রবিবার, ১৩ মে, ২০১২

বাংলাদেশে মে দিবস

বাংলাদেশে মে দিবস


আত্মপক্ষ

॥ এবনে গোলাম সামাদ ॥

শ্র মিকেরা অনেক দেশেই তাদের কাজের পরিবেশ, প্রতিদিন কাজের সময়ের পরিমাণ এবং মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন করেছেন এবং এখনো করছেন। এসব আন্দোলনের ফলে ঘটতে পেরেছে তাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন। সৃষ্টি হতে পেরেছে মালিক প ও শ্রমিক পরে মধ্যে সম্পর্কের মসৃণতা, যা আগে ছিল না। শ্রমিকরা এখন উপলব্ধি করতে পারছেন, ইচ্ছামতো ধর্মঘট করে মজুরি বৃদ্ধি করে চলা সম্ভব নয়। কারণ মজুরি বৃদ্ধি করতে হলে বাড়ে উৎপাদিত পণ্যের দর। উৎপাদিত পণ্যের দর বাড়লে ক্রেতার পে তা কেনা হয়ে দাঁড়ায় কঠিন। ক্রেতার অভাবে বাজারে পণ্য পড়ে থাকে অবিক্রীত। তখন এর জন্য শেষ পর্যন্ত কলকারখানায় উৎপাদন থেমে যায়। কলকারখানা বন্ধ হলে শ্রমিকেরা হয়ে পড়তে থাকেন বেকার। বন্ধ হয়ে যায় তাদের জীবিকার উপায়। আমার বাড়ির সামনে দিয়ে মে দিবসের একটি মিছিল যাচ্ছিল। মিছিলকারীরা বলছিলেনÑ ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’। কিন্তু তাদের এই আওয়াজটা এখন হয়ে পড়েছে খুবই সেকেলে। আমরা চোখের ওপর দেখলাম বিরাট সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়তে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার অনেক কারণ আছে। তার মধ্যে একটি হলো জাতিসত্তার সঙ্ঘাত। রুশ শ্রমিক আর কাজাখ শ্রমিকের মধ্যে ঐক্য ঘটা সম্ভব হলো না। ঐক্য ঘটা সম্ভব হলো, না সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ১৫টি রিপাবলিকের শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে। দুনিয়ার মজদুর এক হও, এই আওয়াজ এখন তাই মনে হচ্ছে অন্তঃসারশূন্য। মানুষ পৃথিবীতে বাস করছে কেবল শ্রমজীবী হিসেবে নয়। বাস করছে বিভিন্ন জাতিরাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে; যা বিশ্বরাজনীতিকে করছে নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু আমাদের দেশে বাম রাজনীতিকেরা এই সহজ বাস্তবতাকে যেন উপলব্ধি করতে অপারগ। তাই তারা তুলতে পারছেন, দুনিয়ার মজদুর এক হওÑ এই দাবি। কিন্তু বর্তমান পৃথিবীতে প্রতিটি রাষ্ট্রকে তার অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান খুঁজে পেতে হবে আপন রাষ্ট্রিক সীমানার মধ্যেই। প্রতিটি জাতির অর্থনৈতিক সমস্যা হলো তার নিজের সমস্যা। আন্তর্জাতিকভাবে এখনো এর সমাধান আসছে না। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে ১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে শিকাগো শহরের হে মার্কেট স্কয়ার নামক জায়গার কোনো কারখানায় শ্রমিকেরা ধর্মঘট করছিলেন। প্রতিদিন ৮ ঘণ্টার বেশি শ্রমিকদের কাজ করানো যাবে না, এই দাবিতে। সেই সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ছিল না শ্রমিক ইউনিয়ন গঠনের অধিকার। ছিল না শ্রমিকদের ধর্মঘট করার অধিকার। তাদের ধর্মঘট ভাঙার জন্য শিকাগো শহরের ওই কারখানার মালিক প ভাড়া করে আনে গুণ্ডা, ডাকেন পুলিশ। ধর্মঘটরত শ্রমিকদের সাথে মালিক পরে ভাড়াটিয়া গুণ্ডাদের বাঁধে মারদাঙ্গা। এ সময় কেউ ছোড়েন একটা হাতবোমা। এর বিস্ফোরণে মারা যান সাতজন পুলিশ আর আহত হন অনেকে। এ ঘটনা নিয়ে আদালতে হয় মামলা। মামলার রায়ে চারজন শ্রমিক নেতার হয় প্রাণদণ্ড। এ চারজন ছিলেন অ্যানার্কিস্ট পার্টির সদস্য; যারা মনে করতেন, বল প্রয়োগের মাধ্যমে ধনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটাতে হবে। কিন্তু পরে জানা যায়, ওই অ্যানার্কিস্ট নেতারা বোমা ছোড়ার সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না। বোমা ছুড়েছিল মালিকপরে এজেন্ট। যুক্তরাষ্ট্রে এরপর শ্রমিকেরা পান বৈধভাবে শ্রমিক ইউনিয়ন গড়ার অধিকার। পেতে পারলেন তাদের দাবিদাওয়া পূরণের জন্য ধর্মঘটের অধিকার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শ্রমিকদের প্রতিদিন ৮ ঘণ্টার বেশি কাজ করানো হয় নিষিদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্রে শ্রমিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন অ্যানার্কিস্টরা। সেখানে সমাজতান্ত্রিকেরা কখনোই শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলনে কোনো বড় রকমের ভূমিকা পালন করেননি। কিন্তু ইউরোপে গড়ে ওঠা সমাজতন্ত্রীদের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক (The Second Socialist International) থেকে ১৮৮৯ সালে পয়লা মে-কে ঘোষণা করা হয় আন্তর্জাতিক শ্রমদিবস হিসেবে। ১৮৯০ সাল থেকে পয়লা মে প্রতি বছর পালিত হচ্ছে অনেক দেশেই আন্তর্জাতিক শ্রমদিবস হিসেবে। বাংলাদেশে পয়লা মে সরকারি ছুটি। আমরা সরকারিভাবে পালন করছি মে দিবস। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো কলকারখানার অর্থনীতি সেভাবে গড়ে ওঠেনি। বাংলাদেশ হয়ে আছে মূলত ুদ্র কৃষিজীবী মানুষের দেশ। এর অর্থনৈতিক সমস্যা, কলকারখানা সমৃদ্ধ ধনতান্ত্রিক দেশ থেকে অনেক ভিন্ন। মে দিবস উদযাপন তাই এ দেশে অর্থবহ নয়।
বাংলাদেশ থেকে এখন বহু মানুষ যাচ্ছেন বিদেশে। তারা বিদেশে কাজ করছেন শ্রমজীবী হিসেবে। কিন্তু তাদের নেই কোনো শ্রমিক ইউনিয়ন গড়ার অধিকার। তাদের খাটতে হচ্ছে প্রতিদিন ৮ ঘণ্টার অনেক বেশি। কাজ করতে হচ্ছে ব্যাপক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়; অনেক েেত্র যাকে বলে, প্রাণ হাতে নিয়ে। তারা বিদেশে কাজ করে দেশে আনছেন বৈদেশিক মুদ্রা। কিন্তু তা লাগছে না এ দেশে সেভাবে পুঁজি গঠনের কাজে। এরা বিদেশে অর্জিত অর্থ দিয়ে চড়া দামে কিনছেন জমি। অনেক ুদ্র কৃষক এদের কাছে চড়া দামে জমি বিক্রি করে শেষ পর্যন্ত পরিণত হচ্ছেন তেমজুরে। এর ফলে গ্রামীণ জীবনে বাড়ছে হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যা। আমাদের জমির পরিমাণ সীমিত। ধান ও পাট একই রকম জমিতে উৎপন্ন হয়। ব্রিটিশ শাসনামলে আইন করে পাট চাষ কমানো হয়েছিল। কারণ পাট উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে ধান উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছিল জমির অভাবে। পাট চাষ এখন আর এ দেশে লাভজনক নয়। বরং লাভজনক হয়ে উঠেছে ফল চাষ। কিন্তু ফল চাষ করতে গিয়ে কমছে ধানের আবাদ। এতে বাড়ছে আমাদের খাদ্য সমস্যা। কারণ ধান এখনো আমাদের মূল খাদ্যশস্য। আমাদের কৃষিতে অন্য রকম সমস্যাও প্রবল হয়ে উঠেছে। ক’দিন আগে কথা হচ্ছিল একজন কৃষিবিদের সাথে। তিনি আমাকে বলছিলেন বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির েেত্র বৈজ্ঞানিক গবেষণার অগ্রগতির কথা। তার বক্তব্য আমার ভালো লাগছিল। বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলে কৃষি উৎপাদন বাড়ছে। কিন্তু এই কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, কৃষিতে সৃষ্টি করছে সমস্যা। কৃষিপণ্যের পড়ে যাচ্ছে বাজারদর। কৃষক হচ্ছেন তিগ্রস্ত। কৃষিপণ্যের বাজারদর ঠিক রাখা আগের চেয়ে হয়ে উঠছে অনেক বড় রকমের সমস্যা। আগে আমাদের দেশে অনেক জাতের ধান ছিল, যা অনেক কম খরচে আবাদ করা যেত। এসব ধানের ফলন ছিল কম। কিন্তু সেই সাথে উৎপাদনের খরচও ছিল অনেক কম। আমরা বর্তমানে আবাদ করছি উচ্চফলনশীল জাতের ধান। এতে আবাদের খরচা পড়ছে অনেক বেশি। লাভতির হিসাব করে দেখা যাচ্ছে অনেক েেত্রই কৃষক হচ্ছেন তিগ্রস্ত। যেমন, এখন আমাদের দেশের উত্তরাঞ্চলে এক মণ উচ্চফলনশীল ধান উৎপাদন করতে খরচ পড়ছে গড়পড়তা ৬০০ টাকার কাছাকাছি। কিন্তু হাটে বাজারে কৃষককে ধান বিক্রি করতে হচ্ছে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা মণদরে। কৃষক পারছেন না ধান উৎপাদন করে লাভবান হতে। বলা হচ্ছে, সরকারকে ধান কিনে ধানের বাজারদর ঠিক রাখতে হবে। কিন্তু সরকারের টাকা আসে ট্যাক্সের টাকা থেকে। কৃষিপণ্যে ভর্তুকি দিতে গেলে সবার ওপর বাড়বে বাড়তি করের বোঝা। আমাদের অর্থনৈতিক সমস্যা হয়ে উঠেছে খুবই জটিল। ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ বলে এই সমস্যার সমাধান আনা সম্ভব হবে না। আমার মনে পড়ে, ১৯৬০-এর দশকের কথা। এ সময় আমাদের একজন খ্যাতনামা রাজনৈতিক নেতা বলেছিলেনÑ ‘ভোটের আগে ভাত চাই’। জানি না, ‘ভোট’ ও ‘ভাত’কে এ রকম পরস্পরবিরোধী ভাবার কী যুক্তি ছিল তার।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শ্রমজীবী জনসাধারণ কোনো দিনই চাননি তাদের দেশ থেকে গণতন্ত্রের বিলুপ্তি। এটা হতে পারে আমাদের অন্যতম শিণীয় বিষয়। যুক্তরাষ্ট্রের ছিল এবং আছে বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ। যুক্তরাষ্ট্রে গ্রেট ব্রিটেন থেকে যাওয়া সাদা মানুষ ব্যবহার করেছেন ব্রিটিশ প্রযুক্তি। ফলে অর্থনীতিতে আসতে পেরেছে কলকারখানার বিপ্লব। মার্কিন অর্থনীতিতে সামান্য ব্যক্তিও অনেক সহজে হতে পেরেছেন ধনী। সে দেশে এভাবে মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের সুযোগ থাকায় শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলন সাধারণভাবে থেকেছে কম সঙ্ঘাতময় হয়ে। যুক্তরাষ্ট্রে শ্রেণী সংগ্রামের দর্শন সেভাবে পেতে পারেনি প্রাধান্য। সেখানে এখন শ্রমজীবী ও অন্যান্য পেশাজীবী মানুষের ইউনিয়নগুলো হয়ে উঠেছে খুবই শক্তিশালী। এসব ইউনিয়ন ইচ্ছা করলে পারে ধর্মঘট করে তাদের দাবি আদায়ের জন্য চাপ সৃষ্টি করতে। কিন্তু মার্কিন ইউনিয়নগুলো এ রকম কিছু করতে চান না। যুক্তরাষ্ট্রে যদি প্রেসিডেন্ট মনে করেন, শ্রমিক ও বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের সাধারণ ধর্মঘট সে দেশের অর্থনীতিকে নিয়ে যেতে পারে বিশেষ বিপর্যয়ের মধ্যে, তবে তিনি সে েেত্র আইনত পারেন ধর্মঘট স্থগিত করার আদেশ দিতে। কিন্তু এ রকম আদেশ দেয়ার প্রয়োজন এখনো পড়েনি যুক্তরাষ্ট্রে সব পেশার মানুষ ইচ্ছা করলেই পারেন ধর্মঘট করতে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারীরা কখনোই পারেন না ধর্মঘট করে দাবিদাওয়া আদায় করতে। কারণ তাদের েেত্র ধর্মঘট করা নিষিদ্ধ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শ্রমিক ও অন্যান্য পেশাজীবী মানুষের ইউনিয়নকে থাকতে হয় রাজনৈতিক দল থেকে বিযুক্ত। কোনো ইউনিয়ন পারে না কোনো রাজনৈতিক দলকে চাঁদা প্রদান করতে। পান্তরে কোনো রাজনৈতিক দল পারে না কোনো ইউনিয়নের সাথে নিজেকে যুক্ত করতে। যুক্তরাষ্ট্রে শ্রমজীবী ও পেশাজীবী মানুষের গড়া ইউনিয়নগুলো তাই থাকে রাজনৈতিক দলের প্রভাবমুক্ত হয়ে। এটাও হতে পারে আমাদের শিণীয় বিষয়। কিন্তু বাংলাদেশে মে দিবস উদযাপিত হয়েছে এবং হচ্ছে বিশেষভাবে বামপন্থী নেতাদের নেতৃত্বে। এই বাম নেতারা এখনো ভাবছেন শ্রেণিসংগ্রামের মাধ্যমে অর্থনৈতিক জীবনে বিপ্লব ঘটানোর কথা। কিন্তু তাদের এই শ্রেণী সংগ্রামের ধারণা আর আমাদের দেশের বাস্তব অর্থনৈতিক অবস্থা কোনোভাবেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়। বাম রাজনীতি বিদেশে বেশ রদ্দি হয়ে উঠেছে। কিন্তু এ রাজনীতি আমাদের দেশে আওয়ামী লীগকে এখনো করছে প্রভাবিত। এটা হয়ে উঠেছে আমাদের দেশের বর্তমান রাজনীতিতে একটা বিশেষ সমস্যা।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন