রবিবার, ২২ এপ্রিল, ২০১২

দুর্নীতি নিয়ে কথা

দুর্নীতি নিয়ে কথা


আত্মপক্ষ

॥ এবনে গোলাম সামাদ ॥

দুর্নীতির একটা সংজ্ঞা দেয়া কঠিন। তবে সাধারণভাবে বলা যায়, দুর্নীতি সমাজজীবনের জন্য তিকর নীতি, যা সমাজসঙ্গতির বিনষ্ট ঘটায়। ঘটায় অনেক লোকের তি। খবরের কাগজে একটা ছোট্ট খবর পড়লাম। ঘটনাটি ঘটেছে যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান অঙ্গরাষ্ট্রে। সেখানকার এক বাসিন্দা আমান্ডা কেটন, যার বয়স ২৫ বছর, লটারিতে টাকা পেয়েছেন সাত লাখ ৩৫ হাজার ডলার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক অঙ্গরাষ্ট্রে লটারিকে মনে করা হয় দুর্নীতি। কারণ মানুষকে লটারি হঠাৎ পাইয়ে দেয় বিনা শ্রমে অনেক টাকা। শ্রমবিহীনভাবে অর্থ লাভকে সেখানে মনে করা হয় সমাজজীবনের জন্য তিকর। কারণ মানুষ এতে হয়ে উঠতে চায় নিছক ভাগ্যবাদী। চায় হঠাৎ টাকা পেয়ে বড়লোক হতে। কিন্তু লটারিতে টাকা পেয়ে খুব কম লোকই বাস্তবে বড়লোক হতে পারে। বহু লোক লটারির টিকিট কিনে তিগ্রস্ত হয়। লটারিতে টাকা পেয়েছেন আমান্ডা কেটন। তিনি ছিলেন খুবই দরিদ্র। মিশিগানের নিয়মানুসারে তিনি রেশনে খাবার কিনে খেতেন। এ রকম সস্তা রেশন গরিব মানুষকে দেয়া হয়। কিন্তু লটারিতে অত টাকা পাওয়ার পরেও কেটন সস্তায় রেশন নিয়েছেন। এ কারণে হয়েছে তার বিরুদ্ধে মামলা। মামলায় তিনি দোষী প্রমাণিত হলে তার হবে চার বছর সশ্রম কারাদণ্ড। মিশিগানের আইনানুসারে কেবল যারা দরিদ্র হিসেবে বিবেচিত, তারাই পেতে পারে রেশনে সস্তায় খাদ্য কিনতে। এই আইন ভঙ্গ করে আমান্ডা কেটনকে দাঁড়াতে হচ্ছে অপরাধীর কাঠগড়ায়। আইন ভঙ্গ করা দুর্নীতির অংশ। তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে মিশিগানের মানবাধিকার সংস্থা। এই সংস্থা বলেছে, কেটন রাতারাতি লটারিতে টাকা পেয়ে গরিব থেকে পরিণত হয়েছেন ধনী ব্যক্তিতে। কিন্তু তিনি এ ঘটনাকে গোপন করে গ্রহণ করেছেন দরিদ্রের প্রাপ্য রেশন। কেটনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। দোষী সাব্যস্ত হলে তাকে পেতে হবে সাজা। ভাবছিলাম আমাদের দেশের কথা। আমরা গরিব মানুষকে বেশ কিছু েেত্র সস্তায় খাদ্যশস্য প্রদান করছি, যাকে বলা হচ্ছে ভিজিএফ (ভালনারেবল গ্র“প ফিডিং)। এতে অনেক দুর্নীতি হচ্ছে। এমন অনেকে ভিজিএফ খাচ্ছেন, যা তাদের পাওয়া উচিত নয়। তবে কোনো মামলা হচ্ছে না এদের বিপ।ে অন্তত আমার চোখে পড়েনি এ রকম মামলা হওয়ার খবর। ক’দিন ধরে পত্রিকায় পড়লাম সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের কথা। তিনি দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়ে হারালেন মন্ত্রিত্ব। কিন্তু আবার হতে পারলেন দফতরবিহীন মন্ত্রী। এ রকম কাণ্ড আর কোনো দেশে ঘটতে পারত কি না আমরা জানি না। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে মনে করতাম পাকা রাজনীতিবিদ। তিনি মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিয়ে যথাযথ কাজই করেছিলেন। কিন্তু আবার মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করে নিজেকে হালকা করে ফেললেন। এভাবে মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করা মনে হয়, আরো একটা বড় দুর্নীতি। রাজনীতির েেত্র সৃষ্টি করা হলো একটা খারাপ নজির। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এটা না করলেও পারতেন। এতে থাকত তার রাজনৈতিক পরিপক্বতার পরিচয়। আমার মনে পড়ছে, ভারতের বিখ্যাত রাজনীতিবিদ লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর কথা। তিনি একসময় ছিলেন রেলমন্ত্রী। তখন হয়েছিল একটা শোচনীয় রেল দুর্ঘটনা। তিনি এর জন্য রেলমন্ত্রিত্ব পদ থেকে দিয়েছিলেন ইস্তফা। এর অনেক পরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওয়াহের লাল নেহরুর মৃত্যুর পর লাল বাহাদুর শাস্ত্রী হন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। তার চারিত্রিক দৃঢ়তা তাকে প্রদান করেছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রিত্ব। ১৯৬৫ সালে হয় কাশ্মির নিয়ে পাক-ভারত যুদ্ধ। সে যুদ্ধের মীমাংসা করতে এগিয়ে আসে তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন। লাল বাহাদুর শাস্ত্রী চাননি পাকিস্তানের সাথে বিবাদ। তিনি গ্রহণ করেন যুদ্ধ স্থগিত রাখার প্রস্তাব, যা গ্রহণ করার পরপরই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে লাল বাহাদুর শাস্ত্রী মারা যান। আমাদের রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের কি লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর সাথে কোনো সুদূর তুলনা করা চলে? শাস্ত্রী লেখাপড়া করেছিলেন সংস্কৃত টোলে। তিনি ছিলেন নিষ্ঠাবান হিন্দু। আর ছিলেন অসাধারণ নৈতিকতাবান ব্যক্তি। কিন্তু সুরঞ্জিত মোটেও তা নন। হলে এ দেশের রাজনীতির ইতিহাস নিতে পারত একটা ভিন্ন ধরনের রূপ। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত যা করলেন, সেটা প্রমাণ করল তিনি আওয়ামী লীগের আর পাঁচজন মতালোভী মন্ত্রীর মতোই একজন অতি সাধারণ মতালোভী রাজনৈতিক নেতা। তার মধ্যে নেই কোনো উচ্চতর নৈতিক আদর্শের অনুপ্রেরণা। থাকলে সেটা এ দেশের সবার জন্য কল্যাণজনক হতে পারত। হতে পারত গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার েেত্র একটি বিশেষ পদপে। কিন্তু তা হলো না। দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি হলো বিশেষভাবে বিবর্ণ। আওয়ামী লীগের একজন নেতা আবদুল জলিল বলেছেন, সুরঞ্জিতের ঘটনায় যাওয়া যাচ্ছে না সভ্যসমাজে; আওয়ামী লীগের ভেতর থেকেও উঠছে এ ঘটনার প্রতিবাদ।
বিলাতে রেলগাড়ি চলতে শুরু করে ১৮২৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে। এর আগে সেখানে ছিল ঘোড়ায় টানা রেলগাড়ি, যা চলত রেললাইনের ওপর দিয়ে। কিন্তু গাড়িগুলো টানত অনেকগুলো ঘোড়া মিলে। ১৮২৫ সাল থেকে শুরু হয় বাষ্পচালিত ইঞ্জিনের সাহায্যে রেলগাড়ি চলা। এর ফলে বিলাতের যোগাযোগব্যবস্থায় ঘটে বিরাট বিপ্লব। এটাকে বলা চলে সে দেশের শিল্প বিপ্লবের অন্যতম বুনিয়াদ। এই উপমহাদেশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে প্রথম রেল চলে ১৮৫৩ সালে। রেল চালু হয়েছিল রেল কোম্পানির উদ্যোগে। এতে কোনো সরকারি উদ্যোগ ছিল না। ছিল বিলাতের বেসরকারি কোম্পানির উদ্যোগ। রেলগাড়ি ছিল একটা ব্যবসায়ের ব্যাপার। আর তা বিলাতে এবং এই উপমহাদেশে প্রতিষ্ঠা পায় বেসরকারি কোম্পানির মাধ্যমে। রেল কোম্পানির জন্য প্রয়োজনীয় মূলধন এই উপমহাদেশে এসেছিল বিলাত থেকে। প্রথম রেলগাড়ি চলে পশ্চিমবঙ্গে। আর এর অনেক পরে উত্তর-পূর্ববঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গে রেলগাড়ি চলার পর রানীগঞ্জ অঞ্চল থেকে মালগাড়িতে করে কয়লা আনা অনেক সহজ হয়। কলকাতার কাছে গঙ্গার দুই ধার দিয়ে এর ফলে ব্রিটিশ পুঁজিতে স্থাপিত হতে পারে অনেক পাটকল। পাট প্রধানত উত্তর ও পূর্ববঙ্গের ফসল। কিন্তু পাটকল গড়ে ওঠে পশ্চিমবঙ্গে। সেখানে ঘটে বেশ কিছু শিল্প বিপ্লব। কার্ল মার্কস বিলাতে শিল্প বিপ্লব ঘটার অন্যতম কারণ হিসেবে বলেছেন রেলগাড়ির প্রবর্তনকে। তিনি তার একটি লেখায় বলেছেন, রেলগাড়িকে নির্ভর করে তদানীন্তন ভারতে আসবে শিল্প বিপ্লব। আর শিল্প বিপ্লব উন্মুক্ত করবে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ। কিন্তু কার্ল মার্কসের এই ভবিষ্যদ্বাণী বিলাতে ও ভারতের েেত্র সত্য হতে পারেনি। এই উপমহাদেশে রেলগাড়ি এক সময় ছিল যোগাযোগব্যবস্থার মেরুদণ্ড। কিন্তু খনিজ তেল-ইঞ্জিন আবিষ্কার হওয়ার পর এই উপমহাদেশেও প্রচলিত হয় বাস, ট্রাক ও মোটরগাড়ি। রেলের আর আগের মতো গুরুত্ব থাকে না। কারণ মালগাড়িতে করে জিনিসপত্র নেয়ার খরচ পড়ে কম।
বাংলাদেশ ভৌগোলিক দিক থেকে বড় নয়। ভারতের তুলনায় এখানে রেলের গুরুত্ব হয়ে পড়েছে অনেক কম। তাই রেলমন্ত্রীর কোনো পদ এখানে ছিল না। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ভাবছে, যোগাযোগব্যবস্থায় রেল পালন করতে পারে বিশেষ ভূমিকা। রেলের মাধ্যমে সে চাচ্ছে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সাথে বিশেষ যোগাযোগব্যবস্থা স্থাপন করতে; বাণিজ্যিক যোগাযোগ বাড়াতে। সম্ভবত ভারত সরকারের বুদ্ধিতেই বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার সৃষ্টি করেছে রেলমন্ত্রীর পদ। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বর্তমানে কম করে আটটি স্থান দিয়ে সহজেই রেল যোগাযোগ স্থাপন করা যায়। ব্রিটিশ শাসনামলে এই যোগাযোগ ছিল। এটা আবার স্থাপিত হলে সুগম হবে পূর্ব এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের মধ্যে যোগাযোগব্যবস্থা। ভারত সরকার এখন এটা বিশেষভাবে গড়ে তুলতে চাচ্ছে। আর সে চাচ্ছে বাংলাদেশে এমন এক ব্যক্তি রেলমন্ত্রী হোন, যার ওপর থাকবে তার একটা বিশেষ প্রভাব। অনেকের ধারণা, এ কারণেই সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত হতে পেরেছিলেন রেলমন্ত্রী। কিন্তু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত জড়িয়ে পড়লেন এক অভাবিত অর্থ কেলেঙ্কারিতে। তাই তাকে ছাড়তে হলো রেলমন্ত্রীর পদ। পরে তিনি আবার হলেন দফতরবিহীন মন্ত্রী। তাকে দফতরবিহীন মন্ত্রী করে আওয়ামী লীগ হারালো তার ভাবমূর্তি। খবরে প্রকাশ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পুত্র পাঁচ কোটি টাকা দিয়ে খুলেছেন একটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান। তিনি কোনো লটারিতে টাকা পাননি। তিনি হঠাৎ কী করে এত টাকার মালিক হলেন, তাতে জাগছে অনেকের প্রশ্ন। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, তিনি যা কিছু করেছেন, তা করেছেন গণতন্ত্রের স্বার্থে। কিন্তু দুর্নীতিকে নির্ভর করে কোনো দেশেই গণতন্ত্র সাফল্য পেতে পারে না।
ভারতের গণতন্ত্র আমাদের শ্রদ্ধার বিষয়। কিন্তু সে দেশের গণতন্ত্র হয়ে উঠেছে প্রশ্নের সম্মুখীন। ভারতের সেনাবাহিনীতে টাটা কোম্পানির ট্রাক কেনা নিয়ে সংঘটিত ঘুষ কেলেঙ্কারি নিয়ে ঘটতে পেরেছে বিরাট অনুসন্ধান। টাটা কোম্পানির পে থেকে ভারতের সেনাপ্রধানকে দেয়া হয়েছিল ঘুষের প্রস্তাব। বলা হয়েছিল, তিনি যদি টাটা কোম্পানির ট্রাক কেনেন তবে তাকে দেয়া হবে ১৪ কোটি ভারতীয় টাকা ঘুষ। কিন্তু তিনি তা নিতে রাজি হননি। তাকে যারা ঘুষ দিতে চেয়েছিলেন তারা হলেন সেনাবাহিনীর সাথে সংশ্লিষ্ট সাবেক উচ্চপদস্থ কর্মচারী। ভারতের সেনাবাহিনীতে কে সেনাপ্রধান হবেন তা নিয়ে এখন সুপ্রিম কোর্টে হতে পারছে মামলা। ভারতের সেনাবাহিনীর ভেতরের অবস্থা ভালো নয়, যা ভারতের গণতন্ত্রকে করে তুলতে পারে বিপন্ন। দুর্নীতি সব দেশেই আছে, তবে তারা যে সব দেশেই বড় সমস্যা তা নয়। জেলখানা সব দেশেই আছে, কিন্তু তাই বলে সব দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এক নয়। বাংলাদেশে দুর্নীতি ছিল এবং হয়ে আছে রাষ্ট্র পরিচালনার েেত্র অন্যতম মূল সমস্যা। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ঘটনা এই বাস্তবতাকেই আমাদের কাছে আবার নগ্ন করে তুলল।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত একসময় বাম রাজনীতি করতেন। দেশে দেশে বাম রাজনীতিকেরা হয়ে পড়েছেন যথেষ্ট দুর্নীতিগ্রস্ত। বিরাট সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার একটা কারণ হলো দুর্নীতিগ্রস্ত বাম রাজনীতি। দণিপন্থী নেতাদের মধ্যে কাজ করে কিছু ধর্মবিশ্বাস। ধর্মচেতনা তাদের নৈতিক হতে কিছু অনুপ্রেরণা জোগায়। কিন্তু বাম নেতাদের মধ্যে ধর্মচেতনার অভাব তাদের অনৈতিক করে তোলে সহজেই। সুরঞ্জিত বাবুদের তথাকথিত ধর্মনিরপেতা করে তুলছে সহজেই অনৈতিক। তাদের রাজনীতিতে থাকছে না কোনো নীতি-চেতনার বিশেষ আদর্শ। 
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন