রবিবার, ২৯ এপ্রিল, ২০১২

পররাষ্ট্রনীতিতে বাংলাদেশ



২০১২-০৪-৩০

বিশ্বের কোনো দেশেরই ভবিষ্যৎ এখন আর কেবল তার নিজের দেশের ঘটনাবলির প্রবাহ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না। বিদেশের ঘটনাবলির প্রভাব এসে পড়ে তার ওপর। যুদ্ধ ভালো নয়। কিন্তু তবু এখনো যুদ্ধ হচ্ছে পৃথিবীর নানা দেশে নানা অঞ্চলে। এক দেশ আর এক দেশের সাথে জড়িয়ে পড়ছে যুদ্ধে। যুদ্ধের অবসান ঘটানোর জন্য গঠিত হয়েছিল জাতিসঙ্ঘ ১৯৪৫ সালে। কিন্তু জাতিসঙ্ঘ যুদ্ধ বন্ধ করতে পারেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাতিসঙ্ঘকে অগ্রাহ্য করেই আক্রমণ করল ইরাককে। আর ইরাকে এখনো প্রতিদিন হচ্ছে লোকয়। যুদ্ধ চলেছে আফগানিস্তানে। যুদ্ধের হুমকি দেয়া হচ্ছে ইরানকে। সব মিলিয়ে বিশ্বপরিস্থিতি হচ্ছে জটিল থেকে জটিলতর। আমরা একটা নিরাপদ বিশ্বে বাস করছি না। ধনী-দরিদ্র সব দেশেই সামরিক খাতে ব্যয় বাড়িয়ে চলেছে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কেবল তার ঘরোয়া রাজনীতি দ্বারা নিরূপিত হবে না। নিরূপিত হবে বিশ্বপরিস্থিতির ওপর, আর এই বিশ্বপরিস্থিতির বিশ্লেষণ করে গৃহীত হতে হবে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি। মনে হচ্ছে বিশ্ব পরিস্থিতি বিশ্লেষণে থাকছে আমাদের চিন্তায় যথেষ্ট ঘাটতি। আমরা বিশ্বপরিস্থিতির অনেকগুলো দিককে যেন নিতে চাচ্ছি না আমাদের বিবেচনায়। আমরা অনেক সমস্যাকে করে ফেলতে চাচ্ছি খুবই সরল। যা হয়ে উঠতে পারে আমাদের জন্য বিপজ্জনক। সম্প্রতি লন্ডনে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি বলেছেনÑ ভারত আর বাংলাদেশের ভাগ্য নাকি এক সূত্রেই গাঁথা। আর তাই তার পররাষ্ট্রনীতিও হতে হবে অভিন্ন। তিনি আরো বলেছেনÑ বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক এখন হয়ে উঠেছে খুবই ঘনিষ্ঠ। যেমন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল ১৯৭১ সালে। কিন্তু ১৯৭১ সালে কলকাতায় অবস্থিত তাজউদ্দীন সরকারের কোনো স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি ছিল না। তাকে অনুসরণ করে চলতে হচ্ছিল ভারত সরকারের নির্দেশ। তাই প্রশ্ন উঠছে বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের অবস্থা কি দাঁড়িয়েছে ১৯৭১ সালের তাজউদ্দীন সরকারেরই মতো। বাংলাদেশ সরকার না ভারত সরকার, প্রকৃত প্রস্তাবে কে নিয়ন্ত্রণ করছে এ দেশের পররাষ্ট্রনীতি?

আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লন্ডনে ভারতীয় সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেছেনÑ তিন বছরে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর মাঝারি পর্যায়ের কর্মকর্তারা নাকি ১৯ বার সেনা অভ্যুত্থানের চেষ্টা চালিয়েছেন। কিন্তু তারা সফল হতে পারেননি। বাংলাদেশ আছে সেনা অভ্যুত্থানের ঝুঁকির মধ্যে। যদি তিনি এ কথা সত্যি বলে থাকেন তবে সেটা কতটা সমীচীন হয়েছে তা নিয়ে থাকছে প্রশ্ন। বিদেশে দেশের ভেতরকার এই দুর্বলতাকে প্রকাশ করা দীপু মনির রাজনৈতিক পরিপক্বতার পরিচয় বহন করছে না। তিনি যেন চেয়েছেন ভারতের প্রিয়পাত্র হতে। যেটা এ দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য অবমাননাকর। কিন্তু দীপু এসব কথা বলে যেন চেয়েছেন তৃপ্তি পেতে। ভারত ও আমাদের স্বার্থ একসূত্রে গাঁথা নয়। চীন ও ভারতের মধ্যে বিরাজ করছে বিরাট সীমান্ত বিরোধ। বিরাজ করছে এশিয়ায় পরাশক্তি হওয়া নিয়ে প্রতিযোগিতা। কিন্তু বাংলাদেশের সাথে চীনের কোনো সীমান্ত বিরোধ নেই। আর পরাশক্তি হওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। কী করে বাংলাদেশ ও ভারতের স্বার্থ অভিন্ন হতে পারছে সেটা আমাদের কাছে মোটেও তাই স্বচ্ছ হতে পারছে না। আর স্পষ্ট হতে পারছে না বর্তমান বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক অনুসৃত পররাষ্ট্রনীতি। আওয়ামী লীগ দাবি করছে যে, সে অনুসরণ করে চলেছে শেখ মুজিবের অনুসৃত পররাষ্ট্রনীতি। কিন্তু শেখ মুজিব ঠিক কী চেয়েছিলেন সেটাও আমাদের কাছে এখনো হয়ে আছে যথেষ্ট বিভ্রান্তিকর। ১৯৭১ সালে শেখ মুজিব ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে। এ সময় তিনি কী ভেবেছিলেন তা আমরা জানি না। শেখ মুজিব পাকিস্তানের কারাগার থেকে ছাড়া পান ১৯৭২ সালের ৩ জানুয়ারি। এরপর তিনি ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের বিশেষ বিমানে করে যান লন্ডনে। সেখানে তিনি তদানীন্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হিথের সাথে আলোচনা করেন। তিনি কেন পাকিস্তান থেকে লন্ডনে যাওয়ার ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলোচনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন সে সম্পর্কে এখনো কিছু জানা যায় না।

আমি এ সময় ছিলাম কলকাতায়। কলকাতায় গুজব রটেছিল, শেখ মুজিব নাকি জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাথে একটি বিশেষ চুক্তি করেছিলেন। যাতে বাংলাদেশ ও বর্তমান পাকিস্তান হতে যাচ্ছে একটা কনফেডারেশন বা রাষ্ট্র সমবায়। এ কথা কত দূর সত্য তা আমরা বলতে পারি না। কিন্তু ভারতীয় বুদ্ধিজীবী মহলে এ নিয়ে সৃষ্টি হয়েছিল যথেষ্ট উদ্বেগ। শেখ মুজিব বাংলাদেশে ফিরে ১২ জানুয়ারি (১৯৭২) বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করেন। প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করার পর তিনি যোগ দেন ইসলামি সম্মেলন সংস্থায়। এ উপলে তিনি যান পাকিস্তানে। তিনি মতায় আসার পর কার্যত চাননি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। বাংলাদেশে যারা পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিল অথবা চাননি সাবেক পাকিস্তান ভেঙে যাক, তিনি চাননি তাদের বিচার করতে। কার্যত তিনি এ েেত্র প্রদর্শন করেছিলেন সাধারণ মার মনোভাব। ১৯৭৪ সালে তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টোকে বাংলাদেশ সফর করার জন্য আমন্ত্রণ জানান। ভুট্টো তার আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে আসেন বাংলাদেশে। এ থেকে মনে করা যায় যে, শেখ মুজিব চেয়েছিলেন, পাকিস্তানের সাথে বিশেষ মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ হতে। যদিও তিনি ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণে জুলফিকার আলী ভুট্টো সম্পর্কে করেছিলেন বিরূপ মন্তব্য। বর্তমান আওয়ামী লীগ চাচ্ছে না পাকিস্তানের সাথে কোনো প্রকার সুসম্পর্ক গড়তে। বরং চাচ্ছে পাকিস্তানবিরোধী কথা বলে এ দেশের মানুষের কাছে জনপ্রিয় হতে। কিন্তু ১৯৭১ সালের পরিস্থিতি আর বর্তমান পরিস্থিতি এক নয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষ ভারতকে যতটা বন্ধু ভেবেছে, এখন আর তা ভাবতে পারছে না। কিন্তু এই সহজ সত্যটাকে যেন আওয়ামী লীগের নেতারা উপলব্ধি করতে পারছেন না। আর তাই হয়ে পড়ছেন গণবিচ্ছিন্ন।

আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি পরম রবীন্দ্রভক্ত। গোটা আওয়ামী লীগ এখন রবীন্দ্রনাথের মধ্যে খুঁজে পেতে চাচ্ছে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বুনিয়াদ। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আর যা-ই হোন বাঙালি জাতীয়তাবাদী ছিলেন না। তিনি চাননি বাংলা ভাষাভিত্তিক কোনো পৃথক স্বাধীন দেশ গড়তে। তিনি আস্থাশীল ছিলেন অখণ্ড ভারতে। আর চেয়েছিলেন বাংলা বা অন্য কোনো ভাষা নয়, হিন্দি হতে হবে ভারতের একমাত্র রাষ্ট্র অথবা যোগাযোগ রার ভাষা। শেখ মুজিব ঠিক এ রকম রবীন্দ্রভক্তি প্রদর্শন করেননি। রবীন্দ্রনাথ তার মনমানসিকতায় প্রতিভাত হননি গুরুদেব হিসেবে। এ জন্যই তিনি অসুস্থ কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ভারত থেকে স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। রবীন্দ্রনাথকে নয়, তিনি নজরুলকেই প্রতিষ্ঠিত করেন বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবে। কিন্তু নজরুলকে অবহেলা করে বর্তমান আওয়ামী লীগ ভারতকে খুশি করার জন্য শুরু করেছে যেন রবীন্দ্রপূজা। যে রকম রবীন্দ্রপূজা এখন আর ভারতেও নেই। রবীন্দ্রনাথকে তারা চাচ্ছে বস্তুনিষ্ঠভাবে মূল্যায়ন করতে। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যের একটা বিরাট অংশকে ভারতে বলা হচ্ছে আসলে অনুবাদ সাহিত্য। রবীন্দ্রনাথের একাধিক ছোটগল্পে রয়েছে মার্কিন গল্প লেখক এডগার এলেন পোর প্রভাব। কবিতায় রয়েছে একাধিক ইংরেজ কবির লেখার ছায়া। উপন্যাসে পড়েছে গলস্ওয়ার্থ (J Galsworthy)-এর মতো লেখকের প্রভাব। রবীন্দ্রনাথের স্বকীয়তা নিয়ে এখন সৃষ্টি হতে পেরেছে যথেষ্ট সমালোচনা। রবীন্দ্রনাথ গীতাঞ্জলির জন্য ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তার এই ইংরেজি অনুবাদে থেকেছে বিলাতের কবি ইয়েটসের প্রভাব। ইয়েটস তার কবিতাগুলোর ইংরেজি অনুবাদকে করেছিলেন সম্পাদনা। দিয়েছিলেন তার বর্তমান রূপ। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি গীতাঞ্জলি বহন করে না কেবলই রবীন্দ্রপ্রতিভার পরিচয়। এসব কথা এখন বিশেষভাবে বলছেন ভারতীয় রবীন্দ্র সমালোচকরা। কিন্তু আমরা করছি রবীন্দ্রপূজা। দেখাচ্ছি রবীন্দ্রভক্তি। রবীন্দ্রনাথের গান আমাদের ভালো লাগে। কিন্তু এই গানেও আছে ইউরোপীয় গানের প্রভাব।

বাংলা গানে প্রথম ইউরোপীয় গানের প্রভাব বহন করে আনেন দ্বীজেন্দ্রলাল রায়। দ্বীজেন্দ্রলাল রায় রচিত ও সুরারোপিত গান ‘ধন ধান্য পুষ্পে ভরা’কে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত করার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু ভারত সরকারের চাপে সেটা করা সম্ভব হয়নি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার বাংলা’ গানটিকে চাপিয়ে দেন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে। এই গানটি রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছিলেন ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের সময়। এর ল্য ছিল বঙ্গভঙ্গ রদ করা। এর ল্য ছিল না কোনো পৃথক স্বাধীন বাংলাদেশ গড়া। রবীন্দ্রনাথ ও ঠাকুর পরিবার একসময় ছিলেন খুবই ব্রিটিশভক্ত। রবীন্দ্রনাথ তার গীতাঞ্জলিতে ‘ভারততীর্থ’ কবিতায় বলেছেন, ইংরেজকে শুচিমন করে ভারত শাসন করতে, ছেড়ে যেতে নয়। একপর্যায়ে রবীন্দ্রনাথ বলতেন তিনি বিশ্বমানবতায় বিশ্বাস করেন। তিনি সর্বপ্রকার জাতীয়তাবাদের বিরোধী। এ নিয়ে এ দেশে যারা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন করছিলেন তাদের সাথে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি হয় ভাবগত বিরোধ। কবি নজরুল ব্রিটিশবিরোধী কবিতা লিখে জেল খেটেছেন। তার আগে ব্রিটিশ শাসনবিরোধী কবিতা লিখে জেল খেটেছেন ইসমাইল হোসেন শিরাজী। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কখনোই এ রকম কিছু লিখেননি। বরং তার বিখ্যাত ‘চার অধ্যায়’ উপন্যাসে যা লিখেছেন, তা হতে পেরেছে ব্রিটিশ কর্তৃপরে কাছে খুবই গ্রহণযোগ্য। শরৎচন্দ্রের উপন্যাস ‘পথের দাবি’ ইংরেজ আমলে নিষিদ্ধ হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ তখন বলেনÑ শরৎচন্দ্র এ রকম উপন্যাস লিখে ঠিক কাজ করেননি। এ হলো রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণার পরিচয়। কিন্তু এই রবীন্দ্রনাথকেই এখন আওয়ামী লীগ সরকার তুলে ধরতে চাচ্ছে বাঙালি জাতীয়তাবাদের অন্যতম অংশ হিসেবে। আর এটা জড়িয়ে পড়ছে তাদের পররাষ্ট্রনীতিরও সাথে। কারণ এর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ভাবছে ভারতের সাথে গড়ে উঠতে পারবে বিশেষ সুসম্পর্ক।

অনেক কিছুই ঘটছে দণি এশিয়ায়। ভারত নির্মাণ করছে এমন পেণাস্ত্র, যা চীনের রাজধানী বেইজিংকে আঘাত করতে পারবে পরমাণু বোমা বহন করে। অন্য দিকে পাকিস্তান নির্মাণ করতে সম হয়েছে এ রকম পেণাস্ত্র, যা পরমাণু বোমা বহন করে ভারতের যেকোনো অঞ্চলকে আঘাত করতে সম। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের অস্ত্রভাণ্ডারে পারমাণবিক অস্ত্র ছিল না। কিন্তু পাকিস্তান এখন নিজেই পারছে পরমাণু বোমা বানাতে। বাংলাদেশ সরকার পাকিস্তানকে সামরিক দিক থেকে যতটা দুর্বল মনে করছে পাকিস্তান তা নয়। পাকিস্তানের সাথে চীনের সামরিক সহযোগিতা বাড়ছে। চীন পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে ইতোমধ্যেই নির্মাণ করেছে নৌঘাঁটি। সম্প্রতি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন পাকিস্তান সফরে যাওয়ার। মনে হচ্ছে এর ফলে পাকিস্তান ও রাশিয়ার মধ্যে সামরিক সহযোগিতা বাড়বে। আর এর ফলে দণি এশিয়ায় ভারত পাকিস্তান সামরিক শক্তির অনুপাত আগের তুলনায় অনেক ভিন্ন হয়ে পড়বে। বর্তমান বাংলাদেশ সরকার এটা উপলব্ধি করতে পারছে কি না আমরা তা অবগত নয়। বর্তমান পাকিস্তান হচ্ছে ব্রিটিশ শাসনামলের সেসব অঞ্চল নিয়ে গঠিত যেখান থেকে ব্রিটিশ-ভারতের সেনাবাহিনীতে এসেছে অধিক সৈন্য। বর্তমান পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশের মানুষ হলেন অনেক রণনিপুণ (War-Like)। ১৯৭১ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে সাবেক পাকিস্তান বাহিনী হেরে যায়। এর কারণ ছিল তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ হয়ে উঠেছিল তাদের বৈরী। জনসমর্থনের অভাবেই তাদের হেরে যেতে হয়। কিন্তু এখন সেই অবস্থা আর বিরাজ করছে না। তথাপি আওয়ামী লীগ একাত্তরের কথা বিবেচনা করে গ্রহণ করতে চাচ্ছে পররাষ্ট্রনীতি। যেটাকে বলা যেতে পারে মূলগতভাবেই ভুল।

আওয়ামী লীগ বলছে বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা। অন্য দিকে বিএনপি বলছে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের কথা। এই দুই দলের মধ্যে এখন বাংলাদেশে সৃষ্টি হতে পারছে চরম বিরোধ। এই দুই দলের বিরোধ কেবলই মতার ব্যাপার নয়, কিছুটা মতাদর্শেরও ব্যাপার। রাষ্ট্রপতি জিয়া চাননি পাকিস্তানের সাথে বিবাদ বিসংবাদ। তিনি চেয়েছেন, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদকে শক্তিশালী করতে। আর এ েেত্র চেয়েছেন বর্তমান পাকিস্তানের বেশ কিছুটা সহযোগিতা। আওয়ামী লীগের বাঙালি জাতীয়তাবাদ আর বিএনপির বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ ঠিক এক প্রকৃতির জাতীয়তাবাদ নয়। আর এই দুই দলের পররাষ্ট্রনীতিও তাই হতে পারে না একই রকম। বিএনপি ভারতের সাথে বৈরিতা চায় না। কিন্তু মৈত্রী গড়তে গিয়ে চায় না আপন জাতিসত্তাকে ভারতের মধ্যে বিলুপ্ত করতে।
গত সংখ্যার সংশোধনী : গত সংখ্যায় ভুলবশত ছাপা হয়েছিলÑ ভারতের সেনাবাহিনীতে টাটা কোম্পানির ট্রাক কেনা নিয়ে সংঘটিত ঘুষ কেলেঙ্কারি নিয়ে ঘটতে পেরেছে বিরাট অনুসন্ধান। সেখানে আসলে হবেÑ 
ভারতের সেনাবাহিনীতে টাট্রা কোম্পানির ট্রাক কেনা নিয়ে সংঘটিত ঘুষ কেলেঙ্কারি নিয়ে ঘটতে পেরেছে বিরাট অনুসন্ধান। টাট্রা একটি চেক কোম্পানি।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

রবিবার, ২২ এপ্রিল, ২০১২

দুর্নীতি নিয়ে কথা

দুর্নীতি নিয়ে কথা


আত্মপক্ষ

॥ এবনে গোলাম সামাদ ॥

দুর্নীতির একটা সংজ্ঞা দেয়া কঠিন। তবে সাধারণভাবে বলা যায়, দুর্নীতি সমাজজীবনের জন্য তিকর নীতি, যা সমাজসঙ্গতির বিনষ্ট ঘটায়। ঘটায় অনেক লোকের তি। খবরের কাগজে একটা ছোট্ট খবর পড়লাম। ঘটনাটি ঘটেছে যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান অঙ্গরাষ্ট্রে। সেখানকার এক বাসিন্দা আমান্ডা কেটন, যার বয়স ২৫ বছর, লটারিতে টাকা পেয়েছেন সাত লাখ ৩৫ হাজার ডলার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক অঙ্গরাষ্ট্রে লটারিকে মনে করা হয় দুর্নীতি। কারণ মানুষকে লটারি হঠাৎ পাইয়ে দেয় বিনা শ্রমে অনেক টাকা। শ্রমবিহীনভাবে অর্থ লাভকে সেখানে মনে করা হয় সমাজজীবনের জন্য তিকর। কারণ মানুষ এতে হয়ে উঠতে চায় নিছক ভাগ্যবাদী। চায় হঠাৎ টাকা পেয়ে বড়লোক হতে। কিন্তু লটারিতে টাকা পেয়ে খুব কম লোকই বাস্তবে বড়লোক হতে পারে। বহু লোক লটারির টিকিট কিনে তিগ্রস্ত হয়। লটারিতে টাকা পেয়েছেন আমান্ডা কেটন। তিনি ছিলেন খুবই দরিদ্র। মিশিগানের নিয়মানুসারে তিনি রেশনে খাবার কিনে খেতেন। এ রকম সস্তা রেশন গরিব মানুষকে দেয়া হয়। কিন্তু লটারিতে অত টাকা পাওয়ার পরেও কেটন সস্তায় রেশন নিয়েছেন। এ কারণে হয়েছে তার বিরুদ্ধে মামলা। মামলায় তিনি দোষী প্রমাণিত হলে তার হবে চার বছর সশ্রম কারাদণ্ড। মিশিগানের আইনানুসারে কেবল যারা দরিদ্র হিসেবে বিবেচিত, তারাই পেতে পারে রেশনে সস্তায় খাদ্য কিনতে। এই আইন ভঙ্গ করে আমান্ডা কেটনকে দাঁড়াতে হচ্ছে অপরাধীর কাঠগড়ায়। আইন ভঙ্গ করা দুর্নীতির অংশ। তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে মিশিগানের মানবাধিকার সংস্থা। এই সংস্থা বলেছে, কেটন রাতারাতি লটারিতে টাকা পেয়ে গরিব থেকে পরিণত হয়েছেন ধনী ব্যক্তিতে। কিন্তু তিনি এ ঘটনাকে গোপন করে গ্রহণ করেছেন দরিদ্রের প্রাপ্য রেশন। কেটনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। দোষী সাব্যস্ত হলে তাকে পেতে হবে সাজা। ভাবছিলাম আমাদের দেশের কথা। আমরা গরিব মানুষকে বেশ কিছু েেত্র সস্তায় খাদ্যশস্য প্রদান করছি, যাকে বলা হচ্ছে ভিজিএফ (ভালনারেবল গ্র“প ফিডিং)। এতে অনেক দুর্নীতি হচ্ছে। এমন অনেকে ভিজিএফ খাচ্ছেন, যা তাদের পাওয়া উচিত নয়। তবে কোনো মামলা হচ্ছে না এদের বিপ।ে অন্তত আমার চোখে পড়েনি এ রকম মামলা হওয়ার খবর। ক’দিন ধরে পত্রিকায় পড়লাম সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের কথা। তিনি দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়ে হারালেন মন্ত্রিত্ব। কিন্তু আবার হতে পারলেন দফতরবিহীন মন্ত্রী। এ রকম কাণ্ড আর কোনো দেশে ঘটতে পারত কি না আমরা জানি না। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে মনে করতাম পাকা রাজনীতিবিদ। তিনি মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিয়ে যথাযথ কাজই করেছিলেন। কিন্তু আবার মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করে নিজেকে হালকা করে ফেললেন। এভাবে মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করা মনে হয়, আরো একটা বড় দুর্নীতি। রাজনীতির েেত্র সৃষ্টি করা হলো একটা খারাপ নজির। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এটা না করলেও পারতেন। এতে থাকত তার রাজনৈতিক পরিপক্বতার পরিচয়। আমার মনে পড়ছে, ভারতের বিখ্যাত রাজনীতিবিদ লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর কথা। তিনি একসময় ছিলেন রেলমন্ত্রী। তখন হয়েছিল একটা শোচনীয় রেল দুর্ঘটনা। তিনি এর জন্য রেলমন্ত্রিত্ব পদ থেকে দিয়েছিলেন ইস্তফা। এর অনেক পরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওয়াহের লাল নেহরুর মৃত্যুর পর লাল বাহাদুর শাস্ত্রী হন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। তার চারিত্রিক দৃঢ়তা তাকে প্রদান করেছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রিত্ব। ১৯৬৫ সালে হয় কাশ্মির নিয়ে পাক-ভারত যুদ্ধ। সে যুদ্ধের মীমাংসা করতে এগিয়ে আসে তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন। লাল বাহাদুর শাস্ত্রী চাননি পাকিস্তানের সাথে বিবাদ। তিনি গ্রহণ করেন যুদ্ধ স্থগিত রাখার প্রস্তাব, যা গ্রহণ করার পরপরই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে লাল বাহাদুর শাস্ত্রী মারা যান। আমাদের রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের কি লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর সাথে কোনো সুদূর তুলনা করা চলে? শাস্ত্রী লেখাপড়া করেছিলেন সংস্কৃত টোলে। তিনি ছিলেন নিষ্ঠাবান হিন্দু। আর ছিলেন অসাধারণ নৈতিকতাবান ব্যক্তি। কিন্তু সুরঞ্জিত মোটেও তা নন। হলে এ দেশের রাজনীতির ইতিহাস নিতে পারত একটা ভিন্ন ধরনের রূপ। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত যা করলেন, সেটা প্রমাণ করল তিনি আওয়ামী লীগের আর পাঁচজন মতালোভী মন্ত্রীর মতোই একজন অতি সাধারণ মতালোভী রাজনৈতিক নেতা। তার মধ্যে নেই কোনো উচ্চতর নৈতিক আদর্শের অনুপ্রেরণা। থাকলে সেটা এ দেশের সবার জন্য কল্যাণজনক হতে পারত। হতে পারত গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার েেত্র একটি বিশেষ পদপে। কিন্তু তা হলো না। দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি হলো বিশেষভাবে বিবর্ণ। আওয়ামী লীগের একজন নেতা আবদুল জলিল বলেছেন, সুরঞ্জিতের ঘটনায় যাওয়া যাচ্ছে না সভ্যসমাজে; আওয়ামী লীগের ভেতর থেকেও উঠছে এ ঘটনার প্রতিবাদ।
বিলাতে রেলগাড়ি চলতে শুরু করে ১৮২৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে। এর আগে সেখানে ছিল ঘোড়ায় টানা রেলগাড়ি, যা চলত রেললাইনের ওপর দিয়ে। কিন্তু গাড়িগুলো টানত অনেকগুলো ঘোড়া মিলে। ১৮২৫ সাল থেকে শুরু হয় বাষ্পচালিত ইঞ্জিনের সাহায্যে রেলগাড়ি চলা। এর ফলে বিলাতের যোগাযোগব্যবস্থায় ঘটে বিরাট বিপ্লব। এটাকে বলা চলে সে দেশের শিল্প বিপ্লবের অন্যতম বুনিয়াদ। এই উপমহাদেশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে প্রথম রেল চলে ১৮৫৩ সালে। রেল চালু হয়েছিল রেল কোম্পানির উদ্যোগে। এতে কোনো সরকারি উদ্যোগ ছিল না। ছিল বিলাতের বেসরকারি কোম্পানির উদ্যোগ। রেলগাড়ি ছিল একটা ব্যবসায়ের ব্যাপার। আর তা বিলাতে এবং এই উপমহাদেশে প্রতিষ্ঠা পায় বেসরকারি কোম্পানির মাধ্যমে। রেল কোম্পানির জন্য প্রয়োজনীয় মূলধন এই উপমহাদেশে এসেছিল বিলাত থেকে। প্রথম রেলগাড়ি চলে পশ্চিমবঙ্গে। আর এর অনেক পরে উত্তর-পূর্ববঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গে রেলগাড়ি চলার পর রানীগঞ্জ অঞ্চল থেকে মালগাড়িতে করে কয়লা আনা অনেক সহজ হয়। কলকাতার কাছে গঙ্গার দুই ধার দিয়ে এর ফলে ব্রিটিশ পুঁজিতে স্থাপিত হতে পারে অনেক পাটকল। পাট প্রধানত উত্তর ও পূর্ববঙ্গের ফসল। কিন্তু পাটকল গড়ে ওঠে পশ্চিমবঙ্গে। সেখানে ঘটে বেশ কিছু শিল্প বিপ্লব। কার্ল মার্কস বিলাতে শিল্প বিপ্লব ঘটার অন্যতম কারণ হিসেবে বলেছেন রেলগাড়ির প্রবর্তনকে। তিনি তার একটি লেখায় বলেছেন, রেলগাড়িকে নির্ভর করে তদানীন্তন ভারতে আসবে শিল্প বিপ্লব। আর শিল্প বিপ্লব উন্মুক্ত করবে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ। কিন্তু কার্ল মার্কসের এই ভবিষ্যদ্বাণী বিলাতে ও ভারতের েেত্র সত্য হতে পারেনি। এই উপমহাদেশে রেলগাড়ি এক সময় ছিল যোগাযোগব্যবস্থার মেরুদণ্ড। কিন্তু খনিজ তেল-ইঞ্জিন আবিষ্কার হওয়ার পর এই উপমহাদেশেও প্রচলিত হয় বাস, ট্রাক ও মোটরগাড়ি। রেলের আর আগের মতো গুরুত্ব থাকে না। কারণ মালগাড়িতে করে জিনিসপত্র নেয়ার খরচ পড়ে কম।
বাংলাদেশ ভৌগোলিক দিক থেকে বড় নয়। ভারতের তুলনায় এখানে রেলের গুরুত্ব হয়ে পড়েছে অনেক কম। তাই রেলমন্ত্রীর কোনো পদ এখানে ছিল না। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ভাবছে, যোগাযোগব্যবস্থায় রেল পালন করতে পারে বিশেষ ভূমিকা। রেলের মাধ্যমে সে চাচ্ছে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সাথে বিশেষ যোগাযোগব্যবস্থা স্থাপন করতে; বাণিজ্যিক যোগাযোগ বাড়াতে। সম্ভবত ভারত সরকারের বুদ্ধিতেই বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার সৃষ্টি করেছে রেলমন্ত্রীর পদ। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বর্তমানে কম করে আটটি স্থান দিয়ে সহজেই রেল যোগাযোগ স্থাপন করা যায়। ব্রিটিশ শাসনামলে এই যোগাযোগ ছিল। এটা আবার স্থাপিত হলে সুগম হবে পূর্ব এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের মধ্যে যোগাযোগব্যবস্থা। ভারত সরকার এখন এটা বিশেষভাবে গড়ে তুলতে চাচ্ছে। আর সে চাচ্ছে বাংলাদেশে এমন এক ব্যক্তি রেলমন্ত্রী হোন, যার ওপর থাকবে তার একটা বিশেষ প্রভাব। অনেকের ধারণা, এ কারণেই সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত হতে পেরেছিলেন রেলমন্ত্রী। কিন্তু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত জড়িয়ে পড়লেন এক অভাবিত অর্থ কেলেঙ্কারিতে। তাই তাকে ছাড়তে হলো রেলমন্ত্রীর পদ। পরে তিনি আবার হলেন দফতরবিহীন মন্ত্রী। তাকে দফতরবিহীন মন্ত্রী করে আওয়ামী লীগ হারালো তার ভাবমূর্তি। খবরে প্রকাশ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পুত্র পাঁচ কোটি টাকা দিয়ে খুলেছেন একটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান। তিনি কোনো লটারিতে টাকা পাননি। তিনি হঠাৎ কী করে এত টাকার মালিক হলেন, তাতে জাগছে অনেকের প্রশ্ন। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, তিনি যা কিছু করেছেন, তা করেছেন গণতন্ত্রের স্বার্থে। কিন্তু দুর্নীতিকে নির্ভর করে কোনো দেশেই গণতন্ত্র সাফল্য পেতে পারে না।
ভারতের গণতন্ত্র আমাদের শ্রদ্ধার বিষয়। কিন্তু সে দেশের গণতন্ত্র হয়ে উঠেছে প্রশ্নের সম্মুখীন। ভারতের সেনাবাহিনীতে টাটা কোম্পানির ট্রাক কেনা নিয়ে সংঘটিত ঘুষ কেলেঙ্কারি নিয়ে ঘটতে পেরেছে বিরাট অনুসন্ধান। টাটা কোম্পানির পে থেকে ভারতের সেনাপ্রধানকে দেয়া হয়েছিল ঘুষের প্রস্তাব। বলা হয়েছিল, তিনি যদি টাটা কোম্পানির ট্রাক কেনেন তবে তাকে দেয়া হবে ১৪ কোটি ভারতীয় টাকা ঘুষ। কিন্তু তিনি তা নিতে রাজি হননি। তাকে যারা ঘুষ দিতে চেয়েছিলেন তারা হলেন সেনাবাহিনীর সাথে সংশ্লিষ্ট সাবেক উচ্চপদস্থ কর্মচারী। ভারতের সেনাবাহিনীতে কে সেনাপ্রধান হবেন তা নিয়ে এখন সুপ্রিম কোর্টে হতে পারছে মামলা। ভারতের সেনাবাহিনীর ভেতরের অবস্থা ভালো নয়, যা ভারতের গণতন্ত্রকে করে তুলতে পারে বিপন্ন। দুর্নীতি সব দেশেই আছে, তবে তারা যে সব দেশেই বড় সমস্যা তা নয়। জেলখানা সব দেশেই আছে, কিন্তু তাই বলে সব দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এক নয়। বাংলাদেশে দুর্নীতি ছিল এবং হয়ে আছে রাষ্ট্র পরিচালনার েেত্র অন্যতম মূল সমস্যা। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ঘটনা এই বাস্তবতাকেই আমাদের কাছে আবার নগ্ন করে তুলল।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত একসময় বাম রাজনীতি করতেন। দেশে দেশে বাম রাজনীতিকেরা হয়ে পড়েছেন যথেষ্ট দুর্নীতিগ্রস্ত। বিরাট সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার একটা কারণ হলো দুর্নীতিগ্রস্ত বাম রাজনীতি। দণিপন্থী নেতাদের মধ্যে কাজ করে কিছু ধর্মবিশ্বাস। ধর্মচেতনা তাদের নৈতিক হতে কিছু অনুপ্রেরণা জোগায়। কিন্তু বাম নেতাদের মধ্যে ধর্মচেতনার অভাব তাদের অনৈতিক করে তোলে সহজেই। সুরঞ্জিত বাবুদের তথাকথিত ধর্মনিরপেতা করে তুলছে সহজেই অনৈতিক। তাদের রাজনীতিতে থাকছে না কোনো নীতি-চেতনার বিশেষ আদর্শ। 
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

রবিবার, ৮ এপ্রিল, ২০১২

ভারতীয় প্রতিরাব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা

ভারতীয় প্রতিরাব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা



॥ এবনে গোলাম সামাদ ॥

ভারতের আছে এক বিরাট স্থলবাহিনী। কিন্তু এই বাহিনীর সমরশক্তি কতটুকু সেটা নিয়ে ভারতে এখন সৃষ্টি হতে পারছে সংশয়। সমপ্রতি ভারতের সেনাপ্রধান বিজয় কুমার সিং (ভি কে সিং) বলেছেন, ভারতের প্রতিরাব্যবস্থা মোটেও আধুনিক নয়। ট্যাঙ্ক বাহিনীর যে গোলাবারুদ আছে তা যেকোনো বড় যুদ্ধে দু’দিনের মধ্যেই ফুরিয়ে যেতে পারে। এ রকম সীমিত সমরশক্তি নিয়ে কোনো সেনাবাহিনীর প েযুদ্ধ করা সম্ভব নয়। তিনি আরো বলেন, সেনাবাহিনীতে চলেছে নানা দুর্নীতি। ভি কে সিংকে সদ্য অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল, তেজেন্দার সিং ৬০০ টাটার ট্রাক কেনার জন্য ১৪ কোটি রুপি ঘুষ দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তাতরা ট্রাক কিনতে সম্মত হননি। কারণ তার মতে এই ট্রাক উচ্চ মানসম্পন্ন নয়। তিনি (ভি কে সিং) ভারতীয় সেনাবাহিনীর দুর্বলতা এবং দুর্নীতি নিয়ে সমপ্রতি একটি চিঠি লিখেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে। ভি কে সিংকে খুব সহজ মানুষ বলে মনে হচ্ছে না। তার মধ্যেও রয়েছে যথেষ্ট জটিলতা। তিনি এ বছরের জানুয়ারি মাসের ১৫ তারিখে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে তার বয়স সম্পর্কে একটি মামলা দায়ের করেন। তিনি বলেন, ‘তার জন্ম তারিখ ঠিক লেখা হয়নি। তার জন্ম ১৯৫০ সালে নয়। তার জন্ম হয়েছে ১৯৫১ সালে।’ তাই তাকে এ বছর মে মাসের ৩১ তারিখে অবসর গ্রহণে বাধ্য করা ঠিক হচ্ছে না। ॥
কিন্তু ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বলেন, এফিডেভিট করে তিনি আইনত এখন আর বয়স কমাতে পারবেন না। তাকে তাই মে মাসের ৩১ তারিখে সেনাবাহিনী থেকে আইন মোতাবেক অবসর গ্রহণ করতে হবে। যেদিন ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এই রায় দিচ্ছিলেন, সে সময় ভারতের সেনাবাহিনীর একটি বিশেষ সাঁজোয়া ইউনিট ও ছত্রী বাহিনীর একটি ইউনিট ভারতের প্রতিরা মন্ত্রণালয়কে অবহিত না করে যাত্রা শুরু করে রাজধানী দিলিস্ন অভিমুখে। যাকে অনেকে সন্দেহ করছেন সামরিক অভ্যুত্থানের একটি প্রচেষ্টা হিসেবে। যা সফল হতে পারেনি, ঠিক সময়ে প্রতিরা দফতর এর বিপ ব্েযবস্থা নিতে পারার ফলে। খবরটি প্রকাশিত হয়েছে ভারতের The Indian Express নামক দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাতায় এপ্রিল মাসের ৪ তারিখে। এই খবর প্রকাশ হওয়ার পর সারা ভারতে তোলপাড় শুরু হয়েছে। মনে করা হচ্ছে, সেনাবাহিনী এবার না পারলেও আগামীতে পারে মতা দখল করতে। আশ্চর্যজনকভাবে, ভি কে সিংয়ের বিরুদ্ধে গ্রহণ করা হচ্ছে না কোনো ব্যবস্থা। অন্য যেকোনো দেশ হলে তাকে মতাচ্যুত হতে হতো। পেতে হতো সেনাবাহিনীর আইন ভঙ্গ করার জন্য বিধি মোতাবেক শাস্তি। কিন্তু তিনি এখন পর্যন্ত সেনাবাহিনীতে বহাল আছেন। কেবল তাই নয়, সাংবাদিকদের সাথে কথা বলছেন অনেকটা খোলামেলাভাবে। সেনাবাহিনীর অনেক স্পর্শকাতর ব্যাপার থাকছে তার এসব কথোপকথনের মধ্যে। বিখ্যাত মার্কিন সেনাপতি ম্যাক আর্থার ১৯৫২ সালে কোরিয়া যুদ্ধের সময় তখনকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানের সাথে ভিন্নমত পোষণ করেন। 
মার্কিন প্রেসিডেন্ট এ কারণে তাকে করেছিলেন পদচ্যুত। কিন্তু ভারতের প্রেসিডেন্ট ভি কে সিংকে পদচ্যুত করার কথা ভাবতে পারছেন না। মনে হচ্ছে ভি কে সিংয়ের বিরাট প্রভাব আছে সেনাবাহিনীর মধ্যে। ভারত সরকার তাই ভয় পাছে তার বিপ েকোনো ব্যবস্থা নিতে। তারা তাকে কেবল সরিয়ে দিতে চাচ্ছেন এ বছর মে মাসের ৩১ তারিখে। প্রস্তাব উঠেছে তার জায়গায় লেফটেন্যান্ট জেনারেল বিক্রম সিংকে ভারতের সেনাপ্রধান করতে। কিন্তু অনেকেই চাচ্ছেন না বিক্রম সিংকে সেনাপ্রধান করতে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে দুর্নীতির। তার বিপ েআছেন ভারতের সাবেক নৌবাহিনীপ্রধান অ্যাডমিরাল এল এন রামদাস ও সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এন গোপালস্বামী। তারা বিক্রম সিংয়ের নিয়োগ ঠেকাতে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেছেন। 
কঙ্গোয় জাতিসঙ্ঘ শান্তি মিশনে থাকার সময়ও তার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি অভিযোগ ছিল বলে উলেস্নখ করা হয়। তিনি কঙ্গোতে যান জাতিসঙ্ঘের ভারতীয় শান্তিবাহিনীর সেনাপরিচালক হিসেবে। এসব থেকে মনে হচ্ছে, ভারতের সেনাবাহিনীর মধ্যে শুরম্ন হয়েছে মতার লড়াই। এর পরিণতি শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়াবে তা বলা যাচ্ছে না। বর্তমান সেনাপ্রধান ভি কে সিং ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে বলেছেন, ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা RAW (Research and Analysis Wing) একটি গোপন বাহিনী পরিচালনা করছে ভারতের অরুণাচল প্রদেশে। এই বাহিনীর ওপর ভারতের মূল সেনাবাহিনীর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এর কাজ হলো তিব্বতে যারা চীনের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধে নিযুক্ত তাদের সাহায্য করা। ভারতের সেনাবাহিনীতে তাই সৃষ্টি হচ্ছে পরিচালনা সঙ্কট। এদের কার্যকলাপে চীন-ভারত যুদ্ধ বাধলে ভারতীয় সৈন্য পড়তে পারে বিশেষ বিপাকে। 
অরুণাচলে চীন এখনো ভারতের সার্বভৌমত্ব মানতে চাচ্ছে না। চীন বলছে, ভারতের অরুণাচলে প্রায় ৭৬ হাজার ৮০০ বর্গকিলোমিটার জায়গা ভারত দখল করে রেখেছে। ভারতের উচিত হবে আলোচনার মাধ্যমে এই জায়গা সম্পর্কে সমঝোতায় আসা। এই জায়গা নিয়ে এবং লাদাখের কিছু এলাকা নিয়ে ১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বাধে চীন-ভারত যুদ্ধ; যা শেষ হয় ওই বছর নভেম্বর মাসে। এই যুদ্ধে ভারত হেরে যায় শোচনীয়ভাবে। কিন্তু ভারত-চীন এখন পর্যন্ত এই এলাকা কে কতটুকু নিয়ন্ত্রণ করবে তা নিয়ে কোনো সমঝোতায় আসতে পারেনি। এলাকাটি হয়ে আছে বিশেষভাবে বিরোধপূর্ণ। এই এলাকায় তাই ভারতের সেনাবাহিনীকে না জানিয়ে RAW যে তৎপরতা চালাচ্ছে, সেটা ভারতীয় সেনাবাহিনী সমর্থন করতে পারে না। ভি কে সিংয়ের এই বক্তব্য ভারতে সৃষ্টি করেছে বিশেষ চাঞ্চল্য। 
মনে হচ্ছে ভারতের প্রতিরাব্যবস্থা হয়ে পড়তে চাচ্ছে ভেতর থেকেই দুর্বল। কারণ সেনাবাহিনীর অন্যতম প্রধান কথা হচ্ছে, শৃঙ্খলা। কোনো বিশৃঙ্খল সেনাবাহিনী কোনো যুদ্ধেই জয়ী হতে পারে না। ভারতের প্রতিরাব্যবস্থা ভারতের নাগরিকদের চিন্তার বিষয়। তবে বাংলাদেশের উচিত হবে এ েত্ের ভারতের ঘটনাপ্রবাহের ওপর সজাগ দৃষ্টি রাখা। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার হয়ে উঠেছে খুবই ভারতপ্রেমী। ভারতের গোলযোগে অনেক সহজেই তাই জড়িয়ে পড়তে পারে বাংলাদেশ। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত একই অ েঅবস্থান করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি গণতন্ত্রী দেশ। কিন্তু সে ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশকে আপন নিয়ন্ত্রণে রাখার ল্যে ওইসব দেশে সমর্থন দিয়ে এসেছে সেনাশাসকদের। ভারতের েত্ের যে ঠিক কী নীতি অনুসরণ করবে তা বলা যাচ্ছে না। সাবেক পাকিস্তানে ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খানকে মতায় আসতে সহায়তা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র তার আপন স্বার্থের কথা বিবেচনা করে। ভারতের কোনো সেনাপ্রধান আগামীতে একইভাবে, একই রকম কারণে পেতে পারেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ বিবেচনা। 
লেখক : প্রবীণ শিৰাবিদ, কলামিস্ট