেন, যোগ সাধনার কথা আর তার পাশাপাশি বলেন আর্তমানবতার সেবার কথাও। ঊনবিংশ শতাব্দীজুড়ে ফরাসি দার্শনিক উগোস- কোঁতের (১৭৯৮-১৮৫৭) প্রবল প্রভাব পড়েছিল ইউরোপীয় চিন-ায়। আর ইউরোপীয় চিন-ার একটা প্রভাব এসে পড়ে কলকাতার হিন্দু সমাজেরও ওপর। কোঁত ছিলেন পজিটিভিস্ট। তিনি মরমিবাদী ছিলেন না। তিনি মনে করতেন মানুষ পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে যা জানে, তাই হলো যথার্থ জ্ঞান। এই জ্ঞানের পেছনে আরো জ্ঞান খুঁজতে যাওয়া বৃথা। বৈজ্ঞানিক চিন-ার লক্ষ্য হতে হবে বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ণয় ও মানুষের কল্যাণে এই জ্ঞানকে কাজে লাগানো। তিনি মনে করতেন, ধর্মের মূল শিক্ষা আধ্যাত্মিক চিন-ার মধ্যে নেই। ধর্মের মূল ভিত্তি হলো মানবসেবা। মানুষই মানুষের ভবিষ্যৎ। কোঁতের চিন-া প্রভাব ফেলে ব্রিটিশ দার্শনিক স্টুয়ার্ট মিল-এর ওপর। মিলও মনে করেছেন ধর্মের মূলকথা হলো মানুষের জন্য মানুষের সহানুভূতির বিকাশ। এই উপমহাদেশে হিন্দু চিন-ায় কোঁতের পজিটিভিজম প্রভাব ফেলেনি। তবে তার চিন-ার মানবতন্ত্রী দিকটি ফেলেছে কিছু কিছু প্রভাব। এর এই প্রভাব প্রেরণা জুগিয়েছে আর্তমানবতার সেবায়। অবশ্য এ ক্ষেত্রে থেকেছে বিদেশী খ্রিষ্টান মিশনারিদের অনুকরণেরও চেষ্টা। বিবেকানন্দ আর্তমানবতার সেবার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন। বিবেকানন্দের জীবনে একটি ঘটনা হলো ১৮৯৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে আহূত ধর্মসংক্রান- সভায় গিয়ে বক্তৃতা দেয়। তার এই বক্তৃতার অন্যতম মূল বক্তব্য ছিল সর্বধর্ম সমন্বয়। তিনি বলেন, হিন্দুধর্মে অনেক কুসংস্কার আছে। কিন' হিন্দুধর্ম খুবই সহনশীল। হিন্দুরা কখনো ধর্মযুদ্ধ করেনি এবং করতে বলেনি। হিন্দুদের অন্যতম ধর্মগ্রন' ভগবত গীতায় বলা হয়েছে, যত মত তত পথ। হিন্দুধর্ম, ধর্মের নামে মানুষ খুন করতে বলে না। কিন' বিবেকানন্দের এই বক্তব্যের মধ্যে ছিল একটি বড় রকমের ফাঁক। হিন্দুরা মা কালীর পূজা করতে গিয়ে দিয়েছে নরবলি। নরবলি হয়েছে তাদের ধর্মসাধনার অঙ্গ। কাপালিকরা কালীপূজা করেছে। মা কালীর নামে দিয়েছে নরবলি। ছিন্নমুণ্ড মানুষের শবের বুকের ওপর উপবিষ্ট হয়ে নগ্ন নারীর সান্নিধ্যে সুরা পান করেছে আগের আরো ছিন্নমস-া মানুষের মাথার খুলিতে। আমরা যেমন তরল বস' পান করি বিভিন্ন পাত্রের সাহায্যে কাপালিকরা পাত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে নরবলি দেয়া মানুষের খুলিকে। এ ছিল এক বীভৎস ধর্ম সাধনা। ঊনবিংশ শতাব্দীতেও যার প্রচলন ছিল। হিন্দুধর্মে ছিল নানা যৌন দুরাচার। ধর্মের নামে নারীকে নগ্ন করে তার ওপর চালানো হতো বীভৎস যৌন অত্যাচার। যার কথা আধুনিক ভদ্র ভাষায় ব্যক্ত করা চলে না। ডাকাতেরা ডাকাতি করতে গিয়েছে কালীপূজা করে। তারা ভেবেছে মা কালী তাদের ডাকাতিতে সাহায্য করবেন। হিন্দু মা কালীভক্তি পরবর্তীকালে হিন্দু রাজনীতিতে ফেলেছে বিশেষ প্রভাব। হিন্দু সন্ত্রাসবাদী রাজনীতিকেরা মা কালীর পূজা করেছেন। মা কালী হয়ে উঠেছে তাদের রাজনৈতিক চেতনার ভিত্তি। এ প্রসঙ্গে মুজাফ্ফর আহমদ তার আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি বইতে লিখেছেন- বাংলাদেশের সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী আন্দোলন নিঃসন্দেহে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ছিল। কিন' তা হিন্দু উত্থানের আন্দোলনও ছিল। উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু রাজত্বের পুনঃপ্রতিষ্ঠা (ঢাকা সংস্করণ- ১৯৭৭, পৃষ্ঠা-১০)। বিবেকানন্দ আর্তমানবতার সেবার ক্ষেত্রে হিন্দু জনসমাজের সেবার ব্যবস'া করেছেন। মুসলিম জনসমাজ কার্যত এর দ্বারা কোনোভাবেই উপকৃত হয়নি। কিন' বর্তমানে রামকৃষ্ণ মিশন ডাকছে মুসলমানকেও তার কাজে সম্পৃক্ত হতে। এটা তার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন সূচক। কিন' এর মূলে থাকতে পারে অন্য রাজনৈতিক অভীষ্ট। যার সম্বন্ধে বাংলাভাষী মুসলমানদের সচেতন থাকা প্রয়োজন।
বিবেকানন্দ খুব চমৎকার বাংলা গদ্য লিখেছেন। তিনি চেয়েছেন, যাকে বলা হয় চলতি বাংলা, বাংলা সাহিত্যে তার প্রচলন করতে। বাংলা ভাষায় লেখা- ‘পরিব্রাজক’, ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’, ‘বর্তমান ভারত’ এবং ‘ভাববার কথা’ বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যে উচ্চ স'ান অধিকার করে আছে। ‘ভাববার কথা’ গ্রনে' একটি প্রবন্ধে তিনি চলতি ভাষাকেই সাহিত্যের বাহন করার জন্য যুক্তি প্রদর্শন করেছেন। আমরা এখন, যাকে বলা হতো চলতি বাংলা, তার মাধ্যমে মনোভাব প্রকাশ করছি। তবে আমরা যে বাংলা ভাষা লিখছি সেটা বিবেকানন্দের চেয়ে প্রমথ চৌধুরীর দ্বারাই অনেক বেশি অনুপ্রাণিত। বিবেকানন্দ বাংলা ভাষায় বই লিখেছেন। করেছেন বাংলা ভাষার চর্চা। কিন' তিনি কোনো দিনই ভাবেননি বাংলা ভাষার ভিত্তিতে একটা পৃথক স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার কথা। তিনি ছিলেন অখণ্ড ভারতে বিশ্বাসী। আর যার ভিত্তি হতে হবে হিন্দু চেতনা। যেটা আজকের বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষের চিন-া-চেতনার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। বিবেকানন্দের চিন-ার সাথে আমাদের চিন-ার মিল ঘটাতে গেলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হতে বাধ্য। বসুন্ধরা গ্রুপ সম্পর্কে আমার কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই। আমি জানি না, কেন তারা রামকৃষ্ণ মিশনমুখী হতে চাচ্ছেন।
১২ জানুয়ারি ছিল স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিন। এতে যোগ দেন বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান প্রধান আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে। পশ্চিমবঙ্গের উত্তর-চব্বিশ পরগনা জেলার আগরপাড়া নামক জায়গায় স'াপন করা হলো বিবেকানন্দ মেমোরিয়াল কাম সেমিনার হলের ভিত্তিপ্রস-র। এতে উপসি'ত ছিলেন বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান। ভিত্তিপ্রস-র স'াপন করেন ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়। ভিত্তিপ্রস-র স'াপন অনুষ্ঠানটিকে তাই একান-ভাবে রাজনীতি-নিরপেক্ষ বলে ভাবা যাচ্ছে না। এই ভিত্তিপ্রস-র পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও করতে পারতেন। কিন' তা না করে করা হলো প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মাধ্যমে।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

দিল্লির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ডাক


২০১১-১১-২৮

নয়া দিগনে- ফরহাদ মজহারের একটি মন-ব্য প্রতিবেদন পড়ছিলাম (২২ নভেম্বর ২০১১)। ফরহাদ মজহার বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও উল্লেখযোগ্য কবি। তার লেখা আমি সাধারণত বিশেষ মনোযোগ দিয়ে পড়ি। তার এই মন্তব্য প্রতিবেদনটিও আমি মনোযোগ দিয়েই পড়লাম। ভেবেছিলাম ফরহাদ মজহার এমন কিছু বলতে চাচ্ছেন, যা দেশবাসীকে একটা সুষ্ঠু কর্মপন'া দিতে পারবে। কিন' লেখাটি পড়ে তেমন কোনো পন'ার নির্দেশ পাইনি । তিনি তার লেখায় দিল্লির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ডাক দিয়েছেন। কিন' দেননি কোনো সুস্পষ্ট পন'ার নির্দেশ। আমরা ভাটির দেশ। ভৌগোলিক দিক থেকে আমরা আমাদের দেশের প্রবহমান বেশির ভাগ নদীর পানির ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কোনো ক্ষমতা রাখি না। ভারতের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রবাহিত হয়ে এসেছে ৫৪টি নদী। ভারত উজানের দেশ। ভারত এসব নদী থেকে সহজেই পানি নিয়ে নিতে পারছে। কিন' আমরা ভাটির দেশ। ভৌগোলিক অবস'ানগত কারণে আমরা তা করতে পারছি না। ভারতের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো তাই আমাদের পক্ষে যথেষ্ট সহজসাধ্য নয়। গঙ্গার পানি নিয়ে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে ১৯৯৬ সালে হয়েছিল একটা চুক্তি। ভাবা গিয়েছিল, এই চুক্তির ফলে আমরা পাব গঙ্গা নদীর পানিপ্রবাহের উপযুক্ত অংশ। কিন' বাস-বে তা হতে পারছে না। এই চুক্তিতে নেই কোনো গ্যারান্টিক্লজ। অর্থাৎ নেই পানি পাওয়ার নিশ্চয়তা। এই চুক্তি অনুসারে পানি না পেলে আন্তর্জাতিক কোনো ফোরামে বিচারের দাবি নিয়ে বাংলাদেশের যাওয়ার সুযোগ রাখা হয়নি। যখন চুক্তিটি করা হয়েছিল তখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শেখ হাসিনা। তিনি ভারতকে বিশ্বাস করেছিলেন সাদা মনে। যেটা করা উচিত হয়নি। কিন' তথাপি একটা চুক্তি করা সম্ভব হয়েছিল। আর এর ফলে গঙ্গা নদীর পানি পাওয়ার অধিকার বাংলাদেশ রাখে, এ স্বীকৃতি পেয়েছিল। এক সময় ভারত বলত, গঙ্গা মূলত ভারতের নদী। এর পানিতে বাংলাদেশের কোনো অধিকার নেই। কিন' ভারতের এই যুক্তি ১৯৯৬ সালের দেবগৌড়া- হাসিনা চুক্তির ফলে আর গ্রহণযোগ্যতা পেতে পারে না। এটা একটা সাফল্য। কিন' এ সত্ত্বেও বলতে হয় বাস-ব অবস'ার খুব একটা পরিবর্তন ঘটেনি। আমরা গঙ্গার পানির প্রাপ্য অংশ পাচ্ছি না। আর এর জন্য আমরা ভারতের কাছে উঠাতে পারছি না শক্ত দাবি। ভারতের সাথে তিস-ার পানি নিয়ে বাংলাদেশের যে বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে তা যে সহজে মিটবে, তেমনটি মনে হচ্ছে না। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, তিস-ার পানি যথাযথভাবে আসছে না। তিস-া নদীর উদ্ভব হয়েছে সিকিমে। সিকিম নিয়ে নিচ্ছে তিস-া নদীর পানি। পশ্চিমবঙ্গে তিস-া নদীতে আগের মতো পানি আর আসছে না। বাংলাদেশকে তিস-ার পানি দিলে পশ্চিমবঙ্গ তাই পড়বে পানিসঙ্কটে। মনে হচ্ছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিছু বাস-বতাকে রাখতে চাচ্ছেন ঢেকে। পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার গজলডোবায় যে ব্যারাজ নির্মিত হয়েছে, তাতে বিশেষভাবে আটকা পড়ছে তিস-ার পানি। আর এই ব্যারাজের জন্যই বাংলাদেশ পাচ্ছে না তিস-ার পানি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সিকিমকে দোষারোপ করছেন। কিন' সিকিম তিস-া থেকে কতটা পানি নিয়ে নিচ্ছে বলে তিস-ায় পানি আসছে না, সে সম্বন্ধে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থাকছেন নীরব। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নন। তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী মাত্র। অথচ আমরা দেখছি, আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে গিয়ে দেনদরবার করছেন তিস্তার পানি পাওয়ার জন্য। এটা রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্য নিশ্চয়ই অবমাননাকর। আমাদের চুক্তি হতে পারে শুধু ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে; পশ্চিমবঙ্গের সাথে নয়। সারা ভারতে বিভিন্ন প্রদেশের মধ্যে নদীর পানি নিয়ে শুরু হয়েছে গোলযোগ। দক্ষিণ ভারতে কৃষ্ণা নদীর পানি নিয়ে বিবাদ চলছে তামিলনাড়-, কর্নাটক ও অন্ধ্র প্রদেশের মধ্যে। বিবাদ চলছে নর্মদা নদীর পানি নিয়ে। পানির বিভাজন সম্পর্কে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট যে রায় দিয়েছেন, তাতেও বাস-বে মিটতে পারছে না নদীর পানি নিয়ে বিরোধ। কিন' আমরা এতে কোনো অংশ নিতে পারি না। আমরা ভারত সরকারের কাছে দাবি উঠাতে পারি অভিন্ন নদীর পানি পাওয়ার জন্য। আমরা এর জন্য কোনো প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রী অথবা মুখ্যমন্ত্রীর কাছে গিয়ে দেনদরবার করার যৌক্তিকতা খুঁজে পাচ্ছি না। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে পানির ব্যাপারে যেতে পারছেন, সেটা আমাদের কাছে আদৌ স্বচ্ছ নয়।
বরাক নদীর উদ্ভব হয়েছে নাগা-মনিপুর জলপ্রপাত থেকে। টিপাই একটি নদীর নাম। টিপাই নদী এসে পড়েছে বরাক নদীতে। টিপাই ও বরাক নদীর সংযোগস'লের কাছে হলো টিপাইমুখ নামের গ্রাম। এই গ্রামের কাছে বরাক নদীর ওপর পানিবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ভারত এখন নির্মাণ করতে যাচ্ছে বিশেষ ড্যাম। ব্যারাজ ও ড্যাম শব্দ দু’টি আমাদের অনেকের কাছে যথেষ্ট স্পষ্ট নয়। ব্যারাজ বলতে বোঝায় কোনো নদীতে কংক্রিট অথবা রি-ইনফোর্সড কংক্রিট দিয়ে আড়াআড়িভাবে বাঁধ নির্মাণ। এই বাঁধের মধ্যে থাকে অনেকগুলো পানি-কপাট বা স্লুইসগেট। এসব পানি-কপাটকে ইচ্ছামতো খোলা ও বন্ধ করা চলে। এদের খুলে ও বন্ধ করে ব্যারাজের মধ্য দিয়ে নদীর পানিপ্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। বাংলাদেশের সীমান- থেকে ১১ মাইল দূরে গঙ্গা নদীর ওপর ভারত যে ফারাক্কা ব্যারাজ নির্মাণ করেছে, তাতে আছে ১১৫টি পানি-কপাট; যার প্রত্যেকটি ৬০ ফুট প্রশস্ত ও ২১ ফুটের মতো উঁচু। ড্যাম বলতে বোঝায় নদীর ওপর সাধারণ ব্যারাজের তুলনায় নির্মিত উঁচু ব্যারাজকে। ড্যাম গড়লে তার এক দিকে নদীর পানি আটকে সৃষ্টি হয় কৃত্রিম হ্রদ। এই হ্রদের পানিকে বিশেষভাবে প্রবাহিত করে উৎপন্ন করা যায় ডায়নামাতে বিদ্যুৎ। একে আমরা সাধারণ কথায় বলে থাকি পানিবিদ্যুৎ। ড্যামের পানি ব্যবহার করা হয় টারবাইন বা বিশেষ ধরনের চাকা ঘোরাতে; যা ঘোরায় ডায়নামার ভেতরে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কলকব্জাকে। এভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্র স'াপনের জন্য খরচ পড়ে অনেক; যা উঠে আসতে প্রয়োজন হয় দীর্ঘ সময়ের। অন্য দিকে কৃত্রিম হ্রদের মধ্যে জমতে থাকে পলিমাটি। হ্রদের মধ্যে পলিমাটি জমে হ্রদ ভরাট হয়ে যেতে পারে। ফলে একপর্যায়ে বন্ধ হয়ে যেতে পারে বিদ্যুৎ উৎপাদন। বাংলাদেশে কর্ণফুলী নদীর ওপর ড্যাম তৈরি করে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয় ১৯৬২ সালে। কর্ণফুলী ড্যামের জন্য সৃষ্টি হয় কৃত্রিম কাপ্তাই হ্রদের। কাপ্তাই হ্রদের ক্ষেত্রফল হচ্ছে ১৭২২ বর্গকিলোমিটার। তবে এর আশপাশে আরো প্রায় ৭৭৭ বর্গকিলোমিটার এলাকা পানিতে প্লাবিত হতে পারে। কাপ্তাই হ্রদের উদ্ভবের ফলে আনুমানিক ১৮ হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ৫৪ হাজার একর কৃষিভূমি তলিয়ে যায় হ্রদের পানিতে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৬৯০ বর্গকিলোমিটার বনভূমি। কর্ণফুলী পানিবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ব্যয়ভার বহন করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আর এই পানিবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করেছিল দু’টি মার্কিন কোম্পানি। কর্ণফুলী নদীর উদ্ভব হয়েছে ভারতের মিজোরাম রাজ্যের লুসাই পাহাড়ে। কর্ণফুলী পানিবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য ভারত কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। কিন' বরাক নদীর ওপর ড্যাম নির্মাণ করলে বরাক নদীর পানিপ্রবাহ কমে যাবে। বাংলাদেশ কোনোভাবেই আর পাবে না আগের মতো বরাক নদীর পানি। বরাক নদী সিলেট জেলায় প্রবেশ করার ঠিক পরে দু’টি শাখায় বিভক্ত হয়েছে। যার একটির নাম সুরমা। আর অপরটির নাম কুশিয়ারা। এ দু’টি নদীর মিলিত পানি হলো মেঘনা নদীর পানির মূল উৎস। বরাক নদীতে আগের মতো আর পানি না এলে সুরমা ও কুশিয়ারা নদী শুকিয়ে যেতে চাইবে। বিপন্ন হবে মেঘনা নদীর অসি-ত্ব। আমাদের পানিপ্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান ক’দিন আগে বলেছেন, টিপাইমুখ বাঁধ ভারতের অভ্যন-রীণ ব্যাপার। এই নিয়ে বাংলাদেশের কোনো বক্তব্য থাকতে পারে না। কিন' ড্যাম তৈরি হচ্ছে বরাক নদীর ওপর। বরাক নদীর ওপর আছে বাংলাদেশেরও অধিকার। বরাক নদীর প্রবাহ সেভাবে কমে গেলে বাংলাদেশের মানুষ বিশেষভাবেই হবে ক্ষতিগ্রস্ত। মাহবুবুর রহমান কী করে বলতে পারেন, বরাক নদীর ওপর ভারত যে ড্যাম নির্মাণ করতে যাচ্ছে তাতে বাংলাদেশের কোনো বক্তব্য থাকা উচিত নয়; সেটা আমাদের কাছে মোটেও বোধগম্য নয়। ১৯৫১ সালে ভারত ফারাক্কা ব্যারাজ নির্মাণের পরিকল্পনা করে। সাবেক পাকিস-ান সরকার করেছিল এর তীব্র প্রতিবাদ। ভারত সরকার বলেছিল, ফারাক্কা ব্যারাজ নির্মাণের কারণে তদানীন-ন পূর্ব পাকিস-ানের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। কিন' আমরা এখন উপলব্ধি করতে পারছি, ভারত যা বলেছিল তা ছিল সর্বৈব মিথ্যা। এখন সে টিপাইমুখ ড্যাম নির্মাণের জন্য যা বলছে তাকেও তাই সত্য বলে মেনে নেয়া সঙ্গত হবে না। আমাদের উচিত হবে অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে জাতীয় নীতিনির্ধারণ করা। ভারত সত্য কথা বলে না, এ কথা এখন স্বতঃসিদ্ধ হয়েই উঠেছে। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি বলছেন, তিনি নাকি ভারতের কাছ থেকে বিশেষ আশ্বাস পেয়েছেন। জেনেছেন, টিপাইমুখ বাঁধ বাংলাদেশের কোনো ক্ষতির কারণ হবে না। তার কথা শুনে মনে হচ্ছে, তিনি হয়ে উঠেছেন ভারতীয় স্বার্থেরই প্রবক্তা; বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তিনি নন। দীপু মনিকে আর পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চাচ্ছে না এ দেশের মানুষ। তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার সম্পূর্ণ অযোগ্য।
দুই বছর আগে শোনা গিয়েছিল, চীন তিব্বতে ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর ব্যারাজ নির্মাণ করতে যাচ্ছে। ব্রহ্মপুত্র নদের তিব্বতি নাম হলো সাং-পো (Tsang-Po)। ব্রহ্মপুত্র নদের মোট দৈর্ঘ্য ২৬৭০ কিলোমিটারের কাছাকাছি। ভারতের মধ্যে তার যে অংশটুকু পড়েছে তার দৈর্ঘ্য হলো ৮০২ কিলোমিটার। ব্রহ্মপুত্র নদের উৎপত্তি তিব্বতে। তার প্রথম ১৪৪৩ কিলোমিটার অংশ প্রবাহিত হয়েছে তিব্বতের মধ্য দিয়ে। ব্রহ্মপুত্র নদকে তাই বলা যায় মূলত তিব্বত তথা চীনের নদী। চীন সাং-পো নদীর ওপর বাঁধ নির্মাণ করতে যাচ্ছে, এই খবর জ্ঞাত হওয়ার পর ভারত চীনের কাছে জানিয়েছিল তীব্র প্রতিবাদ। পত্রিকার খবরে প্রকাশ, চীন ভারতকে জানিয়েছিল, সে সাং-পো নদীর ওপর কোনো ব্যারাজ নির্মাণ করতে যাচ্ছে না। এ ধরনের কিছু করার আগে সে ভারতকে আন-র্জাতিক প্রথানুসারে সব তথ্য সরবরাহ করবে। ভারত একতরফাভাবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নদীর প্রবাহ নিয়ন্ত্রিত করছে। মানছে না কোনো আন-র্জাতিক প্রথা (Convention)। আর সে এটা মানছে না বলেই বাংলাদেশের সাথে হতে পারছে নদীর পানি নিয়ে বাংলাদেশ-ভারত বিরোধ। নদীর পানি নিয়ে এক সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বিরোধ সৃষ্টি হয়েছিল মেক্সিকোর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কানাডা ও মেক্সিকোর সাথে নদীর বিরোধ মিটিয়ে ফেলেছে আন-র্জাতিক প্রথা মেনে নিয়ে। একইভাবে ভারত যদি আন-র্জাতিক প্রথাকে মেনে নেয়, তবে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে পানি নিয়ে যে বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে এবং বাড়ছে, তার নিষ্পত্তি হতে পারবে।
আমাদের দেশে নদী নিয়ে এখনো খুব একটা গবেষণা হয়নি। ১৯৬৩ সালে একজন মার্কিন বিশেষজ্ঞ তার একটি লেখায় বলেছিলেন, তদানীন-ন পূর্ব পাকিস-ানের মধ্য দিয়ে যে পরিমাণ পানি নদীপথে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়ে, তার হিসাব হলো এক শ’ কোটি একর ফিট। এই পানি যদি ঠিকমতো ব্যবহার করা যায়, তবে বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ই তাদের কৃষি উৎপাদন বিপুলভাবে বাড়াতে পারবে। (Roger Revelle : Water, in Technology and Economic Development; A Scientific American Book; PP, 72-90)। বাংলাদেশ- ভারত নদীর পানি নিয়ে বিবাদ হওয়া উচিত নয়। ভারত-বাংলাদেশ নদীর পানি ব্যবহারে সহযোগিতা করতে পারে। যার মাধ্যমে উভয় দেশই হতে পারে বিশেষভাবে উপকৃত।
খালেদা জিয়া ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে প্রস্তাব দিয়েছেন টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের আগে বাংলাদেশ-ভারত মিলে যৌথ জরিপের। যার মাধ্যমে বোঝা যাবে টিপাইমুখ জলবিদ্যুৎকেন্দ্র বাংলাদেশের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে কি না। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং যদি খালেদা জিয়ার প্রস-াবে সাড়া দেন, তবে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যে বিরাট আস'ার ঘাটতি দেখা দিয়েছে তা কমে আসতে পারবে।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

গরিবি হটাও


২০১১-১১-১৪

১৯৫৮ সালের কথা। জন কেনেথ গালব্রেথ একটি বই লিখেন। বইটির নাম, The Affluent Society. গালব্রেথ ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত হার্ভার্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির একজন নামকরা অধ্যাপক। তিনি তার বইটির জন্য সে সময় পেয়েছিলেন বিশ্বজোড়া খ্যাতি। বইটির প্রতিপাদ্য ছিল, এতকাল অর্থনীতির বিষয় ছিল অভাব নিয়ে আলোচনা। কিন' মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এখন আর অভাবের সমস্যা (Scarcity) নেই। সেখানে সমস্যা হতে পারে প্রাচুর্য (Affluence) নিয়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হয়ে উঠেছে প্রাচুর্যের দেশ। এই প্রাচুর্যকে কাজে লাগাতে হবে সুন্দর শহর ও পার্ক গড়ার কাজে। কাজে লাগাতে হবে সাংস্কৃতিক উন্নয়নে ও মানুষকে সুশিক্ষিত করে তোলার জন্য। আগামী দিনে মার্কিন অর্থনীতির লক্ষ্য হতে হবে সে দেশের মানুষের মানসিক উন্নয়ন এবং শিল্পীমনের বিকাশ। যা চারুতা আনবে মার্কিন সমাজজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে। আর এক কথায় অর্থনীতির লক্ষ্য আর থাকা উচিত হবে না বস'গত বৈভব বাড়ানো। তার লক্ষ্য হতে হবে জীবনের সর্বক্ষেত্রে নান্দনিকতা বাড়ানো। বইটি প্রকাশের পর ৫৩ বছর গত হয়েছে। এখন আমরা শুনতে পাচ্ছি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দারিদ্র্যের সমস্যা বিলুপ্ত হয়নি। অভাব সে দেশেও আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বেকার। তার অর্থনৈতিক জীবনে দেখা দিয়েছে মন্দা। আওয়াজ উঠেছে ওয়াল স্ট্রিট দখল করো। সারা বিশ্বের মানুষ সমর্থন দিচ্ছে এই আন্দোলনকে। আমাদের দেশেও কিছু বাম বুদ্ধিজীবী সমর্থন দিচ্ছেন ওয়াল স্ট্রিট দখলের আন্দোলনকে। কিন' এ ক্ষেত্রে একটি কথা উপলব্ধি করতে হবে; তা হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আছে যথেষ্ট প্রাকৃতিক সম্পদ। আছে এই প্রাকৃতিক সম্পদকে কাজে লাগানোর জন্য প্রয়োজনীয় সাজসরঞ্জাম, কলকারখানা এবং কাজ জানা মানুষ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অর্থনীতিতে সমস্যার কারণ হলো আর্থিক বৈষম্য। কিন' আমাদের মতো দেশে অভাবের কারণ হলো প্রয়োজনীয় দ্রব্যের উৎপাদন যথেষ্ট না হওয়া।
অর্থাৎ আমাদের অর্থনীতির সমস্যা কেবল ধন বণ্টনের নয়, ধন উৎপাদনেরও। এখানে মাথাপিছু আয় কম হওয়ার কারণ হলো ধনের অভাব। আয় বাড়াতে গেলে বাড়াতে হবে ধন উৎপাদন। কেবল সমাজব্যবস'ার পরিবর্তন ঘটিয়ে আমাদের আয়-বৈষম্য ঘোচানো সম্ভব নয়। ভোগ পরিকল্পনার সাথে সাথে থাকতে হবে উৎপাদন পরিকল্পনা। উৎপাদন বাড়ানো ছাড়া আমাদের মতো দেশে দারিদ্র্য দূরীকরণ কোনোমতেই সম্ভব হবে না। গরিবি হটাও এই আওয়াজকে বিশ্লষণ করলে ধরা পড়ে এর মধ্যে আছে অর্থনৈতিক বৈষম্য কমানোর দর্শন। কিন' অর্থনৈতিক বৈষম্য কমাতে হলে মাথাপিছু আয় বাড়াতে হবে। আর সেই আয় হতে হবে বস'গত সম্পদ এবং সেবার সরবরাহ বাড়িয়ে। অন্যভাবে তা সম্ভব হতে পারে না। আমরা এখন বাস করি মুদ্রাপ্রধান অর্থনীতির মধ্যে। জিনিস সেবার লেনদেন হয় মুদ্রার মাধ্যমে। কিন' মুদ্রা নিজে কোনো সম্পদ নয়। মুদ্রা সরবরাহ বাড়িয়ে একটা দেশের সম্পদ বাড়ানোর চেষ্টা আসলে বাড়ায় দারিদ্র্য। সৃষ্টি করে মুদ্রাস্ফীতির সমস্যা। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দ্রব্যমূল্য বাড়ানোর একটি কারণ হলো, দ্রব্য উৎপাদনের সাথে বাজারে মুদ্রা সরবরাহের কোনো সঙ্গতি না থাকা। অর্থনীতির দিক থেকে অনগ্রসর দেশগুলোতে ঘাটতি ব্যয়ের মাধ্যমে চালানো হয় অর্থনৈতিক উন্নয়নপ্রচেষ্টা। কিন' এর ফলে দ্রুত বাড়ে মুদ্রার সরবরাহ। আর এর ফলে বাড়ে সাধারণ মানুষের দারিদ্র্য ও আয়-বৈষম্য।
মুদ্রার অবগুণ্ঠনের আড়ালে ঢাকা পড়তে চাই একটা দেশের অর্থনৈতিক অবস'ার প্রকৃত চিত্র। বাড়তি নোট ছাপিয়ে কর্মসংস'ান বাড়াতে গিয়ে সরবরাহের তুলনায় চাহিদার মাত্রা বাড়ে। হতে থাকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। অনেক ক্ষেত্রেই তা চলে যায় সাধারণ শ্রমজীবী ও কৃষিজীবী মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। অর্থনৈতিক দিক থেকে অনগ্রসর অনেক দেশের রাজনীতিবিদেরা দেশের মানুষকে চমক দেখান এমন কিছু করে, যা আসলে মানুষের কাজে আসে না। যেমন বড় বড় রাস-াঘাট নির্মাণ। এ রকম বাগাড়ম্বরপূর্ণ ভোগ (Public Conspicuous Expenditure) একটা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজে আসে না। কারণ তা বস'গত সম্পদ ও প্রয়োজনীয় সেবা যেমন শিক্ষা ও চিকিৎসার প্রয়োজন পূরণ করে না। রাজনীতিকেরা চমক দেখাতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই করছেন জনস্বার্থের ক্ষতি। এর ফলে কৃষিভূমির হচ্ছে অপচয়। কমছে অনেক দেশেই কৃষি উৎপাদন। কিছু দিন আগে আমাদের দেশে কিছু কথিত বাম নেতাকে বলতে শোনা যেত ‘তুমি খাবে, আমি খাবো না; তা হবে না তা হবে না।’ কিন' সবাইকে খেতে দিতে হলে বাড়াতে হবে খাদ্য উৎপাদন। একজনের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে আর একজনকে দিলে তা পারবে না ক্ষুধা সমস্যার সমাধান করতে। একটা স'ূল উদাহরণ দেয়া যেতে পারে : ঢাকায় অনেক মহল্লায় পানীয় পানি সরবরাহ যথেষ্ট নয়। পানির অভাব প্রতিদিন সেখানে সৃষ্টি করছে কলহ। এই কলহ দূর করতে গেলে অবশ্যই বাড়াতে হবে পানির সরবরাহ। এই সমস্যা সৃষ্টি হতে পারছে পানির অভাব থেকে। পানির বণ্টনব্যবস'ার অব্যবস'া থেকে নয়। যদিও পানিবণ্টনের অব্যবস'া হতে পারে এর কিছুটা কারণ। কিন' এ সমস্যার সমাধান করতে গেলে পানি সরবরাহ বাড়াতেই হবে। বাম বুদ্ধিজীবীরা কথায় কথায় বলেন, শ্রেণী সংগ্রামের কথা। কিন' তাদের দু’জন গুরু, কার্ল মার্কস ও ফেডরিক অ্যাঙ্গেল তাদের রচিত কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোতে (১৮৪৮ খ্রি:) যেমন বলেছে, শ্রেণী সংগ্রামের কথা, সেই সাথে আবার বলেছে কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর কথাও। কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোতে বলা হয়েছে, সব পতিত জমিকে আনতে হবে চাষের আওতায়। করতে হবে জমির উর্বরতার বাড়ানোর সব ধরনের চেষ্টা। তারা তাদের ম্যানিফেস্টোতে বলেছেন, শিক্ষাকে হতে হবে সার্বজনীন এবং অবৈতনিক। যাতে বাড়ে সাধারণভাবে মানুষের চিন-াশক্তি। তার ধন-বৈষম্য কমিয়ে আনার জন্য আয়ের ওপর বসাতে বলেছেন প্রগতিশীল হারে আয়কর আরোপ করতে। বলেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে উৎপাদনের জন্য ঋণ দিতে।
কেবলই শ্রেণী সংগ্রামের ভিত্তিতে আন্দোলন করতে নয়। তারা বলেছেন, কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়তে। গ্রাম ও শহরের মানুষের আয়ের ব্যবধান কমিয়ে আনতে। অনেকের ধারণা কার্ল মার্কস ছিলেন গণতান্ত্রিক চিন্তাচেতনার বিরোধী। কিন' তিনি ১৮৪৮ সালে সমর্থন করেন বিলাতের চার্টিস্ট (Chartist) আন্দোলনকে। বিলাতে চার্টিস্টরা চেয়েছিলেন সব প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ মানুষের জন্য ভোটাধিকার। গোপনে ভোট দেয়ার অধিকার, পার্লামেন্টে সদস্য হওয়ার জন্য নির্দিষ্টমানের সম্পত্তি থাকার বিধানের বিলুপ্তি, নির্বাচিত এলাকা মোটামুটি সমানভাবে নির্দিষ্টভাবে বিভক্ত করা এবং পার্লামেন্টের সদস্যের জন্য বেতনের ব্যবস'া করা ও প্রতি বছর অন-ত একবার করে পার্লামেন্টের অধিবেশন ডাকা। কার্ল মার্কস বলেছেন, চার্টিস্ট আন্দোলনের ফলে বিলাতে যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, তার মাধ্যমে একদিন ধনসাম্যের প্রতিষ্ঠা সম্ভব হতে পারবে। কার্ল মার্কস কেবলই রক্তক্ষয়ী বিপ্লবের মাধ্যমে ধনসাম্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করতে বলেননি। বলেননি ধনসাম্যের প্রতিষ্ঠার জন্য একদলীয় শাসনব্যবস'া প্রতিষ্ঠার কথা। তবে তার অনুসারক বলে পরিচিত অনেকেই করেছেন গণতন্ত্রের বিরোধিতা। কার্ল মার্কসের নামে ১৯১৭ সালে নভেম্বর মাসে ক্ষমতায় আসেন কমিউনিস্টরা। সে দেশে ঘটানো হয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস'া প্রতিষ্ঠার সব আয়োজনের পরিসমাপ্তি। কিন' একটানা ৭৪ বছর ক্ষমতায় থাকার পর রাশিয়ায় ১৯৯১ সালের ডিসেম্বর মাসে কমিউনিস্ট পার্টি হারিয়েছে ক্ষমতা। মানুষ সে দেশে চাচ্ছে গণতান্ত্রিক উপায়ে তাদের সমস্যার সমাধান। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, একটানা ৭৪ বছর ক্ষমতায় থেকেও রাশিয়ায় দারিদ্র্য বিমোচন করতে পারেনি। বহু লোক সে দেশে বাস করছেন দারিদ্র্যসীমার নিচে। বাম রাজনৈতিকেরা বলেন, তারা হলেন ‘ত্যাগী’ কিন' অন্যরা হলেন ‘ভোগী’। একমাত্র বামরাই পারেন একটা দেশের দারিদ্র্য বিমোচন করতে। কিন' রুশ বিপ্লবের ইতিহাস তাদের এই দাবিকে মিথ্যা প্রমাণই করছে। আমাদের দেশে বামপন'ীরা দাবি করছেন কেবল তারাই পারেন এ দেশকে দারিদ্র্য বিমুক্ত করতে। কিন' তাদের এই দাবিকে মেনে নেয়ার কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে বলে আর মনে হয় না। রাশিয়ার ইতিহাস বাম দাবিকে মিথ্যা বলেই প্রমাণিত করছে। কমিউনিস্টরা ছাড়াও দারিদ্র্য বিমোচনের কথা ভেবেছেন অন্য সমাজ চিন্তাবিদেরাও। এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে ফরাসি অ্যানারকিস্ট পিয়ের জোসেপ প্রুদঁকে (১৮০৯-১৮৬৫)। প্রুদঁ মনে করতেন ছোটখাটো সম্পত্তি রাখতে হবে ব্যক্তিগত মালিকানায়। সব সম্পত্তি রাষ্ট্রের হাতে তুলে দেয়া ঠিক হবে না। কারণ রাষ্ট্র পরিচালনা করে মানুষই। সব সম্পত্তি রাষ্ট্রের হাতে তুলে দিলে মানুষ হারাবে তার রাজনৈতিক ও ব্যক্তি স্বাধীনতা। প্রতিষ্ঠা পাবে রাষ্ট্রিক দাসত্ব। প্রুদঁ মনে করতেন মুদ্রার মাধ্যমে বিনিময়ব্যবস'া রদ করতে হবে। তার স'লে প্রতিষ্ঠা করতে হবে দ্রব্য বিনিময়ব্যবস'া। যাতে মানুষ বুঝতে সক্ষম হবে একটা দেশের প্রকৃত অর্থনীতির অবস'া সম্পর্কে। তিনি আরো বলেন, সব ধরনের সুদের কারবার বন্ধ করতে হবে। টাকা খাটিয়ে সুদ নেয়ার ব্যবস'া মানুষকে অন্যের শ্রমের ফসল ভোগ করার অধিকার দেয়। অর্থনীতির ক্ষেত্রে সৃষ্টি করে বিশেষ সুবিধাভোগী শ্রেণীর যা সমাজে ঘটায় বিশেষভাবেই আয়-বৈষম্য। আর এক কথায় ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান। প্রুদঁর মতে, আদর্শ সমাজজীবন হতে হবে গণতান্ত্রিক এবং ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র সম্পত্তিভিত্তিক। তাহলে ঘুচবে মানুষে মানুষে আয়-বৈষম্য। প্রুদঁ অর্থনীতির ক্ষেত্রে সমবায় ব্যবস'ার ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেন। আর এই সমবায়ব্যবস'া বিশেষভাবেই হতে হবে ঐচ্ছিক।
এক কালের মার্কসবাদী বিপ্লবী ও পরবর্তীকালের মানবতন্ত্রী মানবেন্দ্রনাথ রায়ের (১৮৯৩-১৯৫৪) মতে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে জোর দিতে হবে কৃষিকর্মের ওপর। তার মতে, আমাদের মতো কৃষিপ্রধান দেশে কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে ঘটাতে হবে কৃষকের ক্রয়ক্ষমতা। এর ফলে সৃষ্টি হতে পারবে শিল্পদ্রব্যের চাহিদা। আর তাই হতে পারবে কলকারখানার অর্থনীতির সমপ্রসারণ। অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে দেশের অভ্যন-রীণ বাজারের ওপর দিতে হবে অধিক গুরুত্ব। রফতানিনির্ভর বাণিজ্যের ওপর নয়। কৃষকের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ঐচ্ছিকভাবে সমবায়ভিত্তিক কৃষি অর্থনীতি গড়ে তুলতে হবে। সাধারণভাবে দেশের অর্থনীতির কাঠামোকে হতে হবে সমবায়ভিত্তিক। রায় এসব কথা বলেন তার জীবনের শেষ ভাগে এসে। এখন আবার নতুন করে বলা হচ্ছে গরিবি হটাওয়ের কথা। কিন' গরিবি হটাওয়ের কথা উঠেছে অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফরাসি বিপ্লবের মাধ্যমে। মানুষ চেয়েছে সাম্য মৈত্রী আর স্বাধীনতা, যা মানবসমাজে এখনো সেভাবে রূপায়িত হতে পারেনি, যা এখনো হয়ে আছে আদর্শেরই বিষয়। ধর্ম মানুষকে দারিদ্র্যমুক্ত করতে চেয়েছে। মানুষকে বলেছে অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতে। অনাড়ম্বর জীবনযাপন মানুষকে করে তুলবে সমতাবাদী। স্বেচ্ছায় দারিদ্র্য বরণ হয়ে উঠবে দারিদ্র্য মোচনের উপায়। ইসলাম ধর্মে মানুষকে বলা হয়েছে অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতে। সুদ গ্রহণ ইসলামে নিষিদ্ধ। ইসলামে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, দানধ্যানের ওপর। আমাদের সময় অনেক ইসলামি চিন-াবিদ চাচ্ছেন ইসলামি অর্থনীতির প্রবর্তন। অর্থাৎ তারাও চাচ্ছেন গরিবি হটাতে। মানুষে মানুষে আয়-বৈষম্য কমাতে। আমাদের দেশে তথাকথিত প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরা ইসলামি মৌলবাদের ভয়ে ভীত। কিন' ইসলামের অন্যতম মূল লক্ষ হলো দারিদ্র্য বিমোচন। আর এক কথায় গরিবি হটাও।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

বৃহস্পতিবার, ১২ জানুয়ারী, ২০১২

আওয়ামী লীগ-সিপিবি মৈত্রী


২০১১-১২-২৬

মার্কসবাদ ও লেনিনবাদের মধ্যে পার্থক্য আছে। কার্ল মার্কস যেখানে জোর দিয়েছিলেন রাজনীতিতে শ্রেণী-চেতনার ওপর, লেনিন সেখানে জোর দিয়েছিলেন কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার ওপর। লেনিনের মতে, কমিউনিস্ট পার্টি গড়তে হবে সার্বক্ষণিক কর্মী দিয়ে; যারা হবে পেশাদার বিপ্লবী। এই বিপ্লবীরা এক দেশের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে দেশটাকে পরিচালিত করবে। ক্রমে নিয়ে যাবে দেশকে শ্রেণীহীন সমাজের পথে। কার্ল মার্কস ১৮৪৮ সালে বিলেতে চার্টিস্ট আন্দোলনকে সমর্থন করেন। তিনি বলেছিলেন, বিলেতে গণতান্ত্রিক রাজনীতির মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস'া গড়ার সম্ভাব্যতার কথা। তিনি মনে করেছিলেন, ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় বিলেতে জনমতের মূল্য আছে। জনমত সৃষ্টি করে তাই এগোনো যাবে সমাজ পরিবর্তনের পথে; কোনো রক্তক্ষয়ী বিপ্লব ব্রিটেনের জন্য প্রয়োজন হবে না। কিন' লেনিন উদার গণতন্ত্রে আদৌ আস'াশীল ছিলেন না। তিনি আস'াশীল ছিলেন এক দলের রাজত্বে। তিনি মনে করতেন, কমিউনিস্ট পার্টিকে হতে হবে রাষ্ট্রের সর্বময় কর্তা। আর তার কর্তৃত্বের মাধ্যমেই সমাজজীবনে আসবে প্রয়োজনীয় বৈপ্লবিক পরিবর্তন। লেনিনের এই মতবাদ সমাজতান্ত্রিক শিবিরে বিভক্তি এনে দিয়েছিল। বিশেষ করে তার দেশ রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রীরা মেনশেভিক ও বলশেভিক এই দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। লেনিন হন বলশেভিক দলের নেতা, যারা পরে নিজেদের অভিহিত করেন কমিউনিস্ট হিসেবে। ১৯১৭ সালে ঘটে রুশ বিপ্লব। কমিউনিস্টরা সেখানে ক্ষমতায় আসে। আর ক্ষমতায় থাকে ১৯৯১ সালের ডিসেম্বর পর্যন-। অর্থাৎ কমিউনিস্টরা ৭৪ বছর ধরে শাসন করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। রাশিয়া এবং আরো ১৪টি রিপাবলিক নিয়ে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। যা এখন ভেঙে পড়েছে। প্রমাণিত হয়েছে কমিউনিস্টদের দাবির অনেক কিছুই সত্য ছিল না। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে রাশিয়ায় গড়ে উঠেছে অনেক কলকারখানা। অর্থনীতিতে এসেছে সমৃদ্ধি। কিন' এটা কমিউনিস্ট দর্শনের সূত্র ধরে হয়নি। হয়েছে রাশিয়ার মানুষের অদম্য চেষ্টার ফলেই। কমিউনিস্ট শাসন ছাড়াই সুদীর্ঘ ৭৪ বছরে রাশিয়ার অর্থনীতির ক্ষেত্রে ঘটতে পারত কলকারখানার বিপ্লব। রাশিয়ার অর্থনীতিতে যেভাবে শিল্পবিপ্লব ঘটতে পেরেছে, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের আর ১৪টি প্রজাতন্ত্রে তা ঘটতে পারেনি। ফলে সৃষ্টি হতে পারে অর্থনৈতিক বৈষম্য। আর সেই সাথে সৃষ্টি হতে পারে রুশ প্রাধান্যের বিপক্ষে মনোভাব। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার একটা কারণ হলো, রুশ জাতীয়তাবাদের বিপক্ষে অন্য জাতীয়তাবাদের বিরোধ। কার্ল মার্কস বলেছিলেন, মানুষের ইতিহাস শ্রেণী-সংগ্রামের ইতিহাস। তিনি জাতিসত্তার বিরোধ সম্পর্কে কিছু বলেননি। অথচ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়েছে জাতিসত্তার বিরোধে। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ দিয়ে এর ব্যাখ্যা করা যায় না। রাশিয়ায় কমিউনিস্টরা ক্ষমতা হারিয়েছে। একদলের রাজত্বের জায়গায় রাশিয়ায় মানুষ চাচ্ছে বহুদলীয় উদার গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা। চীনে কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় আছে, কিন' সে কমিউনিস্ট পার্টির লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে, চীনকে একটা বিরাট সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত করা; কোনো সাম্যবাদী সমাজ জীবন গড়ে তোলা নয়। সমাজতন্ত্রের পথ ছেড়ে চীনা কমিউনিস্টরা গ্রহণ করেছে মুক্তবাজার অর্থনীতি। আজকের বিশ্বে কমিউনিস্ট দর্শন পড়েছে মহাসঙ্কটে। বলতে হয়, তা চলেছে বিলুপ্তিরই পথে। মুক্তবাজার অর্থনীতি যে ভালোভাবে চলছে, সেটাও বলা চলে না। যুক্তরাষ্ট্রে শুরু হয়েছে ওয়াল স্ট্রিট দখল করার আন্দোলন। সারা ইউরোপে বাজার অর্থনীতিতে দেখা দিয়েছে সঙ্কট। মানুষ চাচ্ছে অর্থনীতিতে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ। অর্থাৎ মুক্তবাজার অর্থনীতির দর্শনে মানুষ যে এখনো যথেষ্ট আস'াশীল, তা বলা যায় না। বিশ্বজনমত ঢুকে পড়তে চাচ্ছে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির দিকে; যাকে এক সময় কমিউনিস্টরা বলতেন, ভেজালমিশ্রিত দর্শন। এর আসল লক্ষ্য হচ্ছে ধনতন্ত্রকে রক্ষা করা। কিন' এখন তারা ঠিক এ রকম কথা আর বলতে পারছেন না। কারণ, চীন ধরেছে কার্যত রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত মিশ্র অর্থনীতির পথ। রাশিয়াও চাচ্ছে অনুরূপ অর্থনীতিকে গ্রহণ করতে। এক সময় বলা হতো, রাশিয়া প্রায় পরিণত হয়েছে আদর্শ সমাজতান্ত্রিক দেশে। কিন' এই দাবি যে সত্য ছিল না, তার অনেক প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে ১৯৯১ সালের পর। রাশিয়ায় উদয় ঘটেছে একাধিক ধনকুবেরের। রাশিয়া একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ হলে কখনোই এত অল্প সময়ে এত ধনকুবেরের উদয় হতে পারত না। কমিউনিস্টরা কোনো দেশেই এখন আর আগের মতো জনপ্রিয় নয়, বাংলাদেশেও নয়। কিন' শেখ হাসিনা বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাথে হাত মিলিয়ে করছেন মৈত্রী জোট গঠন। জানি না, এর দ্বারা তিনি কিভাবে রাজনৈতিক শক্তি অর্জনের কথা চিন-া করতে পারছেন। আওয়ামী লীগে আছে অনেক ত্যাগী কর্মী। তাদের মূল্যায়ন না করে জোটে সিপিবির কর্মীদের প্রাধান্য প্রদান করলে সিপিবি ও আওয়ামী লীগ কর্মীদের মধ্যে দেখা দিতে পারে বড় রকমের বিরোধ; যা আওয়ামী লীগের ওপর মহলের পক্ষে শেষ পর্যন- সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়তেই পারে। এ ছাড়া মতবাদগত বিরোধ দেখা দিতে পারে। কারণ সিপিবির আছে একটা বিশেষ দর্শন। আওয়ামী লীগের সে রকম কোনো সুনির্দিষ্ট, সুস্পষ্ট রাজনৈতিক দর্শন নেই। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ব্রিটিশ লেবার পার্টির চিন্তাধারার দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। তিনি গণতন্ত্র বলতে বুঝতেন ব্রিটিশ সংসদীয় পদ্ধতির গণতন্ত্রকে। অর্থনীতিতে তিনি ছিলেন মিশ্র অর্থনীতির পক্ষে। এক কথায় বলা চলে তার দর্শন ছিল যাকে বলে, কল্যাণব্রতী রাষ্ট্র গড়া, তারই পক্ষে। কল্যাণব্রতী রাষ্ট্রের মূলনীতি হলো দু’টি। একটি হলো, সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তির জীবনযাত্রার ন্যূনতম মান রাষ্ট্রের দায়িত্বে নিশ্চিত করা। অপরটি হলো নাগরিকদের রাষ্ট্রিক দায়িত্বে কর্মসংস'ানের ব্যবস'া করা। রাষ্ট্রকে সেসব সুযোগ সুবিধার ব্যবস'া করতে হবে, যাতে লোকে নিরাপত্তা, ন্যূনতম জীবনযাত্রার মান ও সভ্যজীবন ভোগ করতে পারে। বেকার, দারিদ্র্য, বার্ধক্য ও অসুস' অবস'ার নিরাপত্তার অভাব, বাণিজ্যচক্র এবং প্রকট ধনবৈষম্য দূর করতে হবে। সোহরাওয়ার্দী সমাজতন্ত্র বা কমিউনিজমকে স্বীকার করে নিতে চাননি। কারণ তিনি মনে করতেন, মানুষের জীবনে ব্যক্তিস্বাধীনতার মূল্য আছে। আর গণতন্ত্রের মাধ্যমেই ব্যক্তিস্বাধীনতা সুরক্ষিত হতে পারে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বিলেতে লেখাপড়া শিখেছিলেন। ব্রিটিশ চিন-াচেতনা তাকে প্রভাবিত করেছিল। তিনি ব্রিটিশ শাসনামলে মুসলিম লীগে যোগ দেয়ার আগে ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের স্বরাজ্য পার্টির সদস্য। পরে (১৯৩৬) যোগ দেন মুসলিম লীগে। ১৯৪৭-এর পর তিনি মুসলিম লীগ ভেঙে গড়েন আওয়ামী মুসলিম লীগ।
আওয়ামী শব্দটা আরবি। শব্দগত অর্থে জনসাধারণ। অর্থাৎ আওয়ামী মুসলিম লীগ বলতে বোঝায় জনগণের মুসলিম লীগ। পরে মুসলিম কথাটা বাদ পড়ে দলের নাম দাঁড়ায় আওয়ামী লীগ। লীগ শব্দটা ল্যাটিন, বাংলা ভাষার নয়। লীগ বলতে ঠিক দল বোঝায় না। বোঝায় পরস্পরের সহযোগী মানুষের সঙ্ঘ। কার্ল মার্কস পার্টি ও লীগ শব্দ দু’টিকে এক করে দেখেননি। তিনি গড়তে সাহায্য করেছিলেন কমিউনিস্ট লীগ। ঢাকায় মুসলিম লীগ গঠিত হলেও বাংলার মুসলমানদের প্রধান দল হয়ে ওঠেনি। একসময় বাংলার মুসলমানদের প্রধান দল ছিল ফজলুল হক সাহেবের কৃষক প্রজা পার্টি। অবশ্য এ দলে হিন্দুরাও যোগ দিতে পারত। কৃষক প্রজা পার্টি একপর্যায়ে হয়ে উঠেছিল বাংলার মুসলমানদের প্রধান দল। অনেক পরে মুসলিম লীগ হয়ে ওঠে তখনকার সারা ভারতের মতো বাংলার মুসলমানদেরও প্রধান দল। বাংলার মুসলমান পকিস-ান প্রতিষ্ঠার দাবিকে সমর্থন করেছিল। ১৯৪০ সালে লাহোরে মুসলিম লীগের বিখ্যাত ‘পাকিস্তান প্রস-াব’ উত্থাপন করেছিলেন বাংলার বিখ্যাত নেতা আবুল কাশেম ফজলুল হক। আজ বোঝানোর চেষ্টা চলেছে, পাকিস-ান গঠিত হয়েছিল বাংলাভাষী মুসলমানকে বিবেচনায় না রেখে, কিন' ইতিহাস তা বলে না। এই উপমহাদেশ পাকিস-ান ও ভারতে বিভক্ত হওয়ার অনেক আগে, ১৯০৫ সালে তখনকার বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি বিভক্ত হয়েছিল। বাংলাভাষী মুসলমান এই বিভক্তিকে স্বাগত জানিয়েছিল। যার মূলে কাজ করেছিল একটা মুসলিম স্বতন্ত্র চেতনা। ইতিহাসের এই পটভূমিকে মনে না রাখলে আজকের বাংলাদেশের উদ্ভবকে বিশ্লেষণ করা যায় না।
এই উপমহাদেশে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা করা হয় ১৯১৪ সালে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার মূলে তিনজন ব্রিটিশ কমিউনিস্ট বিশেষ অবদান রাখেন। তারা হলেন- জন ব্রাডলি, হাচিংসন ও ফিলিপসপ্রাস্ট। এ তিনজনের মধ্যে ফিলিপসপ্রাস্টের অবদানই ছিল সবচেয়ে বেশি। কমিউনিস্ট দর্শন সরাসরি রাশিয়া থেকে ভারতে আসেনি; এসেছে গ্রেট ব্রিটেন ঘুরে। কিন' ব্রিটেনের রাজনীতিতে কমিউনিস্টরা কোনো দিনই উল্লেখযোগ্য শক্তিতে পরিণত হতে পারেনি। উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে ব্রিটিশ লেবার পার্টি। ১৯৪৫ সালের নির্বাচনে গ্রেট ব্রিটেনে লেবার পার্টি ক্ষমতায় আসে। লেবার পার্টির শাসনামলে ১৯৪৭ সালে ভারত পায় স্বাধীনতা। আর সেই সাথে সৃষ্টি হয় সাবেক পাকিস-ান। পাকিস-ান হয়েছিল ভারতের কংগ্রেস দলের সাথে একটা সমঝোতা করেই। কংগ্রেস সে সময় ভেবেছিল পাকিস্তানের দাবি না মানলে ব্রিটেন এই উপমহাদেশ ছাড়বে না। কংগ্রেস পাকিস-ানের দাবিকে মেনে নেয় কৌশলগত কারণেই; কিন' বরাবরই চেয়েছে পাকিস্তানের বিলুপ্তি। ১৯৭১ সালে সাবেক পাকিস্তানকে ভেঙে দেয়া সম্ভব হয়। ইন্দিরা গান্ধীও বাংলাদেশের স্বাধীনতা মেনে নেন কৌশলগত কারণেই। তিনি ভেবেছিলেন ধীরে ধীরে বাংলাদেশকে ভারতের অঙ্গীভূত করে নেয়ারই কথা। ১৯৭১ সালে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সাথে ভারত সরকারের একটি গোপন চুক্তি হয়। সে চুক্তিতে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের কোনো পৃথক সেনাবাহিনী থাকবে না; থাকবে কেবল মিলিশিয়া। বাংলাদেশে স'ায়ীভাবে থাকবে ভারতীয় সৈন্য। ভারতের হাতে থাকবে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষার ভার। কিন' এই চুক্তিটি শেষ পর্যন- টিকতে পারেনি। টিকতে না পারার একটি কারণ হলো মার্কিন চাপ। আর একটি বড় কারণ হলো, শেখ মুজিবের বিরোধিতা। যতগুলো কারণে তাজউদ্দীনের রাজনৈতিক পরাজয় ঘনিয়ে আসে, তার মধ্যে একটি ছিল এই গোপন চুক্তি। আমি এই চুক্তির কথা প্রথম অবগত হতে পারি ভারতের বিজেপি দলের পূর্বসূরি, জনসঙ্ঘ দলের ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা থেকে। এ বিষয়ে অবগত হই পশ্চিমবঙ্গের একজন মুসলিম নাগরিকের কাছ থেকেও। ১৯৬০-এর দশকে এই উপমহাদেশে কমিউনিস্ট পার্টি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। সাবেক কমিউনিস্ট পার্টির একটি অংশ পরিচালিত হতে থাকে সোভিয়েত ইউনিয়নের নির্দেশে। অপর অংশ পরিচালিত হতে থাকে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাবে। ১৯৭১-এর যুদ্ধকে চীনপন'ী কমিউনিস্টরা মুক্তিযুদ্ধ বলেনি। বলেছে এই যুদ্ধ হচ্ছে, ভারতের ষড়যন্ত্রের ফল, যার লক্ষ্য বাংলাদেশকে স্বাধীন করা নয়, সাবেক পাকিস-ান রাষ্ট্রকে দুই টুকরো করে দেয়া মাত্র। অন্য দিকে সোভিয়েত প্রভাবিত কমিউনিস্টরা ১৯৭১-এর যুদ্ধকে মুক্তিযুদ্ধ আখ্যা দেয়। প্রবাসী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন সোভিয়েতপন'ী কমিউনিস্ট। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার চলেছে মূলত সোভিয়েত-নির্ভর কমিউনিস্টদেরই পরিচালনায়। শেখ হাসিনা সিপিবির সাথে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছেন। কিন' সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়েছে। সিপিবি বহন করছে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন-নির্ভর কমিউনিস্টদেরই ঐতিহ্য; যারা আজ মোটেও শক্তিশালী নয়। সোভিয়েত-নির্ভর কমিউনিস্ট পার্টি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে একটি গভীর সমঝোতা হতে পেরেছিল ১৯৭৫ সালে। মূলত তাদের কথা অনুসারে গঠিত হয়েছিল বাকশাল। কিন' বাকশাল গঠন দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে ঠেলে দিয়েছিল বিরাট বিপর্যয়ের মধ্যে। বাংলাদেশের মানুষ মেনে নিতে চায়নি এক দলের রাজত্ব। বিশেষ করে কমিউনিস্টদের প্রাধান্য। আজ আবার নতুন করে আওয়ামী লীগ ও সিপিবি ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। এই ঐক্যের ফল যে শুভ হবে, এমন ভাবা যায় না। সিপিবি বলছে, তারা ১৯৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে অগ্রধিকার দেবে। তারা চাচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীকে ধ্বংস করতে। এভাবে দেশের দু’টি বড় রাজনৈতিক দলকে ধ্বংস করে তারা দেশকে চাচ্ছে একদলীয় রাজনীতির আওতায় নিয়ে আসতে। আওয়ামী লীগকে সামনে রেখে দেশের রাষ্ট্রক্ষমতা অধিকার করতে। কিন' তাদের এই চেষ্টার ফলে দেশে ভয়াবহ সংকট অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে যার ফল চলে যেতে পারে তাদের অভিলাষের সম্পূর্ণ বিপক্ষে।
উদার গণতন্ত্রের সাফল্য নির্ভর করে জনমত, রাজনৈতিক দল এবং অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ওপর। যে গ্রেট ব্রিটেনের কাছ থেকে আমরা আধুনিক গণতন্ত্রের ধারণা লাভ করেছি, সেই দেশে এই তিনের অভাব ঘটেনি। ব্রিটেনে যায় ইচ্ছেমতো দল গড়া ও জনমত গঠন করা। নির্বাচন হয় নিরপেক্ষ ও অবাধ। ব্রিটেনে কোনো দলই চায় না, নির্বাচনে কারচুপি হোক। কিন' বাংলাদেশে এই পরিসি'তি বিরাজ করছে না। বাংলাদেশে তাই উঠেছিল নির্বাচনের সময় পৃথকভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের দাবি। আজ আওয়ামী লীগ চাচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস'া বাতিল করতে। জনমনে তাই আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিলেতে গণতন্ত্র সফল হয়েছে; কারণ বিলেতে রাষ্ট্র (State) ও সরকারকে (Government) সমার্থক ভাবা হয় না। রাষ্ট্র একটি স'ায়ী প্রতিষ্ঠান। সেখানে সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে যে রাজনৈতিক দল সরকার গঠনের যোগ্যতা অর্জন করে, সেই দল কর্তৃক সরকার গঠিত হয়। বিলেতে কোনো রাজনৈতিক দল প্রশাসনে হস-ক্ষেপ করে না। প্রশাসন চলে দেশের প্রতিষ্ঠিত আইন অনুসরণ করে। প্রশাসনের আছে একটা পৃথক সত্তা। কিন' আমাদের দেশে রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে পার্থক্য বজায় রাখা হচ্ছে না। প্রশাসনে করা হচ্ছে সরকারি হস-ক্ষেপ; যা হয়ে উঠছে মানবাধিকার ও আইনের শাসনের পরিপন'ী। মানবাধিকার ও আইনের শাসন বাদ দিলে অচল হয়ে পড়তে চায় গণতন্ত্র। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার কলকাতা থেকে বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনার মোস-াফিজুর রহমানকে ঢাকায় ফিরিয়ে আনল। তার অপরাধ, তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সরাসরি জানান, পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশের সাথে তিস-ার পানিবণ্টনে দিল্লির চুক্তি সইয়ের বিরুদ্ধে অবস'ান গ্রহণ করেছেন এবং তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সাথে ঢাকা সফরে যাবেন না। জনাব রহমানকে কলকাতা থেকে ঢাকায় আনা হলো। কারণ তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-সংক্রান- খবরটি গোপনে জানতে পেরে সরাসরি বাংলাদেশ সরকারকে অবহিত করেন। প্রটোকল অনুসারে তার উচিত ছিল খবরটি দিল্লিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনারকে জানানো। কিন' তিনি সেটা না করে খবরটি সরাসরি জানান বাংলাদেশ সরকারকে। এটা নাকি ‘গুরুতর অপরাধ’। কিন' আমাদের মনে হয়, কলকাতা থেকে তাকে সরিয়ে নেয়া হলো ভারতের চাপে। আর আওয়ামী লীগ সরকার তাকে এভাবে সরিয়ে এনে করল ক্ষমতার অপব্যবহার। অন্য কোনো দেশ হলে এটা তারা করতে যেত না।
আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি বলছেন, দিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার তাকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে কোনো সংবাদ সরবরাহ করেননি। তাই তিনি ভেবেছিলেন, তিস-ার পানিবণ্টন চুক্তি হবেই। কলকাতায় বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনার এক অমার্জনীয় অপরাধ করেছেন। কিন' এ কথা ভাবার কোনো সঙ্গত কারণ আছে বলে আমাদের মনে হচ্ছে না। আমরা সরকারি লোক নই। আমরা কলকাতার বিশেষ টিভি চ্যানেল ‘২৪-ঘণ্টা’ প্রদত্ত খবরের মাধ্যমে অনেক আগেই জেনেছিলাম, তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি হবে না। কিন' দিল্লিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার এবং প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উপদেষ্টা গওহর রিজভী বলছিলেন, তিস-ার পানিবণ্টন চুক্তি হবেই হবে। এর ফলে সৃষ্টি হয় বিরাট বিভ্রানি-। বাংলাদেশ সরকারের উচিত ছিল ডেপুটি হাইকমিশনারের দেয়া খবরকে গুরুত্ব দেয়া। কিন' সেটা না করে তাকে দেয়া হলো শাসি-। এ রকম শাসি- দেয়া হতে থাকলে প্রশাসন অচল হয়ে পড়বে। চালানো যাবে না দেশ। কমিউনিস্টরা রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে কোনো পার্থক্য করতে চায় না। কমিউনিস্টদের প্রভাবে আওয়ামী লীগ এ ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে বাড়িয়ে তুলবে আরো জটিলতা।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

প্রসঙ্গ আলবার্ট আইনস্টাইন


২০১২-০১-০৯

সাংবাদিকের অন্যতম কাজ প্রতিদিনের কোলাহলকে দৈনিক পত্রিকার পাতায় বহন করে আনা। আলবার্ট আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব নিয়ে বৈজ্ঞানিক সমাজে এখন যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে এবং যা নিয়ে চলেছে যথেষ্ট শোরগোল। আমি চেয়েছিলাম নয়া দিগনে-র পাঠকদের কাছে তা বহন করে আনতে (নয়া দিগন- ২১ নভেম্বর, ২০১১)। আমি ভাবিনি ড. এস এম লুৎফর রহমানের মতো কোনো প্রাজ্ঞ ব্যক্তি আমার লেখার প্রতিবাদ করবে (নয়া দিগন- ৩ জানুয়ারি, ২০১২)। আমি বর্তমান সপ্তাহে নয়া দিগনে- কলাম লিখতে চেয়েছিলাম অন্য এক বিষয়ে। কিন' আমার সেই পরিকল্পনা স'গিত রেখে আইনস্টাইন সম্পর্কে করতে চলেছি আরো কিছু আলোচনা। আইনস্টাইন নিয়ে আলোচনা করতে হলে নিউটনের কথা আসে। কিন' আইনস্টাইন সত্য হলে নিউটন অনেক ক্ষেত্রে অনেক পরিমাণে বাতিল হয়েই যান। অষ্টাদশ শতাব্দীতে বিলাতের কবি আলেকজান্ডার পোপ লিখেছিলেন-
Nature and nature’s laws hid in night:
God said, ‘Let Newton be!’ and all was light.
কিন' এখন আর এ কথা বলা চলে না। তবে মনে হচ্ছে আলবার্ট আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব বাতিল হলে আমরা আবার ফিরব কিছুটা নিউটনেরই দিকে। ড. রহমান বলছেন, আমি আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা করেছি। কিন' আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব সম্পর্কে কিছু আলোচনা করিনি। আমি এটা ইচ্ছা করেই করিনি। কারণ, সাধারণ অপেক্ষিক তত্ত্ব আমি কখনোই বুঝে উঠতে পারিনি। আর যা বুঝে উঠতে পারিনি তা নিয়ে আলোচনা আমার জন্য মোটেও সহজসাধ্য নয়। সমুদ্রে প্রতিদিন দু’বার জোয়ার-ভাটা আসে। নিউটন একে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন প্রধানত চাঁদের আকর্ষণের মাধ্যমে। আমরা ছাত্রদের এখনো পড়াই নিউটনের দেয়া জোয়ার-ভাটার ব্যাখ্যা। কিন' আইনস্টাইনের সাধারণ অপেক্ষিক তত্ত্বে বলা হয়, নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্ব সত্য নয়। চাঁদের টানের ধারণাটা একটা বিভ্রানি- মাত্র। আমার কাছে মনে হয় আইনস্টাইনের বক্তব্য এ ক্ষেত্রে বোঝা খুবই কঠিন। অবশ্য আমার কাছে কোনো কিছু বোঝা কঠিন হলে যে তাকে মিথ্যা বলতে হবে এমন দাবি আমি করছি না। তবে আইনস্টাইনের সাধারণ অপেক্ষিক তত্ত্ব এখনো বৈজ্ঞানিক সমাজে সেভাবে স্বীকৃত নয়। এটা জানতে পারি অনেক বিশেষজ্ঞের লেখার মাধ্যমে। পরমাণু বিজ্ঞানে পরমাণুর গঠন সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলা হয় তা কতকটা সৌরজগতের মতো। সৌরজগতে গ্রহরা প্রদক্ষিণ করছে সূর্যকে। আর পরমাণুর ক্ষেত্রে ইলেক্ট্রন কণিকারা প্রদক্ষিণ করে পরমাণু কেন্দ্রকে। পরমাণু কেন্দ্র দু’রকম কণিকা দিয়ে গঠিত। একধরনের কণিকাকে বলা হয় প্রোটন। এরা পজিটিভ তড়িৎযুক্ত। আর এক কণিকাকে বলা হয় নিউট্রন। এরা তড়িৎশূন্য। ইলেক্ট্রন কণিকারা নেগেটিভ তড়িৎযুক্ত। এরা পজিটিভ তড়িৎযুক্ত পরমাণু কেন্দ্রের চার দিকে ঘুরছে পজিটিভ ও নেগেটিভ তড়িতের আকর্ষণের কারণে। আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বে পজিটিভ ও নেগেটিভ বিদ্যুতের আর্কষণের কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না লোহা ও চৌম্বকের আকর্ষণের। আইনস্টাইনের সাধারণ অপেক্ষিক তত্ত্ব থেকে গিয়েছে অসম্পূর্ণ। পক্ষান-রে আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্ব বৈজ্ঞানিক সমাজে পেতে পেরেছে বিশেষ স্বীকৃতি। কিন' মনে হচ্ছে তার বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্ব মিথ্যা প্রমাণিত হবে। মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে এমন নয়। ইলেক্ট্রন, প্রোটন, নিউট্রনের মতো নিউট্রিনো হলো একধরনের মৌল বস' কণিকা। নিউট্রিনোরা কতকটা নিউট্রনের মতো। কিন' এরা নিউট্রন থেকে অনেক ছোট। নিউট্রনের মতো এরা তড়িৎবিহীন। তাই এদের নাম দেয়া হয়েছিল নিউট্রিনো। আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্বানুসারে কোনো কিছুর গতিবেগ আলোর গতিবেগের চেয়ে বেশি হতে পারে না। কিন' কিছু বৈজ্ঞানিক সমপ্রতি (সেপ্টেম্বর ২০১১) দাবি করেছেন, নিউট্রিনোদের গতিবেগ হতে পারে আলোর গতিবেগের চেয়ে বেশি। আরো গবেষণার মাধ্যমে যদি এসব বিজ্ঞানকর্মীদের দাবি যথার্থ বলে প্রমাণিত হয় তবে আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্ব বাতিল হয়ে যাবে। তাকে ধরে রাখা সম্ভব হবে না। আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্বের যথার্থতা নিয়ে এর আগেও প্রশ্ন উঠেছে। আইনস্টাইন মারা যান ১৯৫৫ সালে। ১৯৬০-এর দশকে জ্যোতির্বিদেরা এমন কিছু জ্যোতিষ্কের সন্ধান পান, যাদের তারা নাম দেন কোয়াসার। এরা কতকটা নক্ষত্রের মতো। কিন' অন্য নক্ষত্রের তুলনায় এরা আকৃতিতে অনেক ছোট। কিন' এরা অন্য নক্ষত্রের তুলনায় খুবই দীপ্তিমান। এদের এই দীপ্তিকে আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্বের সাহায্যে ব্যাখ্যা করা যায় না। আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্বের সমীকরণ অনুসারে বস' থেকে শক্তির উদ্ভব হওয়া সম্ভব। কিন' এদের ক্ষেত্রে এত আলোকশক্তির উদ্ভব কিভাবে হতে পারছে সেটার ব্যাখ্যা দেয়া এখনো সম্ভব হয়নি। তড়িৎ-চুম্বক শক্তির ব্যাখ্যা দেয়া যায় না আইনস্টাইনের তত্ত্বের সাহায্যে। আইনস্টাইনের তত্ত্বের সাহায্যে ব্যাখ্যা দেয়া যায় না কোয়াসারদের দীপ্তির। আর এখন প্রশ্ন উঠছে নিউট্রিনোদের গতিবেগ নিয়ে। আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্ব হয়ে উঠছে খুবই প্রশ্ন সাপেক্ষ। আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্ব না টিকলে তার সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বও যে টিকবে, এমন আশা করা যায় না। আমি তাই বুঝতে সক্ষম হচ্ছি না যে, ড. এস এম লুৎফর রহমান কী করে দাবি করতে পারছেন যে, আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব কখনো মিথ্যা হওয়ার নয়। আমি আমার আলোচনায় বলেছিলাম, বৈজ্ঞানিক কোনো তত্ত্বের গ্রহণযোগ্যতা শেষ পর্যন- নির্ভর করে পরীক্ষামূলক প্রমাণের ওপর। কোনো গাণিতিক ধারণা দিয়ে শেষ পর্যন- কোনো বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের প্রমাণ করা চলে না। ড. রহমান এ ক্ষেত্রে আমার সাথে একমত নন। তিনি মনে করেন, গাণিতিক ধারণার একটা বিশেষ মূল্য আছে। আমি গাণিতিক বিশ্লেষণের মূল্য স্বীকার করি। কিন' মনে করি, পরীক্ষামূলক প্রমাণই হলো বিজ্ঞানের শেষ ভিত্তি। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অনেক তত্ত্বের উদ্ভব হয়েছে, যা এখন আর স্বীকৃত নয়। কারণ নতুন তথ্য তাদের মিথ্যা প্রমাণ করেছে। আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে অনুরূপ ঘটনা। এতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই।
ব্যক্তি আইনস্টাইনকে ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে অনেক রূপকথা। অনেকের কাছে তিনি হয়ে উঠেছেন অতিমানব বা সুপারম্যান। কিন' তাকে অতিমানব ভাবার কোনো কারণ আছে বলে আমার মনে হয় না। কারণ আইনস্টাইনের মৃত্যুর পর তার মগজ নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হয়েছিল কিছু গবেষণা। এতে দেখা যায় যে, আইনস্টাইনের মগজের গড়ন আর সব সাধারণ মানুষেরই মতো। তার মগজ কোনো বিশেষ গঠনসম্পন্ন নয়। যা থেকে বলা যায় তার মগজ ছিল আমাদের মতো মানুষের থেকে গুণগতভাবেই আলাদা। একটা হিসাব অনুসারে মানুষের মগজে থাকে ২০০ কোটি স্নায়ুকোষ। কিন' এদের সবাই সক্রিয় থাকে না। প্রতিভাবান ব্যক্তি তারাই, যাদের মসি-ষ্কে অধিকসংখ্যক স্নায়ুকোষ সক্রিয় থাকে এবং কোনো বিশেষ চিন-াপ্রক্রিয়ায় অংশ নেয়। মানুষ চেষ্টার মাধ্যমে তার চিন-াশক্তিকে বাড়াতে পারে। সক্রিয় করে তুলতে পারে মসি-ষ্কের অধিকসংখ্যক স্নায়ুকোষকে। তাই আছে বুদ্ধি চর্চার একটা বিশেষ মূল্য। আমাদের চিন-াক্ষমতা, আমাদের অর্জিত জ্ঞানের ওপরও নির্ভর করে। মানুষে মানুষে চিন-ার পার্থক্য হতে দেখা যায়। এর একটা কারণ হলো জ্ঞানের পার্থক্য। আমাদের জ্ঞান আবার শেষ পর্ষন- নির্ভর করে আমাদের অভিজ্ঞতার ওপর। আমাদের জ্ঞান অভিজ্ঞতানির্ভর। সবার জীবনের অভিজ্ঞতা এক নয়। সবার চিন-া-চেতনা তাই ঠিক একই খাতে প্রবহমান হয় না। দেখা দেয় মতবাদিক বিরোধ। বৈজ্ঞানিকদের মধ্যেও একইভাবে মতবাদিক বিরোধের সৃষ্টি হতে পারে। আইনস্টাইনের সাথে সব বৈজ্ঞানিকের ঐকমত্য হতে পারেনি। তবে যেহেতু পরীক্ষা-প্রমাণ আইনস্টাইনের পক্ষে গিয়েছে, তাই আইনস্টাইন পেতে পেরেছেন বিশেষ স্বীকৃতি। এখন যদি পরীক্ষা-প্রমাণ তার মতের পরিপন'ী হয়, তবে তা নিশ্চয় হারাবে গ্রহণযোগ্যতা। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিকের খ্যাতি দিয়ে সত্য নির্মিত হয় না। আইনস্টাইন সম্পর্কে তার জীবনীকাররা আগে যা বলতেন, এখন আর তা বলছেন না। আইনস্টাইন জীবনে দু’বার বিয়ে করেছিলেন। তার প্রথমা স্ত্রী ছিলেন সারবিয়ান মেয়ে। তিনি জার্মান ছিলেন না। ধর্মে তিনি ছিলেন না আইনস্টাইনের মতো ইহুদি। তিনি সুইজারল্যান্ডে ছিলেন আইনস্টাইনের সতীর্থ। আইনস্টাইন ছাত্রজীবনেই তাকে বিয়ে করেন। এই মহিলার ছিল অসাধারণ গাণিতিক প্রতিভা। কারো কারো মতে এই মহিলার কাছ থেকেই আইনস্টাইন লাভ করেন তার বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্বের কাঠামো। কিন' আইনস্টাইন কোনো দিনই স্বীকার করেননি তার চিন-ার মূলে স্ত্রীর অবদান। তার এই স্ত্রীর গর্ভে আইনস্টাইনের দুই পুত্রের জন্ম হয়। আইনস্টাইন তার এই স্ত্রীকে তালাক দেন অত্যন- অকারণে। বিয়ে বিচ্ছেদের পর তার সাবেক স্ত্রী পড়েন বিরাট বিপর্যয়েরই মধ্যে। সাবেক স্ত্রীর বৈজ্ঞানিক চিন-া-চেতনার বিকাশে আসে ছেদ। তিনি গ্রহণ করেন সুইজারল্যান্ডে স্কুল শিক্ষিকার চাকরি। অনেক কষ্টের মধ্যে মানুষ করেন তার দুই পুত্রকে। আইনস্টাইনের সাবেক স্ত্রী নেননি আইনস্টাইনের কাছ থেকে তার পুত্রদের ভরণ-পোষণের জন্য কোনো আর্থিক সাহায্য। আইনস্টাইন যাকে পরে বিয়ে করেন, তিনি ছিলেন আইনস্টাইনের চাচাতো বোন। তার এই চাচাতো বোনের আগে বিয়ে হয় অন্য এক ব্যক্তির সাথে। যার মৃত্যুর পর তিনি বিয়ে করেন আইনস্টাইনকে। অনেকে বলেন বিয়ের আগেই আইনস্টাইনের সাথে ওই মহিলার নাকি ছিল এক বিশেষ ধরনের সম্পর্ক। আর এই সম্পর্কের কারণেই আইনস্টাইন তালাক দেন তার প্রথম স্ত্রীকে। আইনস্টাইনকে আগে যে রকম নিরীহ ভাবভোলা মানুষ বলে মনে করা হতো, এখন আর তা মনে করা সম্ভব হচ্ছে না। আইনস্টাইন জীবনে রাজনীতিও করেছেন। আইনস্টাইন ছিলেন জিওনিস্ট (Zionist)। আজকের ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল স'াপনে আছে তার অবদান। ইহুদি লবি এখন আইনস্টাইনকে চিত্রিত করতে চাচ্ছেন একজন অতিমানব হিসেবে। জানি না এর একটা প্রভাব এসে পড়েছে কি না ড. রহমানের ওপর। একাধিক বৈজ্ঞানিক বলেছেন, আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব নাকি প্রমাণ করেছে বস'জগৎ বলে কিছু নেই। কিন' প্রশ্ন করা যায়, ইউরোনিয়াম-২৩৫ না থাকলে কি আণবিক বোমা তৈরি হতে পারত? এ কথা ঠিক যে, আণবিক বোমা তৈরি করতে অনেক অঙ্কের হিসাব করতে হয়েছে। কিন' তা বলে ইউরোনিয়াম-২৩৫ নামক ধাতুর অসি-ত্ব মিথ্যা হয়ে যায়নি। ধাতুটি আগেও ছিল। তার অসি-ত্ব ছিল না বৈজ্ঞানিকদের চিন-ানির্ভর। মানুষ প্লুটোনিয়াম দিয়ে পরমাণু বোমা বানায়। প্লুটোনিয়াম তৈরি করা হয় ইউরোনিয়াম-২৩৮ থেকে। ইউরোনিয়াম-২৩৮ ইউরোনিয়াম-২৩৫ থেকে অনেক সহজলভ্য। ইরান ইউরোনিয়াম-২৩৮ থেকে প্লুটোনিয়াম তৈরি করতে চাচ্ছে। কিন' মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল চাচ্ছে এতে বাধা দিতে। প্লুটোনিয়াম কেবলই অঙ্কের একটা হিসাব মাত্র নয়। তার আছে নিজস্ব অসি-ত্ব। ইরান মার্কিন চাপের কাছে নতি স্বীকার করতে চাচ্ছে না। এর ফলে মার্কিন- ইরান সম্পর্ক হয়ে উঠেছে বিশেষভাবে উত্তপ্ত। আমি জানি না ড. রহমান এ প্রসঙ্গে যথেষ্ট সচেতন কি না। বাংলাদেশের মানুষ ইরানের প্রতি হয়ে উঠেছে যথেষ্ট সহানুভূতিশীল। তবে শোনা যায় ইসরাইলের গোয়েন্দা চক্র বাংলাদেশে সক্রিয় আছে। মুসলিম অধ্যুষিত দেশের মধ্যে একমাত্র পাকিস-ানের হাতেই আছে পরমাণু বোমা।
পাকিস-ানের হাতে পরমাণু বোমা আছে বলেই কারো কারো মতে বাংলাদেশ এখনো তার পৃথক রাষ্ট্রিক অসি-ত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হচ্ছে। না হলে ভারত বাংলাদেশকে এত দিনে গ্রাস করেই ফেলত।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথম পরমাণু বোমা বানাতে সক্ষম হয়। আলবার্ট আইনস্টাইন জার্মানি থেকে পালিয়ে যান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। গ্রহণ করেন মার্কিন নাগরিকত্ব। আইনস্টাইন তদানীন-ন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন দ্য রুজভেল্টকে একটি চিঠি লেখেন। তিনি তার এই চিঠিতে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে অনুরোধ করেন পরমাণু বোমা নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করতে। প্রধানত আইনস্টাইনের চিঠির ওপর নির্ভর করেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট পরমাণু বোমা নির্মাণের জন্যে অর্থ বরাদ্দ করেন। নির্মিত হতে পারে পরমাণু বোমা। আইনস্টাইনকে অনেকে বলেন শানি-বাদী। কিন' আইনস্টাইনের জন্যই হতে পেরেছে ভয়াবহ পারমাণবিক বোমার উদ্ভব।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট