॥ এবনে গোলাম সামাদ ॥
ফরাসি দেশে নির্বাচন হয়ে গেল। নির্বাচনে হেরে গেলেন মধ্য ডানপন্থী হিসেবে পরিচিত নিকোলাস সারকোজি। প্রেসিডেন্ট থাকাবস্থায় নিকোলাস সারকোজি পরাজিত হন। ইতঃপূর্বে কোনো ফরাসি প্রেসিডেন্টকে এভাবে পরাজিত হতে হয়নি। ফরাসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন ফরাসি সমাজতন্ত্রী দলের প্রার্থী ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদে। ফরাসি দেশে দীর্ঘ দিন ধরে কোনো সমাজতন্ত্রী প্রেসিডেন্ট হননি। এর আগে সমাজতন্ত্রী প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন ফ্রাঁসোয়া মিত্রঁ। তিনি প্রেসিডেন্ট ছিলেন ১৯৮১ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত। মিত্রঁ সমাজতন্ত্রী হয়েও ফরাসি দেশে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির প্রবর্তন চাননি। বর্তমান সমাজতন্ত্রী প্রেসিডেন্টও যে চাইবেন তা মনে করার কোনো কারণ নেই। তিনি হয়তো জনকল্যাণে বরাদ্দ করবেন আরো কিছু বেশি অর্থ। যার ফলে ফরাসি দেশে বাড়বে জনকল্যাণের মাত্রা। ফরাসি সমাজতন্ত্রীরা ইউরোপের অন্যান্য দেশের সমাজতন্ত্রীদের মতো অনুসরণ করতে চাচ্ছেন কল্যাণব্রতী রাষ্ট্রের ধারণা। সাবেক সমাজতন্ত্রী ধ্যানধারণাকে তারা এখন আর আঁকড়ে ধরে রাখার পে নন। তারা কার্যত হয়ে উঠেছেন রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত মিশ্র অর্থনীতির প।ে তাদের আর বলা যায় না ঠিক সমাজতান্ত্রিক দর্শনের অনুসারী হিসেবে। ফরাসি সমাজ দার্শনিক ও রাজনীতিবিদ লিওঁ বুর্জোয়া (১৮৫১-১৯২৫) প্রচার করেন তার সমাজতান্ত্রিক দর্শন (Solidarism)। তিনি বলেন, সমাজে যারা অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জন করেন, তারা যে সেটা করতে পারেন কেবলই নিজের যোগ্যতার জন্য, তা নয়। সামাজিক পরিস্থিতি তাদের এই সাফল্য অর্জনে সুযোগ দেয়। এবং এনে দেয় তাদের সাফল্য। সুতরাং সম্পদে কেবল তাদের অধিকার থাকতে পারে না। সম্পদে তাদেরও অধিকার আছে, যারা অন্যকে সম্পদ অর্জনে সাহায্য করছে। আদর্শ সমাজে তাই সম্পদের বণ্টন হতে হবে এমনভাবে যে, যারা সম্পদ অর্জনে সহায়তা করছেন, তাদেরও অর্জিত সম্পদের ওপর থাকতে হবে কিছু অধিকার। অর্থনীতিকে হতে হবে সামাজিক, যাতে হতে পারে সমাজের সবারই কল্যাণ। বুর্জোয়া বলেন, এর জন্য বড়লোকদের আয়ের ওপর বসাতে হবে কর। আর এই করের টাকা দিয়ে সাহায্য করতে হবে গরিব জনসমষ্টিকে। তাদের থাকতে হবে জীবনযাত্রার ন্যূনতম মান, খেয়ে পরে বাঁচার অধিকার। শিাব্যবস্থা হতে হবে অবৈতনিক এবং সবার জন্য উন্মুক্ত। সবার জন্য থাকতে হবে দুর্ঘটনা-বীমা। শ্রমিকদের থাকতে হবে ন্যূনতম মজুরির বিধান। থাকতে হবে শ্রমসময়ের বিধান। সরকারকে নির্মাণ করতে হবে বাড়িঘর, যা মানুষ কিনতে পারবে সহজেই। থাকতে হবে বিনামূল্যে চিকিৎসার বিধান। এসব করতে পারলে সমাজসঙ্গতি বাড়বে। আর সমাজসঙ্গতি বাড়লে ঘটবে সামগ্রিকভাবে সমাজের উন্নতি। মোটামুটিভাবে ফরাসি সমাজতন্ত্রীর ধারণা, সমাজসঙ্গতি বাড়ানোর দর্শনের ধারণা এখন হয়ে উঠছে প্রায় একই রকম। সমাজতন্ত্রীরা এখন মনে করেন না যে, সমাজের অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য উৎপাদনের উপায় (means of production) রাষ্ট্রায়ত্ত করতেই হবে। তারা এখন বলেন না, কলকারখানা জমিজমা আর এক কথায় প্রাকৃতিক সম্পদ হতে হবে রাষ্ট্রিক। ব্যক্তিগত মালিকানা বলে থাকবে না আর কিছু। রাষ্ট্র পরিচালনা করবে একটা দেশের সমগ্র অর্থনীতিকে। সমাজতন্ত্র আর রাষ্ট্রতন্ত্র এখন আর একত্র করে দেখছেন না সমাজতন্ত্রীরা। তারা চাচ্ছেন উৎপাদিত সম্পদের সামাজিক সুবণ্টন। আর এক কথায় সামাজিক অর্থনীতি গড়ে তোলাকে। তারা মনে করছেন, তাদের আদর্শ হিসেবে ফ্রান্সে এক সময় কমিউনিস্টরা খুব শক্তিশালী হয়ে উঠেছেন। কিন্তু এখন তারা হয়ে পড়েছেন মতাশূন্য। কারণ ফ্রান্সের মানুষ গণতন্ত্র চায়। চায় না কোনো দলের একক শাসন। সমাজতন্ত্রী এবং কমিউনিস্টদের মধ্যে একটি বড় পার্থক্য হলো, সমাজতন্ত্রীরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন কিন্তু কমিউনিস্টরা তা করেন না। ফলে ফ্রান্সে তাদের প্রভাব এখন বিশেষভাবেই কমে গিয়েছে। ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদে তার নির্বাচনী প্রচারের সময় বলেন, তিনি বড়লোকদের ওপর কর বাড়াবেন। আর এই করের টাকায় গরিব জনসমষ্টির জীবনযত্রার মান বাড়াতে বিনিয়োগ করবেন। কিন্তু এ েেত্র উঠছে প্রশ্ন। তিনি বড়লোকদের ওপর কতটা কর আরোপ করবেন, আর সেই করের অর্থ কিভাবে ব্যয়িত হবে দরিদ্র জনসাধারণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে। এ েেত্র করের অর্থ অপচয় হওয়ার সম্ভাবনা থাকছে। এ প্রসঙ্গে ফরাসি কর-ব্যবস্থা নিয়ে কিছু কথা বলা যেতে পারে। ফরাসি কর-ব্যবস্থা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, সুইডেন, ডেনমার্ক ও নরওয়ের মতো নয়। এসব দেশে আয়করের মাত্রা হলো বেশি। এসব দেশে কর প্রধানত আরোপ করা হয় মানুষের আয়ের ওপর। এসব দেশে আয়কর ধরা হয় প্রগতিশীলভাবে। প্রগতিশীল বলতে বোঝায় আয় বাড়ানোর সাথে সাথে অধিক হারে কর দেয়ার বিধিকে। কিন্তু ফরাসি দেশে আয়ের ওপর করের মাত্রা ধার্য হয় কম। কর প্রধানত হলো পরো। করের বোঝা শেষ পর্যন্ত তাই গিয়ে পড়ে আয়ের ওপর নয়, খরচের ওপর। ফরাসি কর-ব্যবস্থায় প্রত্য করের চেয়ে পরো করের মাত্রা বেশি। পরো করের একটা বিশেষ দৃষ্টান্ত হলো বিক্রয় কর (Sale tax), যা আসলে হলো ক্রয় কর (Purchase tax)। ফরাসি দেশে তাই কর বাড়ানোর মাত্রা দাঁড়ায় বড়লোকের চেয়ে তুলনামূলক গরিব জনসাধারণের ওপর বেশি। এ ছাড়া বাড়ে ঘাটতি ব্যয়ের পরিমাণ। যা বাড়ায় মুদ্রাস্ফীতি (Currency inflation)। ফরাসি মুদ্রার ক্রয়মতা স্থিতিশীল রাখা হয়ে ওঠে খুবই কষ্টকর। ফরাসির বর্তমান সমাজতন্ত্রী প্রেসিডেন্ট তাই বড়লোকের ওপর কর বসিয়ে তুলনামূলক দরিদ্র জনসমষ্টির জীবনযাত্রার মান কিভাবে উন্নত করতে পারবেন তা নিয়ে থাকছে সংশয়। ফ্রান্স এখন ইউরো মুদ্রার অংশীদার। সে তার নিজের মুদ্রাব্যবস্থার ওপর আর আগের মতো নিয়ন্ত্রণ রাখে না। এ েেত্রও থাকছে মুদ্রা নিয়ন্ত্রণে সমস্যা। ফ্রান্সে এখন বেকার সমস্যা আগের তুলনায় বেড়েছে। ফ্রান্সের নেই আগের মতো বিশাল সাম্রাজ্য। ফরাসিরা আগে তাদের সাম্রাজ্যে গিয়ে যেমন কাজ করতে পারতেন, এখন আর তা সম্ভব নয়। নিজ দেশেই হচ্ছে তাদের কর্মসংস্থান। সমাজতন্ত্রী প্রেসিডেন্ট বলছেন, তিনি কর্মসংস্থান বাড়াবেন আর এর জন্য বাড়াবেন সরকারি পূর্তকাজের পরিমাণ। কিন্তু সরকারি পূর্তকাজ বাড়ানো আর একটা দেশের পণ্য উৎপাদন বাড়া সমার্থক নয়। পণ্য উৎপাদন যদি না বাড়ে, কিন্তু যদি অর্থের জোগান বেড়ে যায়, তবে পণ্য কেনার মতা কমতে থাকে। কারণ অর্থের সরবরাহ বাড়ানোর অর্থ দাঁড়ায় পণ্যের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায়। চাহিদা অনুসারে পণ্যের সরবরাহ না বাড়লে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় অনিবার্য হয়ে ওঠে। আর সাধারণ মানুষ পারে না দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে পণ্য কিনতে। তাকে পড়তে হয় অর্থনৈতিক দুরবস্থারই মধ্যে। অর্থের সরবরাহ বাড়িয়ে তাই সম্ভব হয় না দারিদ্র্য বিমোচন করা। ফ্রান্স আমাদের মতো দরিদ্র দেশ নয়। কিন্তু তবু ফ্রান্সের আছে অর্থনৈতিক সমস্যা। আর ফরাসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য আনতে পারবেন মানুষের মনে এই আশা জাগিয়ে। কিন্তু বাস্তবে তিনি কতটা সফল হবেন তা আমাদের পে আন্দাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। হয়তো দেখা যাবে বর্তমান প্রেসিডেন্ট সমস্যার সমাধান করতে না পেরে জড়িয়ে পড়ছেন অধিক সঙ্কটে।
আমি একসময় ফরাসি দেশে ছাত্র ছিলাম। ফরাসি দেশ আমার কাছে মনে হয়েছে অনেক স্বচ্ছ। যদিও সেখানে দরিদ্র ছিল। আর এখনো আছে। পৃথিবীর কোনো দেশই দরিদ্রমুক্ত নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শতকরা ১৩ ভাগ লোক এখন বাস করেন দারিদ্র্যসীমার নিচে। ফরাসি দেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে কতভাগ মানুষ বাস করেন তার পরিসংখ্যান আমার জানা নেই। তবে ফরাসি দেশে একধরনের মানুষ আছে, যারা পথে-ঘাটে ভিা করেবৃত্তি। এদের বলা হয় কশা। ফরাসি সমাজে কশার উদ্ভব হয় কেন, তা বলা যায় না। এরা কোনো কাজ করে না। নেশা করে, শুয়ে থাকে রাস্তায়। এদের দেখে প্রথমে মনে হতে পারে ফরাসি দেশ বুঝি খুবই গরিব। কিন্তু আসলে তা নয়। ফরাসি দেশে অর্থনীতিতে আছে কৃষি ও শিল্পের মধ্যে বিশেষ ভারসাম্য। অনেক উন্নত দেশের েেত্র যেটা নেই। ফরাসি গ্রাম্য জীবন আমার কাছে বিশেষ ভালো লেগেছে। আমার মনে জেগে আছে তার স্মৃতি। ফ্রান্সে এখন সৃষ্টি হয়েছে একটি বিশেষ সমস্যা, যা আমি যখন ফ্রান্সে ছিলাম তখন ছিল না। ফ্রান্সে আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া ও মরক্কো থেকে অনেক মুসলমান উপনিবেষ্টিত হয়েছেন। যাদের সন্তান সন্ততির মিলিত সংখ্যা এখন হয়ে উঠেছে প্রায় ৫০ লাখের কাছাকাছি। এদের নিয়ে বিশেষ সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে ফ্রান্সে। এরা এক দিকে বিদেশী অন্য দিকে এদের ধর্মবিশ্বাস ফরাসিদের থেকে অনেক ভিন্ন। এদের সাথে তাই ফরাসিদের সৃষ্টি হতে পারছে সমাজ বিজ্ঞানের পরিভাষায় যাকে বলে সংস্কৃতির সঙ্ঘাত। জাতিসত্তার দিক থেকেও এসব উপনিবিষ্টরা হয়ে উঠতে পারছেন না ফরাসি। এদের পূর্বপুরুষ ফ্রান্সে গিয়েছিলেন উন্নত জীবনযাত্রার খোঁজে। কিন্তু তাদের সেই ঈপ্সিত জীবনযাত্রার মান কোনোভাবেই অর্জিত হতে পারেনি। আমার মনে হয় ফরাসি দেশে এদের উপনিবিষ্ট হওয়াটা যুক্তিযুক্ত হয়নি। আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া ও মরক্কোতে রয়েছে যথেষ্ট প্রাকৃতিক সম্পদ। এসব দেশের মানুষের উচিত নিজের দেশে থেকে সুখী হওয়ার চেষ্টা করা। নিজের দেশের অর্থনীতি বিকাশে আত্মনিয়োগ করা। ফ্রান্সে গিয়ে ভাগ্য উন্নয়নের চেষ্টা করা নয়। মরক্কো ছিল ফরাসি প্রটেক্টরে। তিউনিসিয়াও ছিল ফরাসি প্রটেক্টরে। আলজেরিয়া সরাসরি ছিল ফরাসি শাসনের অধীন। আলজেরিয়াতে গিয়ে বহু ফরাসি উপনিবেষ্টিত হয়েছিলেন। তাদের হাতে চলে যায় আলজেরিয়া সমুদ্র উপকূলবর্তী উর্বর ভূমির এক-তৃতীয়াংশ। আলজেরীয় আরবরা চেয়েছেন ফরাসি শাসনের অবসান। ফরাসি দেশের সাথে আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া ও মরক্কোর মানুষের মিলমিশ হয়নি। ফ্রান্স থেকে তাই ফরাসিরা এখন চাচ্ছেন ফ্রান্সে উপনিবিষ্ট হওয়া মরক্কো, আলজেরীয় ও তিউনিসিয়ানদের বহিষ্কার। ফ্রান্সে মুসলমান মেয়েদের হিজাব পরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এটা না করলেও হয়তো চলত। আমি যখন ফ্রান্সে ছিলাম তখন হিজাব কোনো সমস্যা ছিল না। মরক্কো, আলজেরীয় ও তিউনিসিয়া থেকে যাওয়া মেয়েদের দেখেছি ফরাসি মেয়েদের মতোই পোশাক পরতে। তাদের কাউকে হিজাব পরতে দেখিনি। কিন্তু এখন ফ্রান্সে যে কারণেই হোক হিজাব পরতে চাচ্ছিলেন কিছু মুসলিম মহিলা। ফ্রান্সে এটা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে রাষ্ট্রিক আইন করে। যে রকম আইন ইতঃপূর্বে ফরাসি দেশে করার কোনো প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়নি। আমি ছাত্র থাকাকালীন ফরাসি পুলিশ এক দিন আমাকে ঘিরে ধরেছিল আলজেরীয় মুক্তি সংস্থার সাথে যুক্ত মানুষ হিসেবে। কিন্তু তারা আমার পাসপোর্ট দেখে ছেড়ে দেয়। নিয়ে যায় না কারাগারে। সেটা ১৯৬২ সালের প্রথম দিকের কথা। ফ্রান্সের নতুন প্রেসিডেন্ট উপনিবিষ্ট বিদেশীদের সম্পর্কে কী নীতি গ্রহণ করবেন তা আমরা জানি না। কিন্তু তাকে সম্মুখীন হতে হবে এই জটিল সমস্যারও। ফ্রান্স পাঁচটি বৃহৎ শক্তির মধ্যে একটি। জাতিসঙ্ঘে রয়েছে তার ভেটো প্রদানের মতা। তার হাতে রয়েছে পরমাণবিক অস্ত্র। ফ্রান্স আগের মতো শক্তির অধিকারী না হলেও এখনো বিশ্বরাজনীতিতে পালন করছে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। ফ্রান্স ন্যাটো জোটের মধ্যে আছে। ন্যাটো জোটের সাথে আফগানিস্তানে এসেছে ফরাসি সৈন্য। ইরান নিয়ে কোনো সঙ্ঘাত সৃষ্টি হলে ফ্রান্স তাতে জড়িয়ে পড়তে পারে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ফ্রান্স কী ভূমিকা পালন করবে তা-ও হয়ে থাকছে প্রশ্নসাপে। এ েেত্র ফরাসি প্রেসিডেন্টকে নিতে হবে অনেক কঠিন সিদ্ধান্ত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্দেশে ফ্রান্স কি জড়াবে কোনো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে?
ফ্রান্সে এখন কোনো সংসদীয় গণতন্ত্র নেই। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের মতো শক্তিধর নন। ফ্রান্সে প্রধানমন্ত্রী আছেন। প্রধানমন্ত্রীর থাকে মন্ত্রিপরিষদ। ফ্রান্সে প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টের মধ্যে মতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। ফ্রান্সে রাষ্ট্রব্যবস্থায় এটা হয়ে আছে একটা সমস্যা। একা প্রেসিডেন্ট ফ্রান্সে ইচ্ছামতো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। ফ্রান্সে কার্যত এখন রয়েছে দ্বৈত শাসনব্যবস্থা। এর উদ্ভব হতে পেরেছে ১৯৫৮ সালের পর থেকে। ১৯৫৮ সালের পর সার্ল দ্য গোল-এর মতায় আসার পর থেকে। তিনি প্রবর্তন করে গেছেন এই দ্বৈত শাসনব্যবস্থা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে তৃতীয় ফরাসি রিপাবলিকে ৭০ বছরের মধ্যে সরকার পতন ঘটেছে ১০৬ বার। অর্থাৎ প্রত্যেক মন্ত্রিসভার গড়পড়তায় স্থিতি হয়েছে আট মাস। তার বেশি নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রতিষ্ঠা হয় চতুর্থ ফরাসি রিপাবলিক। ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৫৮ সালের মধ্যে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছে ২০টি। দ্য গোল এসে এই ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটান এবং প্রবর্তন করেন বর্তমান ফরাসি সংবিধানের। বর্তমান ফরাসি সংবিধানে অবশ্য ঘটানো হয়েছে দ্য গোল প্রবর্তিত সংবিধানের কিছু ধারার পরিবর্তন। যেমনÑ দ্য গোল রচিত সংবিধানে ফরাসি প্রেসিডেন্ট হতে পারতেন সাত বছরের জন্য নির্বাচিত। কিন্তু এখন ফরাসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন পাঁচ বছরের জন্য। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইচ্ছা করলে পারেন না ফরাসি প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করতে। ফরাসি দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যে ভোট হয়ে গেল, তাতে ভোটের ব্যবধানকে খুব বড় বলা যায় না। পরাজিত প্রেসিডেন্ট পেয়েছেন শতকরা ৪৮ ভাগ ভোট। অন্য দিকে ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদে পেয়েছেন শতকরা ৫২ ভাগ ভোট। ভোটের এই ব্যবধানকে বাস্তব েেত্র খুব বড় ব্যবধান বলা যায় না। ফ্রান্সে তাই থাকছে বিরাট দণিপন্থী মতামতেরও প্রাধান্য। ফ্রান্স বামপন্থার দিকে ঢুকে পড়েছে ঠিক এ রকম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা মোটেও যুক্তিযুক্ত নয়।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট
ফরাসি দেশে নির্বাচন হয়ে গেল। নির্বাচনে হেরে গেলেন মধ্য ডানপন্থী হিসেবে পরিচিত নিকোলাস সারকোজি। প্রেসিডেন্ট থাকাবস্থায় নিকোলাস সারকোজি পরাজিত হন। ইতঃপূর্বে কোনো ফরাসি প্রেসিডেন্টকে এভাবে পরাজিত হতে হয়নি। ফরাসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন ফরাসি সমাজতন্ত্রী দলের প্রার্থী ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদে। ফরাসি দেশে দীর্ঘ দিন ধরে কোনো সমাজতন্ত্রী প্রেসিডেন্ট হননি। এর আগে সমাজতন্ত্রী প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন ফ্রাঁসোয়া মিত্রঁ। তিনি প্রেসিডেন্ট ছিলেন ১৯৮১ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত। মিত্রঁ সমাজতন্ত্রী হয়েও ফরাসি দেশে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির প্রবর্তন চাননি। বর্তমান সমাজতন্ত্রী প্রেসিডেন্টও যে চাইবেন তা মনে করার কোনো কারণ নেই। তিনি হয়তো জনকল্যাণে বরাদ্দ করবেন আরো কিছু বেশি অর্থ। যার ফলে ফরাসি দেশে বাড়বে জনকল্যাণের মাত্রা। ফরাসি সমাজতন্ত্রীরা ইউরোপের অন্যান্য দেশের সমাজতন্ত্রীদের মতো অনুসরণ করতে চাচ্ছেন কল্যাণব্রতী রাষ্ট্রের ধারণা। সাবেক সমাজতন্ত্রী ধ্যানধারণাকে তারা এখন আর আঁকড়ে ধরে রাখার পে নন। তারা কার্যত হয়ে উঠেছেন রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত মিশ্র অর্থনীতির প।ে তাদের আর বলা যায় না ঠিক সমাজতান্ত্রিক দর্শনের অনুসারী হিসেবে। ফরাসি সমাজ দার্শনিক ও রাজনীতিবিদ লিওঁ বুর্জোয়া (১৮৫১-১৯২৫) প্রচার করেন তার সমাজতান্ত্রিক দর্শন (Solidarism)। তিনি বলেন, সমাজে যারা অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জন করেন, তারা যে সেটা করতে পারেন কেবলই নিজের যোগ্যতার জন্য, তা নয়। সামাজিক পরিস্থিতি তাদের এই সাফল্য অর্জনে সুযোগ দেয়। এবং এনে দেয় তাদের সাফল্য। সুতরাং সম্পদে কেবল তাদের অধিকার থাকতে পারে না। সম্পদে তাদেরও অধিকার আছে, যারা অন্যকে সম্পদ অর্জনে সাহায্য করছে। আদর্শ সমাজে তাই সম্পদের বণ্টন হতে হবে এমনভাবে যে, যারা সম্পদ অর্জনে সহায়তা করছেন, তাদেরও অর্জিত সম্পদের ওপর থাকতে হবে কিছু অধিকার। অর্থনীতিকে হতে হবে সামাজিক, যাতে হতে পারে সমাজের সবারই কল্যাণ। বুর্জোয়া বলেন, এর জন্য বড়লোকদের আয়ের ওপর বসাতে হবে কর। আর এই করের টাকা দিয়ে সাহায্য করতে হবে গরিব জনসমষ্টিকে। তাদের থাকতে হবে জীবনযাত্রার ন্যূনতম মান, খেয়ে পরে বাঁচার অধিকার। শিাব্যবস্থা হতে হবে অবৈতনিক এবং সবার জন্য উন্মুক্ত। সবার জন্য থাকতে হবে দুর্ঘটনা-বীমা। শ্রমিকদের থাকতে হবে ন্যূনতম মজুরির বিধান। থাকতে হবে শ্রমসময়ের বিধান। সরকারকে নির্মাণ করতে হবে বাড়িঘর, যা মানুষ কিনতে পারবে সহজেই। থাকতে হবে বিনামূল্যে চিকিৎসার বিধান। এসব করতে পারলে সমাজসঙ্গতি বাড়বে। আর সমাজসঙ্গতি বাড়লে ঘটবে সামগ্রিকভাবে সমাজের উন্নতি। মোটামুটিভাবে ফরাসি সমাজতন্ত্রীর ধারণা, সমাজসঙ্গতি বাড়ানোর দর্শনের ধারণা এখন হয়ে উঠছে প্রায় একই রকম। সমাজতন্ত্রীরা এখন মনে করেন না যে, সমাজের অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য উৎপাদনের উপায় (means of production) রাষ্ট্রায়ত্ত করতেই হবে। তারা এখন বলেন না, কলকারখানা জমিজমা আর এক কথায় প্রাকৃতিক সম্পদ হতে হবে রাষ্ট্রিক। ব্যক্তিগত মালিকানা বলে থাকবে না আর কিছু। রাষ্ট্র পরিচালনা করবে একটা দেশের সমগ্র অর্থনীতিকে। সমাজতন্ত্র আর রাষ্ট্রতন্ত্র এখন আর একত্র করে দেখছেন না সমাজতন্ত্রীরা। তারা চাচ্ছেন উৎপাদিত সম্পদের সামাজিক সুবণ্টন। আর এক কথায় সামাজিক অর্থনীতি গড়ে তোলাকে। তারা মনে করছেন, তাদের আদর্শ হিসেবে ফ্রান্সে এক সময় কমিউনিস্টরা খুব শক্তিশালী হয়ে উঠেছেন। কিন্তু এখন তারা হয়ে পড়েছেন মতাশূন্য। কারণ ফ্রান্সের মানুষ গণতন্ত্র চায়। চায় না কোনো দলের একক শাসন। সমাজতন্ত্রী এবং কমিউনিস্টদের মধ্যে একটি বড় পার্থক্য হলো, সমাজতন্ত্রীরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন কিন্তু কমিউনিস্টরা তা করেন না। ফলে ফ্রান্সে তাদের প্রভাব এখন বিশেষভাবেই কমে গিয়েছে। ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদে তার নির্বাচনী প্রচারের সময় বলেন, তিনি বড়লোকদের ওপর কর বাড়াবেন। আর এই করের টাকায় গরিব জনসমষ্টির জীবনযত্রার মান বাড়াতে বিনিয়োগ করবেন। কিন্তু এ েেত্র উঠছে প্রশ্ন। তিনি বড়লোকদের ওপর কতটা কর আরোপ করবেন, আর সেই করের অর্থ কিভাবে ব্যয়িত হবে দরিদ্র জনসাধারণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে। এ েেত্র করের অর্থ অপচয় হওয়ার সম্ভাবনা থাকছে। এ প্রসঙ্গে ফরাসি কর-ব্যবস্থা নিয়ে কিছু কথা বলা যেতে পারে। ফরাসি কর-ব্যবস্থা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, সুইডেন, ডেনমার্ক ও নরওয়ের মতো নয়। এসব দেশে আয়করের মাত্রা হলো বেশি। এসব দেশে কর প্রধানত আরোপ করা হয় মানুষের আয়ের ওপর। এসব দেশে আয়কর ধরা হয় প্রগতিশীলভাবে। প্রগতিশীল বলতে বোঝায় আয় বাড়ানোর সাথে সাথে অধিক হারে কর দেয়ার বিধিকে। কিন্তু ফরাসি দেশে আয়ের ওপর করের মাত্রা ধার্য হয় কম। কর প্রধানত হলো পরো। করের বোঝা শেষ পর্যন্ত তাই গিয়ে পড়ে আয়ের ওপর নয়, খরচের ওপর। ফরাসি কর-ব্যবস্থায় প্রত্য করের চেয়ে পরো করের মাত্রা বেশি। পরো করের একটা বিশেষ দৃষ্টান্ত হলো বিক্রয় কর (Sale tax), যা আসলে হলো ক্রয় কর (Purchase tax)। ফরাসি দেশে তাই কর বাড়ানোর মাত্রা দাঁড়ায় বড়লোকের চেয়ে তুলনামূলক গরিব জনসাধারণের ওপর বেশি। এ ছাড়া বাড়ে ঘাটতি ব্যয়ের পরিমাণ। যা বাড়ায় মুদ্রাস্ফীতি (Currency inflation)। ফরাসি মুদ্রার ক্রয়মতা স্থিতিশীল রাখা হয়ে ওঠে খুবই কষ্টকর। ফরাসির বর্তমান সমাজতন্ত্রী প্রেসিডেন্ট তাই বড়লোকের ওপর কর বসিয়ে তুলনামূলক দরিদ্র জনসমষ্টির জীবনযাত্রার মান কিভাবে উন্নত করতে পারবেন তা নিয়ে থাকছে সংশয়। ফ্রান্স এখন ইউরো মুদ্রার অংশীদার। সে তার নিজের মুদ্রাব্যবস্থার ওপর আর আগের মতো নিয়ন্ত্রণ রাখে না। এ েেত্রও থাকছে মুদ্রা নিয়ন্ত্রণে সমস্যা। ফ্রান্সে এখন বেকার সমস্যা আগের তুলনায় বেড়েছে। ফ্রান্সের নেই আগের মতো বিশাল সাম্রাজ্য। ফরাসিরা আগে তাদের সাম্রাজ্যে গিয়ে যেমন কাজ করতে পারতেন, এখন আর তা সম্ভব নয়। নিজ দেশেই হচ্ছে তাদের কর্মসংস্থান। সমাজতন্ত্রী প্রেসিডেন্ট বলছেন, তিনি কর্মসংস্থান বাড়াবেন আর এর জন্য বাড়াবেন সরকারি পূর্তকাজের পরিমাণ। কিন্তু সরকারি পূর্তকাজ বাড়ানো আর একটা দেশের পণ্য উৎপাদন বাড়া সমার্থক নয়। পণ্য উৎপাদন যদি না বাড়ে, কিন্তু যদি অর্থের জোগান বেড়ে যায়, তবে পণ্য কেনার মতা কমতে থাকে। কারণ অর্থের সরবরাহ বাড়ানোর অর্থ দাঁড়ায় পণ্যের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায়। চাহিদা অনুসারে পণ্যের সরবরাহ না বাড়লে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় অনিবার্য হয়ে ওঠে। আর সাধারণ মানুষ পারে না দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে পণ্য কিনতে। তাকে পড়তে হয় অর্থনৈতিক দুরবস্থারই মধ্যে। অর্থের সরবরাহ বাড়িয়ে তাই সম্ভব হয় না দারিদ্র্য বিমোচন করা। ফ্রান্স আমাদের মতো দরিদ্র দেশ নয়। কিন্তু তবু ফ্রান্সের আছে অর্থনৈতিক সমস্যা। আর ফরাসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য আনতে পারবেন মানুষের মনে এই আশা জাগিয়ে। কিন্তু বাস্তবে তিনি কতটা সফল হবেন তা আমাদের পে আন্দাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। হয়তো দেখা যাবে বর্তমান প্রেসিডেন্ট সমস্যার সমাধান করতে না পেরে জড়িয়ে পড়ছেন অধিক সঙ্কটে।
আমি একসময় ফরাসি দেশে ছাত্র ছিলাম। ফরাসি দেশ আমার কাছে মনে হয়েছে অনেক স্বচ্ছ। যদিও সেখানে দরিদ্র ছিল। আর এখনো আছে। পৃথিবীর কোনো দেশই দরিদ্রমুক্ত নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শতকরা ১৩ ভাগ লোক এখন বাস করেন দারিদ্র্যসীমার নিচে। ফরাসি দেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে কতভাগ মানুষ বাস করেন তার পরিসংখ্যান আমার জানা নেই। তবে ফরাসি দেশে একধরনের মানুষ আছে, যারা পথে-ঘাটে ভিা করেবৃত্তি। এদের বলা হয় কশা। ফরাসি সমাজে কশার উদ্ভব হয় কেন, তা বলা যায় না। এরা কোনো কাজ করে না। নেশা করে, শুয়ে থাকে রাস্তায়। এদের দেখে প্রথমে মনে হতে পারে ফরাসি দেশ বুঝি খুবই গরিব। কিন্তু আসলে তা নয়। ফরাসি দেশে অর্থনীতিতে আছে কৃষি ও শিল্পের মধ্যে বিশেষ ভারসাম্য। অনেক উন্নত দেশের েেত্র যেটা নেই। ফরাসি গ্রাম্য জীবন আমার কাছে বিশেষ ভালো লেগেছে। আমার মনে জেগে আছে তার স্মৃতি। ফ্রান্সে এখন সৃষ্টি হয়েছে একটি বিশেষ সমস্যা, যা আমি যখন ফ্রান্সে ছিলাম তখন ছিল না। ফ্রান্সে আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া ও মরক্কো থেকে অনেক মুসলমান উপনিবেষ্টিত হয়েছেন। যাদের সন্তান সন্ততির মিলিত সংখ্যা এখন হয়ে উঠেছে প্রায় ৫০ লাখের কাছাকাছি। এদের নিয়ে বিশেষ সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে ফ্রান্সে। এরা এক দিকে বিদেশী অন্য দিকে এদের ধর্মবিশ্বাস ফরাসিদের থেকে অনেক ভিন্ন। এদের সাথে তাই ফরাসিদের সৃষ্টি হতে পারছে সমাজ বিজ্ঞানের পরিভাষায় যাকে বলে সংস্কৃতির সঙ্ঘাত। জাতিসত্তার দিক থেকেও এসব উপনিবিষ্টরা হয়ে উঠতে পারছেন না ফরাসি। এদের পূর্বপুরুষ ফ্রান্সে গিয়েছিলেন উন্নত জীবনযাত্রার খোঁজে। কিন্তু তাদের সেই ঈপ্সিত জীবনযাত্রার মান কোনোভাবেই অর্জিত হতে পারেনি। আমার মনে হয় ফরাসি দেশে এদের উপনিবিষ্ট হওয়াটা যুক্তিযুক্ত হয়নি। আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া ও মরক্কোতে রয়েছে যথেষ্ট প্রাকৃতিক সম্পদ। এসব দেশের মানুষের উচিত নিজের দেশে থেকে সুখী হওয়ার চেষ্টা করা। নিজের দেশের অর্থনীতি বিকাশে আত্মনিয়োগ করা। ফ্রান্সে গিয়ে ভাগ্য উন্নয়নের চেষ্টা করা নয়। মরক্কো ছিল ফরাসি প্রটেক্টরে। তিউনিসিয়াও ছিল ফরাসি প্রটেক্টরে। আলজেরিয়া সরাসরি ছিল ফরাসি শাসনের অধীন। আলজেরিয়াতে গিয়ে বহু ফরাসি উপনিবেষ্টিত হয়েছিলেন। তাদের হাতে চলে যায় আলজেরিয়া সমুদ্র উপকূলবর্তী উর্বর ভূমির এক-তৃতীয়াংশ। আলজেরীয় আরবরা চেয়েছেন ফরাসি শাসনের অবসান। ফরাসি দেশের সাথে আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া ও মরক্কোর মানুষের মিলমিশ হয়নি। ফ্রান্স থেকে তাই ফরাসিরা এখন চাচ্ছেন ফ্রান্সে উপনিবিষ্ট হওয়া মরক্কো, আলজেরীয় ও তিউনিসিয়ানদের বহিষ্কার। ফ্রান্সে মুসলমান মেয়েদের হিজাব পরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এটা না করলেও হয়তো চলত। আমি যখন ফ্রান্সে ছিলাম তখন হিজাব কোনো সমস্যা ছিল না। মরক্কো, আলজেরীয় ও তিউনিসিয়া থেকে যাওয়া মেয়েদের দেখেছি ফরাসি মেয়েদের মতোই পোশাক পরতে। তাদের কাউকে হিজাব পরতে দেখিনি। কিন্তু এখন ফ্রান্সে যে কারণেই হোক হিজাব পরতে চাচ্ছিলেন কিছু মুসলিম মহিলা। ফ্রান্সে এটা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে রাষ্ট্রিক আইন করে। যে রকম আইন ইতঃপূর্বে ফরাসি দেশে করার কোনো প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়নি। আমি ছাত্র থাকাকালীন ফরাসি পুলিশ এক দিন আমাকে ঘিরে ধরেছিল আলজেরীয় মুক্তি সংস্থার সাথে যুক্ত মানুষ হিসেবে। কিন্তু তারা আমার পাসপোর্ট দেখে ছেড়ে দেয়। নিয়ে যায় না কারাগারে। সেটা ১৯৬২ সালের প্রথম দিকের কথা। ফ্রান্সের নতুন প্রেসিডেন্ট উপনিবিষ্ট বিদেশীদের সম্পর্কে কী নীতি গ্রহণ করবেন তা আমরা জানি না। কিন্তু তাকে সম্মুখীন হতে হবে এই জটিল সমস্যারও। ফ্রান্স পাঁচটি বৃহৎ শক্তির মধ্যে একটি। জাতিসঙ্ঘে রয়েছে তার ভেটো প্রদানের মতা। তার হাতে রয়েছে পরমাণবিক অস্ত্র। ফ্রান্স আগের মতো শক্তির অধিকারী না হলেও এখনো বিশ্বরাজনীতিতে পালন করছে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। ফ্রান্স ন্যাটো জোটের মধ্যে আছে। ন্যাটো জোটের সাথে আফগানিস্তানে এসেছে ফরাসি সৈন্য। ইরান নিয়ে কোনো সঙ্ঘাত সৃষ্টি হলে ফ্রান্স তাতে জড়িয়ে পড়তে পারে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ফ্রান্স কী ভূমিকা পালন করবে তা-ও হয়ে থাকছে প্রশ্নসাপে। এ েেত্র ফরাসি প্রেসিডেন্টকে নিতে হবে অনেক কঠিন সিদ্ধান্ত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্দেশে ফ্রান্স কি জড়াবে কোনো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে?
ফ্রান্সে এখন কোনো সংসদীয় গণতন্ত্র নেই। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের মতো শক্তিধর নন। ফ্রান্সে প্রধানমন্ত্রী আছেন। প্রধানমন্ত্রীর থাকে মন্ত্রিপরিষদ। ফ্রান্সে প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টের মধ্যে মতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। ফ্রান্সে রাষ্ট্রব্যবস্থায় এটা হয়ে আছে একটা সমস্যা। একা প্রেসিডেন্ট ফ্রান্সে ইচ্ছামতো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। ফ্রান্সে কার্যত এখন রয়েছে দ্বৈত শাসনব্যবস্থা। এর উদ্ভব হতে পেরেছে ১৯৫৮ সালের পর থেকে। ১৯৫৮ সালের পর সার্ল দ্য গোল-এর মতায় আসার পর থেকে। তিনি প্রবর্তন করে গেছেন এই দ্বৈত শাসনব্যবস্থা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে তৃতীয় ফরাসি রিপাবলিকে ৭০ বছরের মধ্যে সরকার পতন ঘটেছে ১০৬ বার। অর্থাৎ প্রত্যেক মন্ত্রিসভার গড়পড়তায় স্থিতি হয়েছে আট মাস। তার বেশি নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রতিষ্ঠা হয় চতুর্থ ফরাসি রিপাবলিক। ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৫৮ সালের মধ্যে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছে ২০টি। দ্য গোল এসে এই ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটান এবং প্রবর্তন করেন বর্তমান ফরাসি সংবিধানের। বর্তমান ফরাসি সংবিধানে অবশ্য ঘটানো হয়েছে দ্য গোল প্রবর্তিত সংবিধানের কিছু ধারার পরিবর্তন। যেমনÑ দ্য গোল রচিত সংবিধানে ফরাসি প্রেসিডেন্ট হতে পারতেন সাত বছরের জন্য নির্বাচিত। কিন্তু এখন ফরাসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন পাঁচ বছরের জন্য। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইচ্ছা করলে পারেন না ফরাসি প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করতে। ফরাসি দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যে ভোট হয়ে গেল, তাতে ভোটের ব্যবধানকে খুব বড় বলা যায় না। পরাজিত প্রেসিডেন্ট পেয়েছেন শতকরা ৪৮ ভাগ ভোট। অন্য দিকে ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদে পেয়েছেন শতকরা ৫২ ভাগ ভোট। ভোটের এই ব্যবধানকে বাস্তব েেত্র খুব বড় ব্যবধান বলা যায় না। ফ্রান্সে তাই থাকছে বিরাট দণিপন্থী মতামতেরও প্রাধান্য। ফ্রান্স বামপন্থার দিকে ঢুকে পড়েছে ঠিক এ রকম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা মোটেও যুক্তিযুক্ত নয়।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন